রাজনৈতিক অস্থিরতার মীমাংসা কীভাবে
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রশ্ন এবং সংশ্লিষ্ট অনিশ্চয়তা নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে, যেখানে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি, সরকারের উদ্যোগ এবং জনগণের প্রত্যাশা জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ২০২৫ সালের শেষাংশ কিংবা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে এই সময়সীমা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভক্তি লক্ষণীয়। বিএনপি ও বামপন্থি দলগুলো নির্বাচন আয়োজনের জন্য একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপের দাবি তুলছে। তারা মনে করে, নির্দিষ্ট সময়সীমা ও যৌক্তিক পরিকল্পনা ছাড়া সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।
নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় সংশ্লিষ্ট দলগুলো হতাশা প্রকাশ করেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছেন, দীর্ঘ সংস্কার প্রক্রিয়া ও সময়ক্ষেপণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। তাদের দাবি, এই দীর্ঘসূত্রিতা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে এবং জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিএনপি বিশ্বাস করে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন সম্পন্ন করা উচিত, কারণ এর মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং নতুন নেতৃত্ব সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
বামপন্থি দলগুলোর নেতারা মনে করেন, ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। তাদের যুক্তি, দেরি হলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, যা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, সংস্কারের দোহাই দিয়ে বিলম্ব করা উচিত হবে না। জনগণ জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক সরকার চায়।
অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য কিছু দল মনে করে, সংস্কার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, তবে এটি নির্বাচনের সময়কে প্রভাবিত করা উচিত নয়। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, যাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা হ্রাস পায়।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ঐক্যের অভাব ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। নির্বাচন নিয়ে সময় ক্ষেপণ এবং সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোর সমাধানে দেরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা এবং ঐকমত্য স্থাপন না হলে ভবিষ্যতে সংকট আরও তীব্র হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, জনগণকে আস্থায় এনে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি কার্যকর এবং গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ নির্ধারণ করা যেতে পারে। এমনটি করতে পারলে দেশের ভোটাররা নির্বাচনে সম্পৃক্ত হবে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্র কিংবা অভ্যন্তরীণ সংঘাতের আশঙ্কাও হ্রাস পাবে।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক বলে পরিচিত জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারীসহ অনেকের সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য থেকে এটা অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে। দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করতে ব্যর্থ হলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যাবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত করা। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ বহু বছর ধরে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা করে আসছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যারা গত কয়েকটি নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি, তাদের আশা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক সরকার গঠন হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাজনৈতিক অসন্তোষ বা দ্বন্দ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই নির্বাচন বিষয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নিলে রাজনৈতিক সংকটও আরো দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, সংকট নিরসনে উভয় পক্ষই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে ঠিক কতটা প্রস্তুত?
নির্বাচন-সংক্রান্ত সংকট সমাধানে কেবল রোডম্যাপ নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দায়িত্বশীলতা। রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে বসতে হবে এবং একটি বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ততই হুমকির মুখে পড়বে। একটি গণতান্ত্রিক জাতি হিসেবে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার জন্য, জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠায় এখনই ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমাদের সবারই জানা। ক্ষমতায় আছে একটি অরাজনৈতিক সরকার। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। সেজন্যই জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে তুমুল আলোচনা। বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলোর ২১ ডিসেম্বরের বৈঠকে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, কোনোক্রমেই ২০২৬ সালে নয়, ২০২৫ সালের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি ও তার মিত্রদের এই দাবি স্পষ্টতই একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক সংকেত।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন অরাজনৈতিক সরকার এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতপার্থক্য নতুন নয়। যারা ক্ষমতায় আছেন তারা সত্যি সত্যি নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে চান কি না, সেটা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ আছে। সংস্কারের নামে কালক্ষেপণের কৌশল নিয়েও সমালোচনা শুরু হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন দিয়ে নিজের কাজে ফিরে যাওয়ার কথা বললেও তার নিয়োগকর্তা ছাত্র সমন্বয়করা কী চাচ্ছেন তা কিন্তু অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। জাতীয় নাগরিক কমিটি তো স্পষ্ট করেই বলেছে যে তারা আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচারের আগে কোনো নির্বাচন চায় না বা নির্বাচন হতে দেবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার কবে শেষ হবে সেটা কি কেউ বলতে পারে? আমাদের দেশের বিচার প্রক্রিয়া খুব সহজে শেষ হয় না। শেখ হাসিনার বিচার শেষ হতে যদি ৫/১০ বছর লাগে, তাহলে ততদিন কি অন্তর্বর্তী সরকারই ক্ষমতায় থাকবে?
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হলো দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের এখন সময় ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু বিএনপির তো বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। বিএনপি তো প্রায় ক্ষমতায় এসেই গেছে বলে মনে করছে। তাই নির্বাচনের জন্য এই দল আর সময় নষ্ট করতে চায় না। ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো করবে না খারাপ করবে, সেটা পরের ব্যাপার।
তবে বিএনপি এবং সমমনা ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং লেবার পার্টি সবাই আগামী নির্বাচনের সময়কাল নিয়ে একমত হয়েছে। তারা স্পষ্টভাবে বলেছে, ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। ২০২৫ সালের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি উঠেছে সব পক্ষ থেকে।
দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা চলতে থাকলে অর্থনীতি ও জনজীবনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়াই বড় স্বাভাবিক। জিনিসপত্রের দাম কমছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। দেশজুড়ে নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা যাতে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে না ওঠে তার জন্যও একটি কার্যকর নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন বলে অনেকেই মনে করেন।
বিএনপির পাশাপাশি তাদের সমমনা দলগুলোর অভিযোগ হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন সম্পর্কে যে-সব বিবৃতি এসেছে, সেগুলো অস্পষ্ট। এই অবস্থায় বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা কীভাবে নির্বাচন আদায়ের আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেবে, তা-ও খোলাসা করে বলেনি। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে ফের আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি মাঠে নামবে বলে জানা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিএনপি সফল হতে না পারলেও ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে কাবু করতে বিএনপিকে বেশি বেগ পেতে হবে না। ড. ইউনূসের পেছনে দেশের অভ্যন্তরে সাংগঠনিক সমর্থক কম।
এরমধ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব নিয়েও সন্দেহ বাড়ছে। তারা একাত্তরের জায়গায় ২০২৪-এর বিজয়কে প্রতিস্থাপন করতে চাইলে বিভ্রান্তি বাড়তেই থাকবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২২ ডিসেম্বর পঞ্চগড়ের এক দলীয় জনসভায় বলেছেন, ‘কেউ কেউ বলেন, একাত্তর ভুলে যাবে। একাত্তর আমরা ভুলতে পারি না। একাত্তরে আমাদের একটা স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছে। আমি আমার নিজেকে চিনতে পেরেছি একাত্তর সালে। আমরা আমাদের জন্য একটা ভূখণ্ড তৈরি করতে পেরেছি।’ একাত্তর প্রশ্নে বিএনপির দৃঢ় অবস্থান রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে সহায়ক হতে পারে।
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাজনৈতিক অসন্তোষ বা দ্বন্দ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই নির্বাচন বিষয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নিলে রাজনৈতিক সংকটও আরো দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, সংকট নিরসনে উভয় পক্ষই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে ঠিক কতটা প্রস্তুত?
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।
এইচআর/জেআইএম