অর্থনীতির শ্বেতপত্রের ভয়ঙ্কর ৩৮২ পৃষ্ঠা
চোর ধরা ও টাকা উদ্ধার করা এবং চোরদের শাস্তি প্রদানের দায়িত্ব তাদের নয়, সরকারের। এই বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অর্থনীতিবিদরা যাকে ভয়ঙ্কর এক প্রতিবেদন বলে আখ্যা দিয়েছেন।
প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে ১ ডিসেম্বর জমা দিয়েছেন। এ কমিটি গঠন হয়েছিল ২৮ আগস্ট এবং কমিটির প্রধান করা হয়েছিল ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে। পরে ড. দেবপ্রিয় আরো ১১ জনকে কমিটিভুক্ত করেন। কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট প্রণয়ন করে তা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছে জমা দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো কাজী ইকবাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম. তামিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি ও বেসরকারি গবেষণা-প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম আরিফা সিদ্দিকী।
সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল হিসেবে যে রিপোর্টটি অবশেষে ড. ইউনূসের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেয়া হয়েছে তার পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৮২, অধ্যায় সংখ্যা পাঁচটি (সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক)। এ পাঁচটি অধ্যায়ের পরিচ্ছেদ সংখ্যা (৫+৭+৬+৫)=২৩টি। রিপোর্টটি যথেষ্ট পরিশ্রম করে অতি অল্প সময়ে প্রণয়নের জন্য ড. দেবপ্রিয় ও তার টিমকে অবশ্যই আমাদের অভিনন্দন জানাতে হবে।
গত তিন মাস তারা ১৮টি কমিটি মিটিং, ২১টি পলিসি কনসালটেশন এবং তিনটি জনশুনানি সম্পন্ন করেছেন বলে জানিয়েছেন। দেশের সচেতন মানুষের কড়া নজর ছিল এই শ্বেতপত্রের দিকে।
ড. দেবপ্রিয় কমিটি স্বৈরাচারের আমলে মোট চুরির বা পাচারের বিশাল সামষ্টিক পরিমাণগুলো সামগ্রিকভাবে ও ক্ষেত্র বিশেষে রিপোর্টে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করেছে। এ রিপোর্টে কিছু সম্পাদনা (ভাষা ও স্টাইল) এখনও বাকি, তাই এটাকে খসড়া বলা হয়েছে। ৯০ দিন পর তা চূড়ান্ত করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
এছাড়া জনসমক্ষে শিগগিরই ‘উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ’ নামে আরেকটি অনুষঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশের প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। ড. ইউনূস ড. দেবপ্রিয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন যে রিপোর্টটি একটি গ্রাউন্ড ব্রেকিং ওয়ার্ক হয়েছে এবং এটি স্কুলকলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত, যেন তারা এখান থেকে শিক্ষালাভ করতে পারে।
প্রথমেই রিপোর্ট থেকে যে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি সব পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে সেটি হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের রাজত্বকালে (২০০৯-২৩) প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০০৯-২৩ সালে পাচারকৃত এ ডলারের পরিমাণ মোট নিট বৈদেশিক সাহায্য ও নিট বৈদেশিক বিনিয়োগের দ্বিগুণের বেশি। এছাড়া সম্ভাব্য যে কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে তার অর্ধেকটা দিয়েই শিক্ষা ব্যয় দ্বিগুণ ও স্বাস্থ্য ব্যয় তিন গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো।
রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও দেরি করার জন্য বৃহদায়তন অবকাঠামো ব্যয়ের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে। অন্য সব কারণ মিলিয়ে ১৫ বছরে এডিপি বাবদ যে ৬০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে তাতে অপচয় ও দুর্নীতির জন্য ক্ষতির পরিমাণ ১৫ বছরে ১৪-২৪ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। অর্থাৎ ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ২০২৪ সালের জুন নাগাদ যে বিপুল পরিমাণ বিপন্ন সম্পদ জমা হয়েছে, তা যদি বিপন্ন না হয়ে ব্যবহারযোগ্য হতো, তাহলে তা দিয়ে ১৪টি ঢাকা মেট্রোরেল অথবা ২৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হতো বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া গত দশকে বিদেশে প্রবাসী শ্রমিক প্রেরণের জন্য যে-সব রিক্রুটিং এজেন্সি হুন্ডি ব্যবহার করে ভিসা ক্রয় করেছেন, সেখানে বাইরে চলে গেছে প্রায় ১৩ দশমিক ৪ লাখ কোটি টাকা। রিপোর্টের মতে, এ টাকা দিয়ে উত্তরা-মতিঝিল রুটে চলাচলের জন্য ছয়টি মেট্রোরেল তৈরি করা সম্ভব হতো।
সামাজিক সুরক্ষা খাতে অনেক বরাদ্দ অদরিদ্ররা পেয়েছেন বলে রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। ২০২২ সালে এ অবৈধ প্রাপ্তি বা বিতরণের হার ছিল ৭০ শতাংশ। দারিদ্র্য হারের হ্রাস নিয়ে যে দাবি বিগত সরকার করত সে ব্যাপারে বলা হয়েছে যে প্রায় দুই কোটি লোক সম্প্রতি একদম দারিদ্র্যের কিনারায় উপনীত হয়েছিল, এ অর্থে যে মাত্র দু-দিন কাজে না গেলেই তারা দারিদ্র্যের কাতারে নেমে আসতে বাধ্য হবে।
রিপোর্টে দুর্নীতির নানা প্রকারভেদ উল্লেখ করা হয়েছে। যা সত্যিই শিক্ষণীয়। এতসব নানামুখী দুর্নীতির মধ্যে চারটি খাত ছিল দুর্নীতির মূল চক্র। এগুলো হলো ব্যাংক খাত, ভৌত অবকাঠামো খাত, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত এবং আইসিটি খাত। সর্বব্যাপী দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপের এ অসম্পূর্ণ তালিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বেরিয়ে এসে জরুরিভাবে আমাদের পুরো ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন, যাতে সর্বত্র শক্তিশালী জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে, সততা ফিরে আসবে এবং অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তৈরি হবে। যা দেশবাসী তথা আমাদের কামনা। দেখা যাচ্ছে, অনিয়ম যারা করেছে তারাই নিয়ম তৈরি করেছিল, নিজেদের সুবিধা মত।
আমরা দেখেছি একটা প্রকল্প হাতে নিয়ে চলমান অবস্থায় দফায় দফায় তার খরচ বাড়ানো হয়েছে। এই শ্বেতপত্রের মাধ্যমে সেই খরচ বাড়ানোর রহস্য বেরিয়ে এসেছে। সাধারণ মানুষ সত্যিই খুব অবাক হয়েছে। এখন অর্থনৈতিক লুটপাটের সঙ্গী অসৎ আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী ও অসৎ পুঁজিবাদীদের এই ত্রিভুজ ক্ষমতা কাঠামো চিরতরে ভেঙে দিতে হবে। এই সর্বগ্রাসী স্বজনতোষণমূলক পুঁজিবাদকে চিহ্নিত করতে হবে। নইলে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা কোনো দিনই পূরণ হবে না। এটাকে নির্মূল করার এখনই সময়।
আমরা সমস্যা যতখানি বিস্তৃত ও গভীর ভেবেছিলাম আসলে তা তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ও গভীর। আমাদের একান্ত উপলব্ধি হচ্ছে যে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ছাড়া ও বেআইনিভাবে অপরাধকে রেহাই দেয়া ছাড়া এ বিশাল লুটপাট মোটেও সম্ভব ছিল না। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করে দিয়েছে। কিছু লোককে বিচারের অধীনে নিয়ে এসেছে এবং সব সরকারি কর্মচারী এবং ক্ষমতাবানদের আয় ও সম্পদ বিবরণী দাখিলের ব্যবস্থা করেছে। এগুলো সবই সঠিক দিকে প্রারম্ভিক পদক্ষেপ। তবে এ অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দরকার হবে একটি আপসহীন রাজনৈতিক অঙ্গীকার, যা সমস্যাকে সরাসরি মাথায় আঘাত করবে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস