ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন কতটা যৌক্তিক?

ডা. সাদী মাসুদ আল তুরাব
ডা. সাদী মাসুদ আল তুরাব ডা. সাদী মাসুদ আল তুরাব , চিকিৎসক
প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশে ডিএমএফ (Diploma in Medical Faculty) ডিগ্রিধারীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত। তারা সাধারণত কোন চিকিৎসকের অধীনে কাজ করে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসককে সহযোগিতার অংশ হিসেবে প্রাথমিক চিকিৎসা, এবং প্রয়োজনে রোগীকে উচ্চতর চিকিৎসার জন্য রেফার করেন।

বাংলাদেশে ডিএমএফ (Diploma in Medical Faculty) ডিগ্রিধারীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত। তারা সাধারণত কোন চিকিৎসকের অধীনে কাজ করে থাকেন।  ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসককে সহযোগিতার অংশ হিসেবে  প্রাথমিক চিকিৎসা, এবং প্রয়োজনে রোগীকে উচ্চতর চিকিৎসার জন্য রেফার করেন।
ডিএমএফ ডিগ্রির ইতিহাসডিএমএফ ডিগ্রির উৎপত্তি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে। ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সরকার "Subordinate Medical Services" চালু করে, যা পরবর্তীতে ডিএমএফ ডিগ্রির ভিত্তি স্থাপন করে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরেও এই ডিগ্রির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়। ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত ডিএমএফ ডাক্তারদের গুরুত্ব ছিল গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায়। তবে ১৯৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশে এমবিবিএস ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ার কারণে ডিএমএফ কোর্স    প্রাসঙ্গিকতা অনেকাংশে কমে যায়। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ভাবে ম্যাটস (MATS)  স্কুল চালু থাকায় এখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ডিএমএফ ডিগ্রিধারী পেশাজীবী তৈরি হচ্ছে। পর্যাপ্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলগুলো (MATS) থেকে প্রতিবছর  কতজন ভর্তি হচ্ছে,  তার প্রকৃত সংখ্যাটা জানা কঠিন। 
বিশ্বের অন্যান্য দেশে ডিএমএফ এর সমতুল্য পেশাজীবী  ও এর বাস্তবতাচিকিৎসকের বাইরেও বিভিন্ন দেশে ডিএমএফ বা সমতুল্য পেশাজীবীদের প্রয়োজনীয়তার কারণ ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক বাস্তবতার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

সংক্ষেপে কারণগুলো নিম্নরূপঅতীতের বাস্তবতা

1. চিকিৎসকদের সংখ্যা দীর্ঘদিন ধরেই উন্নয়নশীল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অপ্রতুল। এর ফলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিশেষ প্রশিক্ষিত কর্মী প্রয়োজন হয়ে ওঠে।
2. অতীতে, মহামারি বা স্থানীয় রোগের বিস্তার ঠেকাতে সহজলভ্য ও প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। যেমন, কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা জরুরি ছিল।
3. প্রশিক্ষিত সহায়ক পেশাজীবীরা চিকিৎসকদের তুলনায় কম ব্যয়ে সেবা দিতে পারে। এটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে সহায়ক ছিল।
4. চিকিৎসকদের দীর্ঘ প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া এবং উচ্চ ব্যয় স্বল্পমেয়াদি সমাধানের প্রয়োজন সৃষ্টি করেছিল। তাই কম সময়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বর্তমান বাস্তবতা

দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার কারণে প্রতি রোগীর জন্য চিকিৎসকের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। এই শূন্যতা পূরণে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাজীবীরা ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।  আমরা যারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা দিয়েছি,  অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের চিকিৎসক সহযোগীর সাহায্য প্রয়োজন ছিল। তাই সীমিত পরিসরে চিকিৎসক সহযোগী এখনো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন হতে পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিএমএফ-এর সমতুল্য পেশাজীবী রয়েছেন, যেমন:
1. ভারত: "Registered Medical Practitioners (RMP)" বা "Diploma in Rural Health Care (DRHC)"।
2. পাকিস্তান: "Licensed Medical Practitioners (LMP)"।
3. যুক্তরাজ্য: "Assistant Practitioners" বা "Nurse Practitioners"।
4. যুক্তরাষ্ট্র: "Physician Assistants (PA)" বা "Nurse Practitioners (NP)"।
5. অস্ট্রেলিয়া: "Rural Medical Practitioners"।

প্রতিটি দেশে এই পেশাজীবীদের জন্য পৃথক প্রশিক্ষণ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে,  সকল ক্ষেত্রেই তাদের মূল ভূমিকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। বাস্তবতা হচ্ছে কোন দেশেই এই চিকিৎসক সহযোগীরা ডাক্তারের সমমর্যাদা সম্পন্ন নয়, কিংবা পৃথিবীর কোনো দেশেই এই পেশাজীবীরা ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারেন না।
বাংলাদেশে স্যাকমো হিসেবে কারা পরিচিত? বাংলাদেশে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার কিংবা স্যাকমো (Sub Assistant Community Medical Officer) পদটি মূলত স্বাস্থ্য মন্ত্রণলায়ের অধীন  ১১ তম গ্রেডের পদ। মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (MATS) থেকে ডিপ্লোমা ইনস মেডিকেল ফ্যাকাল্টি (DMF) সম্পন্ন করার পর সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারি এই পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।  নিয়োগের পর মূলত বিভিন্ন ইউনিয়ন সাব সেন্টার ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে  চিকিৎসক সহযোগী হিসেবে সেবা দিয়ে থাকেন। তবে ব্যাপকভাবে সকল ডিএমএফ ডিগ্রিধারী স্যাকমো  হিসেবে পরিচিত। 

ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে চাওয়ায়  স্বাস্থ্য  খাতের সংকট ও এর সম্ভাব্য ভয়াবহতাবাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন-২০১০ এর ২২তম ধারা অনুযায়ী এমবিবিএস এবং বিডিএস ব্যতীত কেউ নামের আগে ডাক্তার  লিখতে পারবে না। এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে স্যাকমোদের একাংশ পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে (নং–২৭৩০/২০১৩) রিট করা করেছিল। কিন্তু দীর্ঘ ১১ বছর ধরে ৬৭ বার কার্যতালিকায় আসার পরেও এই রিটের নিষ্পত্তি হয়নি।  এ নিয়ে চিকিৎসক সমাজে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। কোনো এক অজানা কারণে,  এই মামলাটির চূড়ান্ত রায় এখনো দেওয়া হয়নি।  জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক  চিকিৎসা সংক্রান্ত মূলনীতি অগ্রাহ্য করে স্যাকমোরা যদি ডাক্তার পদবি ব্যবহারের সুযোগ পায় তাহলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার  শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এমবিবিএস ও বিডিএস চিকিৎসক ব্যতীত বাংলাদেশে যদি অন্য কোন পেশাজীবী  চিকিৎসক পদবি ব্যবহারের সুযোগ পায়, তাহলে বেশ কয়েকটি গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। প্রকৃত পক্ষে এমন অযৌক্তিক দাবির মাধ্যমে দেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সেবা প্রবল ভাবে ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা দেখে দিয়েছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলো হলো:

১. রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ত্রুটি
● ডাক্তার পদবি ব্যবহারকারী ব্যক্তির যথাযথ মেডিক্যাল শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ না থাকলে সঠিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা প্রদান সম্ভব নাও হতে পারে।
● ভুল চিকিৎসার ফলে রোগীর স্বাস্থ্যের অবনতি, জটিলতা, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়তে পারে।

২. জনস্বাস্থ্যের হুমকি
● অপারদর্শী চিকিৎসা বা ভুয়া চিকিৎসকের পরামর্শে রোগীরা ভুল ওষুধ সেবন করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক।
● পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের অভাবে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে পারে, যা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের (AMR) ঝুঁকি বাড়ায়।

৩. বিশ্বাস ও আস্থার সংকট
● ভুল চিকিৎসা বা প্রতারণার অভিজ্ঞতার কারণে রোগীদের প্রকৃত ডাক্তারদের প্রতি আস্থা কমে যেতে পারে।
● স্বাস্থ্যসেবার সামগ্রিক মান প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

৪. আইনি ও নৈতিক জটিলতা
● ভুয়া পদবি ব্যবহারকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে সময় লাগে, এবং এতে রোগীদের বিচারপ্রাপ্তি বিলম্বিত হয়।
● স্বাস্থ্যসেবা খাতের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।

৫. প্রকৃত ডাক্তারদের পেশাগত মানহানি
● প্রকৃত ডাক্তারদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে, কারণ রোগীরা তাদের ভুয়া ডাক্তারদের সঙ্গে এক কাতারে বিবেচনা করতে পারে।
● প্রকৃত ডাক্তারদের পেশাগত সম্মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৬. স্বাস্থ্যসেবার মানের অবনতি
● ভুল পদবি ব্যবহারকারীরা সঠিক চিকিৎসা না দেওয়ায় পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান নষ্ট হতে পারে। এছাড়াও ডাক্তার পদবি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি উচ্চপদে অদক্ষ ব্যক্তিদের পদায়নের ঝুঁকি তৈরি হবে। চরম নৈরাজ্যের শিকার হতে পারে সমগ্র স্বাস্থ্য খাত। সামগ্রিকভাবে সেবার মান নিয়ে রোগীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে।

৭. জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যর্থতা
● বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও অপারদর্শী ব্যক্তি চিকিৎসা করলে রোগটি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। যার ফলে রোগীর মূল্যবান সময় নষ্ট হয় এবং দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হইয়ে যায়।

৮. স্বাস্থ্য খাতে নৈতিক অবক্ষয়
● ভুয়া পদবি ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্যসেবায় নৈতিকতার অভাব দেখা দেয়।
● স্বাস্থ্য খাত একটি প্রতারণামূলক ব্যবসায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।প্রতিকারএই সমস্যাগুলোর সমাধানে কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন:
● প্রথমত, বিবদমান রিটের যৌক্তিক নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।
● কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন: ভুয়া ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা এবং পেশাগত শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
● পেশাজীবীদের স্পষ্ট পরিচিতি: ডাক্তার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা পেশাজীবীদের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য নির্ধারণ।
● জনসচেতনতা বৃদ্ধি: রোগীদের প্রকৃত ডাক্তার শনাক্ত করার পদ্ধতি শেখানো।
● প্রতারণার বিরুদ্ধে জনমত গঠন: ভুয়া পদবি ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন।সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এই প্রবণতা পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং ১৮ কোটি মানুষের জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

লেখক: চিকিৎসক। 

এইচআর/এমএস

এমবিবিএস ও বিডিএস চিকিৎসক ব্যতীত বাংলাদেশে যদি অন্য কোন পেশাজীবী চিকিৎসক পদবি ব্যবহারের সুযোগ পায়, তাহলে বেশ কয়েকটি গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। প্রকৃত পক্ষে এমন অযৌক্তিক দাবির মাধ্যমে দেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সেবা প্রবল ভাবে ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা দেখে দিয়েছে। সকাল দশটায় আপ হবে, লিংক শেয়ার ট্যাগ হবে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।