বাঙালির সংস্কৃতি ও জাতীয় উন্নয়নে একজন জননেত্রীর প্রতিকৃতি


প্রকাশিত: ০২:২০ এএম, ২২ মে ২০১৬

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বিকেলবেলা থেকে রওনা হলাম গ্রামের বাড়ি। ক্যাম্পাস থেকে দেড় ঘণ্টার ড্রাইভিং। আগে বাড়ি যেতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতো। এখন সহজেই চলে যাওয়া যায় তাই বিকেলে রওনা হলাম। হেমায়েতপুরের শহীদ রফিক সেতু পার হয়ে, সেতুর ঢালে একটি চায়ের দোকানে থামলাম। তেমন ভিড় নেই। গ্রামের চা দোকান, ছিমছাম আটপৌরে আন্তরিকতায় ঘেরা।

বেঞ্চিতে বসে চায়ের কথা বলতেই দোকানি একগাল হেসে বলে, চা খাইবেন? যেন তার বাড়িতে গেছি তাই এমন মমতাভরা কণ্ঠে চায়ের কথা বলছে। গ্রামের লোকেরা এমনিতেই কথা ফেঁদে বসে মন উজাড় করে কোন প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। কথার পিঠে কথা বলে তাতে কোন কৃত্রিমতা থাকে না। চা বানাতে বানাতে আমাকে বলে, তা যাইবেন কুনখানে? আমি বল্লাম জামশা। সে বলে, ও সিংগাইর পাড় হইয়া, চারিগ্রামের মধ্যি দিয়া যাইবেন হেই জামশা গেরামে। আহহারে কী সোন্দর নদী আপনেগো। কাকের চোখের মতো পানি। কুনো ময়লা নাই।’ চায়ের কাপ হাতে দিয়া বল্লো, এই এত সোন্দর রাস্তা দিয়া যাইতেছেন এইডা হইলো গিয়া শেখ হাসিনার জইন্য। বুঝলেন আমাগো প্রধানমন্ত্রী।’

তার কথা শুনে মনে হলো সে ধরেই নিয়েছে আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানিনা। সবচেয়ে অবাক হলাম তার এই কথা শুনে, যখন সে বল্লো, আল্লাহ যেন শেখের মাইয়ারে বাঁচাইয়া রাখে। হে বাঁচলেই আমরা বাঁচি।’ কী সরল করে সে তার মনের কথাটা বলে ফেল্লো। আমি ভাবতে থাকি, কই শহরের শিক্ষিত মানুষেরা, যারা সবচেয়ে সুবিধার মধ্যে থাকে তারাতো কখনো এমন করে বলে না।

এই যে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটছে, এত যে রাস্তাঘাট হচ্ছে, দরিদ্রের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, কৃষির ফলন বাড়ছে তা নিয়ে প্রশংসা তো তেমন শুনি না। আমার মনে হলো এই একজন জননেত্রী এই দেশের খেটে খাওয়া মানুষের কাছে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে পেরেছেন। আমি রাজনীতির লোক নই। তবু বুঝি, নেত্রীর প্রতি গভীর আস্থার কারণেই একজন সাধারণ মানুষ, যে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থেকেও এমন কথা বলতে পারে।

শেখ হাসিনা কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন নিরলস কাজের মধ্যদিয়ে। যাকে দেখলে, যার কাছে একবার পৌঁছালে মানুষ নির্ভরতার ঠিকানা খুঁজে পায়। শোকগ্রস্ত মানুষের পাশে আমরা এক মমতাময়ী নেত্রীকে দেখি। জীবনটা যার উৎসর্গ দেশের মানুষের জন্য। জীবনের কত না কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে, কত ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে জনগণকে নিয়ে জনগণের নেত্রী হয়ে উঠেছেন। স্বজন হারানো কষ্ট বুকে নিয়ে স্বজন করেছেন বাংলাদেশের মানুষকে। বাংলাদেশের মানুষ যে তাঁকে স্বজনের অধিকভাবে তার প্রমাণ দেখলাম গ্রামের একজন সাধারণ মানুষের এই সরল বচনে।

শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন তখন জিয়াউর রহমানের অপশাসনে পর্যুদস্ত বাংলাদেশ। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ধুলায় বিলীন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা প্রবল শক্তিতে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে গেছে অথচ তাদের এদেশে ঠাঁই পাওয়ার কথা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচার ইনডেমনিটি আইন করে খুনীদের রেহাই দিয়েছেন জিয়া। খুনীরা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের চরম বিকৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানী আদলে প্রতিষ্ঠার নীল নকশা বাস্তবায়নের সকল ষড়যন্ত্র শেষ করেছেন জিয়াউর রহমান। পৃথিবীর কাছে একটি অসম্মানিত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশকে। এই ভয়াবহ দুঃসময়ে জাতিকে অভয়মন্ত্রে উজ্জীবিত করেন শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে জনগণের অধিকার হননের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় জাতি। সামরিক স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হয়ে উঠেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আজ তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনবার নির্বাচিত এই প্রধানমন্ত্রী জনগণের নেত্রী হয়েই থাকছেন। দেশের মানুষের কাছে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

