বেগমের নূর পথ দেখাবে আরো বহুকাল


প্রকাশিত: ০৪:১০ এএম, ২৫ মে ২০১৬

নূরজাহান বেগম বেশ কয়েকদিন ধরেই হাসপাতালে ছিলেন। বয়স হয়েছিল ৯১। তাই তার মৃত্যুটা বড় ধাক্কা হয়ে আসেনি। তবে অলক্ষ্যেই অবসান ঘটলো একটি যুগের। আজ থেকে ৭০ বছর আগে একজন নারীর সম্পাদনায়, শুধু নারীদের লেখা নিয়ে প্রতি সপ্তাহে একটি পত্রিকা বেরুচ্ছে, এটা ভাবলেই শ্রদ্ধায়-কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে। বেগম একটি পত্রিকা, নূরজাহান বেগম সম্পাদক, প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হয়- এসব নিছকই পরিসংখ্যান। কিন্তু নিছক পরিসংখ্যান দিয়ে বেগমের গুরুত্ব বোঝানো যাবে না। এ দেশের নারী জাগরণে বেগমের প্রভাব অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। কত নারী বেগম পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, কত লেখক তৈরি হয়েছে কোনো পরিসংখ্যানের সাধ্য কি তা বোঝায়।

১৯৪৭ সালে কলকাতায় প্রথম বেগম প্রকাশিত হয়। প্রথম সম্পাদক ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। তারপর সম্পাদনার দায়িত্ব নেন নূরজাহান বেগম। ১৯৫০ সালে ঢাকায় চলে আসে বেগম। তারপর থেকে অব্যাহত ছিল প্রকাশনা। তবে এই ৭০ বছরে নানা চড়াই-উৎরাই পেরুতে হয়েছে বেগমকে। ডিমাই সাইজ থেকে ম্যাগাজিন হয়েছে, ব্লক ছাপা থেকে উন্নত কম্পিউটার কম্পোজ হয়েছে, সাপ্তাহিক থেকে মাসিক হয়েছে, শেষ সময়ে শুধু ঈদ সংখ্যা হয়েছে। টিমটিম করে হলেও বেগমের আলো জ্বলছিল। এবারও ঈদসংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু তা আর দেখে যেতে পারলেন না নূরজাহান বেগম।

বলছিলাম বেগমের প্রভাব এবং গুরুত্বের কথা। এই একবিংশ শতাব্দীতেও বাংলাদেশের নারী অগ্রগতির পথে পথে নানা বাধা। মৌলবাদীরা বার বার নারীদের পথ আগলে দাঁড়ায়। তেঁতুল হুজুররা এখনও মেয়েদের ঘরে আটকে রাখতে চান। কিন্তু তারপরও সব বাধা পেরিয়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন সকালে গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় নারী শ্রমিকদের লম্বা সারি আমাদের মন ভালো করে দেয়। দেখলেই বুঝি বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

অজপাড়াগায়ে মেয়েরা যখন দল বেঁধে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়, মেয়েরা যখন ফুটবল খেলে আন্তর্জাতিক সম্মান বয়ে আনে, সুইমিং পুল থেকে তুলে আনে স্বর্ণ, এভারেস্টের চূড়ায় ওড়ায় লাল সবুজ পতাকা; তখন গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়। অনেকদিন ধরেই পাবলিক পরীক্ষায় মেয়েরা ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে ভালো ফল করছিল। এবার এসএসসি পরীক্ষায় মেয়েরা ছেলেদের ছাড়িয়ে গেছে। পরীক্ষার ফল হাতে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছেলেদের মেয়েদের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো ভালো ফল করার পরামর্শ দিয়েছেন। কী আশ্চর্য। ৭০ বছর আগে তো দূরের কথা, ৩০ বছর আগে আমাদের ছেলেবেলায়ও নারীদের এত সাফল্য অকল্পনীয় ছিল।

এই যে মেয়েদের এত অগ্রগতি, তার পেছনে কী বেগমের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অবদান মাপা যাবে না। অলক্ষ্যেই বেগম কত নারীর হৃদয়ে প্রগতির আলো জ্বালিয়েছেন, তার কোনো লেখাজোখা নেই। ৭০ বছর আগে নারীর সম্পাদনায়, শুধু নারীদের লেখা নিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশ অসম্ভব সাহসের কাজ। এখনও ভাবলে অবাক লাগে। এখন প্রায় সব পত্রিকায় নারীদের জন্য আলাদা পাতা আছে। নারীদের পত্রিকাও আছে। কিন্তু ৭০ বছর আগে নারীরা ছিল অন্তপুরবাসিনী। সে অচলায়তন ভেঙ্গে নারীদের ভাবতে শিখিয়েছে, লিখতে শিখিয়েছে, প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে বেগম। বেগমের ঈদসংখ্যায় নারীদের লেখা ছাপা হতো ছবিসহ। তখনকার সময়ের বিবেচনায় এটা রীতিমত বৈপ্লবিক। সাপ্তাহিক বেগমকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল বেগম ক্লাব। সেই ক্লাবও নারী জাগরণে রেখেছে অসাধারণ ভূমিকা।

নূরজাহান বেগম জন্ম নিয়েছিলেন ১৯২৫ সালে। তখন তো বটেই, এখনও ছেলে সন্তানকে বিবেচনা করা হয় বংশের বাতি, আর কন্যারা হলো বোঝা। কিন্তু নূরজাহান বেগম প্রমাণ করেছেন মেয়েরা বোঝা তো নয়ই, বরং উত্তরাধিকার বহনে অনেক বেশি যোগ্য। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের একমাত্র সন্তান নূরজাহান বেগম। কিন্তু নূরজাহান বেগম বাবার সম্মান ধরে রেখেছেন, ধরে রেখেছেন তার স্বপ্ন। নূরজাহান বেগম না হয়ে নাসিরউদ্দিনের ছেলে হলে কি এরচেয়ে ভালো করতে পারতেন?

এ অঞ্চলের সাংবাদিকতার অগ্রদূত মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন আর নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তার কন্যা নূরজাহান বেগম। এ দুজনের সাথে আমার একটা স্মৃতি আছে। সম্ভবত ১৯৯৩ সালে বাংলাবাজার পত্রিকা থেকে আমাকে এসাইনমেন্ট দেয়া হলো মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের জন্মদিনে তাকে নিয়ে রিপোর্ট করতে। তখন তিনি শতবর্ষ পেরিয়েছেন। নারিন্দার বাসায় গেলাম। নাসিরউদ্দিন তখন কানে শুনতেন না। আমি প্রশ্ন করতাম, নূরজাহান বেগম তার বাবার কানের কাছে চিৎকার করে তা বলতেন, তারপর নাসিরউদ্দিন জবাব দিতেন। তার সব কথা আমি বুঝতাম না। নূরজাহান বেগম আবার আমাকে সেটা বুঝিয়ে দিতেন। এভাবেই নাসিরউদ্দিনের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে রিপোর্ট করেছিলাম। আমার অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র ঝুলিতে সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়ের একটি সেই বিকেল।

নূরজাহান বেগমের প্রয়াণে বেগম প্রকাশিত হবে নাকি বন্ধ হয়ে যাবে, জানি না। তবে বেগম যুগ যুগ ধরে বাংলার নারীদের হৃদয়ে সাহসের যে আলো জ্বেলেছেন, তা নিশ্চয়ই আমাদের পথ দেখাবে আরো বহুকাল।

Provash-Amin

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।