শেখ হাসিনার অর্জনের শেষ নেই কিন্তু তাঁর বিরোধীরা সেই অর্জনকে সবসময় আড়াল করতে চেয়েছে। তিনি দেশের ভেতরে রাজনৈতিক সংঘাত দূর করেছেন গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে। আমরা বিশ্বরাজনীতির দিকে তাকালে দেখবো জাতিগত দাঙ্গায় কত দেশ বিধ্বস্তপ্রায়। এথনিক নিধনের গভীর চক্রান্তকারী জিয়াউর রহমান যেভাবে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন তার থেকে একটি জনপদকে বাঁচিয়েছেন তিনি।

আমরা জানি আজও বহুদেশে জাতিগত আক্রমণ বিদ্যমান। আইরিশ জাতির উপর বৃটিশদের নির্যাতনের তেমন রাজনৈতিক সুরাহা আজও হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগামের মানুষের জাতিগত অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনার যুগান্তকারী শান্তিচুক্তি দেশকে অনিবার্য সংঘাত থেকে সরিয়ে এনেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় ঘটনা খুব কম আছে। এই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য তিনি। অথচ তার বদলে উল্টোটাই ঘটেছে বিশ্বরাজনীতির নোংরা কৌশলের কারণে।

জিয়াউর রহমান পাহাড়ে বাঙালি বসতি স্থাপনের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন পাহাড়ে তারা পাহাড়ীদের অধিকার খর্ব করেছে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এথনিক নিধনের সেই ভয়াবহ সময়ে লক্ষ লক্ষ পাহাড়ী আশ্রয় নিয়েছে পাশের দেশে। পাহাড়ে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। দীর্ঘ সময় আগুন জ্বলেছে পাহাড়ে। বাঙালি পাহাড়িদের মধ্যে অবিশ্বাসের দেয়াল তুলে জিয়াউর রহমান সেখানে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছিলেন। যার কুফল ভোগ করেছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে এনেছেন। পার্বত্যবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। যুগান্তকারী ভূমি আইন প্রণয়ন করে পাহাড়ীদের ভূমি রক্ষা করেছেন। সশস্ত্র শান্তিবাহিনী অস্ত্র জমা দিয়ে দেশের মূল কাঠামোতে ফিরে এসেছেন। ইতিহাসে এটি বিরল ঘটনা হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে থাকবে। শান্তিচুক্তির অনেক ধারা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনার করা এই শান্তিচুক্তি তাঁকে বিশ্বনেতার মর্যাদা দিয়েছে। এথনিক কমিউনিটিকে রক্ষা করার এই প্রয়াস আজ রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। এতো গেল তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার একটি দিকমাত্র।

শেখ হাসিনার নিরলস পরিশ্রমে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি তৎপর। সামরিক শাসনামলের সকল কালাকানুন বাতিল করে সংবিধান সংশোধন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং যুদ্ধাপরাধী বিচারের কার্যক্রম শুরু করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত তিনিই করেছেন। সারাবিশ্ব যখন মৌলবাদের উত্থানে আতঙ্কিত, ধর্মের নামে সহিংসতা যখন খুবলে নিচ্ছে মানবিকতা তখন তিনি দৃঢ়তার সাথে এককভাবে দাঁড়িয়েছেন এর বিরুদ্ধে। জাতিকে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি, যা উদার ধর্মদর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত তাকে আরও শক্তিশালী করেছেন। একক এবং কঠোর হাতে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে লড়ছেন সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে।

আজ দেশ এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। উদ্ভট উটের পিঠে চড়ে পেছনের দিকে চলছিল যে বাংলাদেশ তা আজ এশিয়াতে ক্রমাগত ক্রমোত্থিত বাঘের মত ক্ষিপ্রতার সাথে সম্মুখগামী। কৃষিক্ষেত্রে, বিদ্যুত ক্ষেত্রে, শিক্ষার অগ্রগতিতে বাংলাদেশ নিজের শক্ত ভিত তৈরি করতে পেরেছে তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে। তিনি হয়ে উঠেছেন বঙ্গপ্রাণ। বাঙালির আকাক্ষা, বাঙালির প্রাণের সজীবতা, বাংলাদেশের মৌল চরিত্রকে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শেখ হাসিনা আপোষহীন। দেশের অগ্রগতিকে ব্যাহত করার জন্য সরকার বিরোধী, বিশেষ করে মৌলবাদের দোসর এবং বিএনপি যে বাধার সৃষ্টি করেছে সেব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর এই সাফল্য ঈর্ষণীয়। ৬ শতাংশ জিডিপির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতিবিদেরা এই বিষয়টি আরও ভালো করে বুঝিয়ে দিতে পারবেন। বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় সরকারের সেবা পৌঁছে গেছে। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মানুষের জীবনে স্বস্তি নেমে এসেছে।

চাকরির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। পোশাক খাত থেকে সর্বোচ্চ আয় সম্ভব হয়েছে। দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই খাত থেকে ২০ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার আয় সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিশু স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগত উন্নয়ন এবং নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে শেখ হাসিনার সরকার। এই উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের সংস্কৃতির বিকাশ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে আধুনিক যোগাযোগ পদ্ধতির দ্রত প্রসারের কারণে দেশের মানুষ বহির্বিশ্বের সাম্প্রতিক ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত থাকতে পারছে।

জোট সরকারের আমলে বিএনপি জামায়াত দেশের সেক্যুলার সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্য নানাভাবে সক্রিয় ছিল। বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে বাঙালিত্বের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে ধর্মীয় উন্মাদনাকে জাগিয়ে তুলেছে। ফলে দেশে যাত্রা, লোকসঙ্গীত কিংবা বিনোদনের মাধ্যমগুলোকে ধর্মের নামে আক্রমণ করেছে তারা। এই গোষ্ঠী ভালো করেই জানে বাঙালির মূল যে সংস্কৃতি, তার ভেতরের শক্তি বাঙালিকে শক্তিশালী করেছে। এর থেকে আলাদা করতে পারলেই প্রগতিশীল সংস্কৃতিমনা জনগণকে হীনবল করা সম্ভব।

শেখ হাসিনার সরকার বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের জন্য সব সময়েই সচেষ্ট। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলসহ বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম যাত্রাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যাত্রা উন্নয়ন কমিটি গঠন করেছে। উল্লেখ্য, যাত্রাশিল্পের উপর প্রথম আঘাত হেনেছিলেন জিয়াউর রহমান। এই শিল্পে সমাজ শিক্ষা ও বিনোদনের যে সম্মিলন রয়েছে তা বিযুক্ত করার জন্য যাত্রায় সুকৌশলে অশ্লীলতার আমদানী ঘটে জিয়াউর রহমানের সরকারের সময়। এর চূড়ান্ত ধ্বংস সাধিত হয় খালেদা জিয়ার আমলে। বাংলাদেশে পঁচাত্তর পরবর্তী জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে যাত্রার উপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণাকে অস্বীকার করে বাঙালির সংস্কৃতির জাগরণকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে সামরিক সরকার। তাদের বিশ্বাস ছিল যে মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল না। সেটি  ছিল বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতির উত্থানের বিশাল অভিযাত্রা। আর তাই তারা পাকিস্তানী শাসকদের মতই প্রথম আঘাত হানে বাঙালি জাতির সংস্কৃতির শেকড়ে। এসময়ে পৃষ্ঠপোষকতাবিহীন যাত্রা ক্রমাগত ‘কমিটমেন্ট’ এর জায়গা থেকে সরে এসে কোন মতে টিকে থাকার চেষ্টায় রত হয়।

কিছু মুনাফালোভী ভূঁইফোড় দল সরকারের পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ খ্রীষ্টাব্দে অশ্লীল নৃত্যশিল্পীদের ‘প্রিন্সেস’ আখ্যা দিয়ে যাত্রার মঞ্চে উপস্থাপন করে। এরকম যাত্রার প্রদর্শনী সে সময়ের শিল্পকলা একাডেমীতেও হয়েছে। যাত্রার সঙ্গে পচাত্তর পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সরকারের বিজাতীয় আচরণ এবং বাণিজ্যিক মোহের কাছে কতিপয় যাত্রাদল এবং আয়োজকরা পরাস্ত হয়ে যখন অপ্রয়োজনীয়ভাবে খিস্তি খেউড় ধরনের অশ্লীল নৃত্যের প্রচলন করলো তখোন যাত্রার বৃহত্তর দর্শক অংশ সরে যায়। এরপর আসে মড়ার উপর খাড়ার ঘা এর মত এরশাদ সরকার কর্তৃক যাত্রাবন্ধের নিষেধাজ্ঞা।

১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর যাত্রা প্রদর্শনী সাময়িক বন্ধের প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করে এরশাদ সরকার। অশ্লীলতা এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা-অশান্তির অজুহাতে যাত্রা বন্ধের জন্য সরকার যতোটা উৎসাহী ছিল এই শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে ততোটা আগ্রহ দেখায়নি। ‘৭৫ পরবর্তী সরকার, বিশেষ করে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার শুধু যাত্রাই নয়, নাটকের উপরও প্রমোদকর এবং সেন্সরের কড়াকড়ি আরোপিত করে। মধ্য আশির দশক থেকেই দেশে যাত্রানুষ্ঠানের প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা, মহল বিশেষের আকস্মিক হামলা এবং বিকৃত রুচির আয়োজক কর্তৃক সরকারে পৃষ্ঠপোষকতায় যাত্রায় অপসংস্কৃতি চালু করা যাত্রাকে ক্রমশ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

এরপরেই যাত্রার উপর সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত নেমে আসে ১৯৯১ সনের বিএনপি শাসনামলে। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর ক্ষমতা গ্রহণের সাত মাসের মাথায় যাত্রার ভরা মওসুমে যাত্রা বন্ধের আদেশ জারি করে বিএনপি সরকার। এই আদেশের ফলে গ্রামগঞ্জে যাত্রা প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যায়, ব্যাপক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় যাত্রাশিল্পে। যাত্রা মালিকদের লগ্নীকৃত টাকা উঠে না আসার কারণে বহু যাত্রা মালিক প্রায় পথে বসে যান। হাজার হাজার যাত্রাশিল্পী পরিবারের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নেমে আসে মারাত্মক দুর্ভোগ। একই সরকার এমত আরও অনেক সংস্কৃতি বিধ্বংসী আদেশ জারি করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালের সামরিক সরকারের গণতান্ত্রিক আবরণ নিয়ে ক্ষমতায় আসীন বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার পূর্ববর্তী কালের সামরিক শাসকদের মতই বাঙালি সংস্কৃতির শেকড়ে আঘাত হানে। সেই আঘাত কাটিয়ে ওঠে বাংলাদেশের সেক্যুলার সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে শেখ হাসিনার সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সংস্কৃতি বান্ধব সরকার বলে পরিচিতি পেয়েছে দেশে ও বহির্বিশ্বে।

বাংলাদেশের সেক্যুলার সংস্কৃতি বিধ্বংসী আক্রমণের অবসান ঘটে শেখ হাসিনার আমলে। বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতির উত্থান ঘটে এই সময়ে। বাঙালি ক্রমাগত ফিরে যেতে থাকে চিরন্তন সংস্কৃতির শেকেড়ের দিকে। লোকশিল্পীদের কণ্ঠে আবার উঠে এসেছে হারানো গান। এক নির্ভার অভিযাত্রার ভেতর দিয়ে জনগণের এই অভিগমন বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে টেকসই মাত্রা দিয়েছে। এর আরও প্রসার ঘটলে বাঙালি সকল প্রকার মৌলবাদী অভিঘাতের বিপক্ষে দাঁড়াবে আপন শক্তিতে। আর মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা পালাবে নিজের বিবরে। আর এখানেই শেখ হাসিনাকে ভয় পায় এই অপশক্তি। তারা জানে শেখ হাসিনার এই প্রবল উত্থান, যা গণমানুষের ভালোবাসার উপর প্রতিষ্ঠিত তাকে প্রতিহত করা না গেলে তাদের অস্তিত্ব টিকবে না। কিন্তু তাঁরা জানেনা যে, শেখ হাসিনার মূল শক্তি জনগণ এবং জনগণের ভালোবাসার উপর প্রতিষ্ঠিত একজন সত্যিকারের জননেত্রীর কোন ক্ষতি তারা করতে পারবে না। এজন্যইতো একটি গ্রামের চায়ের দোকানদার অন্তর থেকে বলে উঠতে পারে, আল্লাহ যেন শেখের মাইয়ারে বাঁচাইয়া রাখে। হে বাঁচলেই আমরা বাঁচি।’

বিকেলের অস্তায়মান সূর্যের লাল আভা পশ্চিম আকাশে। আমি পিচঢালা পথে, যা আগে ছিল হতশ্রী এক রাস্তা, যেতে যেতে ভাবি, এইতো একজন জননেত্রীর প্রকৃত প্রতিকৃতি, যা জনগণের ভালোবাসার রঙে রেখায় রচিত। বিকেলের লাল আলো আভাময় পশ্চিম আকাশে। আর আমি দেখি জনগণের জন্য, কেবল গণমানুষের ভালোবাসা নিয়ে আভাময় হয়ে উঠেছেন শেখ হাসিনা, একজন যথার্থ জননেত্রী, যিনি নিজেকে এবং দেশকে তুলে দিয়েছেন মর্যাদার আভাময় আলোর রথে।

লেখক : অধ্যাপক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।