শিক্ষাপ্রদান এবং শিক্ষা গ্রহণে সংস্কৃতির ভূমিকা
শিক্ষা সামাজিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং এটি সংস্কৃতির প্রভাব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। সংস্কৃতি শিক্ষার গঠন এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত তার নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, যেখানে শিক্ষাদানের লক্ষ্য, পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থীদের আচরণে সেই সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিকভাবে একটি সমৃদ্ধ এবং ঐতিহ্যবাহী দেশ, যেখানে শিক্ষা কেবল অ্যাকাডেমিক অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত।
সংস্কৃতির সার্বিক ভূমিকা
সংস্কৃতি একটি সমাজের সামাজিক আচরণ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং চর্চার সমাহার। এটি শিক্ষা গ্রহণ ও পাঠদান পদ্ধতির অভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং পদ্ধতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। সংস্কৃতি শিক্ষার কন্টেক্সট তৈরি করে, যা শিক্ষার উদ্দেশ্য, পদ্ধতি এবং ফলাফল নির্ধারণ করে। পারিপার্শ্বিকতা শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর মানসিকতা, শেখার প্রণালি এবং শিক্ষার অভিজ্ঞতা প্রভাবিত করে। জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কৃতির প্রভাব খুবই দৃশ্যমান। জাপানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিষ্টাচার এবং শ্রদ্ধাবোধের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে শিক্ষক ও সহপাঠীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, যা তাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অংশ। জাপানি শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ, যা ছাত্রদের আন্তরিকতা, পরিশ্রম এবং সহযোগিতা শিখানোর দিকে মনোযোগ দেয়।
ইউরোপীয় দেশগুলোতে শিক্ষার পদ্ধতি সাধারণত জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে পরিচালিত হয়, কিন্তু প্রতিটি দেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এই পদ্ধতিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হয়। ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং জাতীয় পরিচয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশের শিক্ষা পদ্ধতিতে স্থানীয় সংস্কৃতি, ভাষা এবং ঐতিহ্যের প্রতিফলন দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্সে ভাষার প্রতি গুরুত্ব এবং জার্মানিতে পেশাগত প্রশিক্ষণ এই সাংস্কৃতিক প্রভাবের অংশ।
সংস্কৃতির বিবেচনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাঠদান পদ্ধতি এবং ক্লাস সেটআপ
১। আমেরিকা
আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় বহু সংস্কৃতির শিক্ষা, বৈচিত্র্য এবং সমন্বয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং জাতিগত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসে, যা তাদের শিক্ষা অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ করে তোলে। এখানে শিক্ষা পদ্ধতি সাধারণত স্বায়ত্তশাসিত, যা বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার পদ্ধতি ও পদ্ধতির সম্ভাবনা প্রদান করে।
• শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান পদ্ধতি: যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান পদ্ধতি মূলত ছাত্রকেন্দ্রিক এবং গঠনমূলক শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে। শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রযুক্তি ব্যবহার, গ্রুপ প্রজেক্ট এবং ক্রিয়েটিভ লার্নিংকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
• শ্রেণিকক্ষের সেটআপ: শ্রেণিকক্ষগুলো সাধারণত আধুনিক ডিজাইনের হয়, যেখানে শিক্ষার্থীদের বসার জন্য টেবিল ও চেয়ার থাকে। প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য স্মার্ট বোর্ড, কম্পিউটার বা প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়।
২. কানাডা:
• শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান পদ্ধতি: কানাডায় শিক্ষাদান পদ্ধতি বেশ উদার এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের ভূমিকা হচ্ছে গাইড বা পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজের গতি এবং আগ্রহ অনুযায়ী বিষয়গুলো শিখতে পারে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা উন্নয়নে সাহায্য করেন। শিক্ষার্থীদের গবেষণা এবং ক্রিয়েটিভ কার্যকলাপে উৎসাহিত করা হয়।
• শ্রেণিকক্ষের সেটআপ: শ্রেণিকক্ষগুলোতে সাধারণত উদার পরিবেশ থাকে, যেখানে শিক্ষার্থীদের বসার জন্য টেবিল ও চেয়ার থাকে। প্রকল্পভিত্তিক কাজ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহযোগিতার প্রচলন রয়েছে।
৩. ইংল্যান্ড:
• শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান পদ্ধতি: ইংল্যান্ডের শিক্ষাদান পদ্ধতি বেশ কাঠামোগত। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা একটি নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে শিক্ষা প্রদান করেন। শিক্ষাদানে সাধারণত লেকচারভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তবে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতামূলক কাজেও যুক্ত করা হয়। শিক্ষার্থীদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য প্রশ্নোত্তর এবং গ্রুপ ডিসকাশন হয় শিক্ষা উপকরণ হিসেবে প্রযুক্তি ব্যবহার এবং গ্রুপ প্রজেক্ট গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সৃজনশীলতা বিকাশের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
• শ্রেণিকক্ষের সেটআপ: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বসার জন্য সুশৃঙ্খল সারিতে টেবিল ও চেয়ার থাকে। শ্রেণিকক্ষে ইন্টারেক্টিভ বোর্ড, প্রজেক্টর এবং টেকসই শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকে।
৪. ফিনল্যান্ড:
• শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান পদ্ধতি: ফিনল্যান্ডে শিক্ষাদান পদ্ধতি খুবই নমনীয় এবং ছাত্রকেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার এবং ক্রিয়েটিভিটি উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রকল্পভিত্তিক কাজ এবং সমবেত শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যে নিযুক্ত করা হয়। এখানে শিক্ষকদের ভূমিকা গাইড হিসেবে কাজ করা।
• শ্রেণিকক্ষের সেটআপ: শ্রেণিকক্ষে টেবিল ও চেয়ারের বিন্যাস বেশ নমনীয় হয়। শিক্ষার্থীরা গ্রুপে বসে বা সারিবদ্ধভাবে বসে কাজ করে। শ্রেণিকক্ষে প্রযুক্তির ব্যবহার প্রচুর। কম্পিউটার, ট্যাবলেট এবং ইন্টারেক্টিভ বোর্ড থাকে।
৫। ভারতঃ
• শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান পদ্ধতি: লেকচারকেন্দ্রিক শিক্ষাদান পদ্ধতি বেশিরভাগ প্রচলিত। ভারতের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান সাধারণত শিক্ষককেন্দ্রিক এবং পরীক্ষাভিত্তিক। শিক্ষকরা প্রথাগতভাবে লেকচার দেন এবং শিক্ষার্থীরা সেগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে ও নোট নেয়। সম্প্রতি প্রজেক্টভিত্তিক শিক্ষাদানের দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষাদান এবং প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি চালু হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজে গবেষণা করে শিখতে পারে।
• শ্রেণিকক্ষের সেটআপ: ভারতের শ্রেণিকক্ষগুলোতে সাধারণত ছাত্ররা সারিবদ্ধভাবে বসে। অনেক স্কুলে প্রথাগত শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা রয়েছে, যেখানে টেবিল-চেয়ার সারি করে সাজানো থাকে। আধুনিক শ্রেণিকক্ষে প্রজেক্টর, স্মার্ট বোর্ড, এবং কম্পিউটার ব্যবহৃত হয়, যদিও অধিকাংশ জায়গায় এটি সীমিত।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
১। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রদান এবং শিক্ষা গ্রহণে সংস্কৃতির ভূমিকা অত্যন্ত গভীর ও বহুমাত্রিক। শিক্ষাব্যবস্থা এবং শেখার প্রক্রিয়ায় সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। এ দেশের সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, ভাষা এবং আঞ্চলিক বৈচিত্র্য শিক্ষার ধরন, পাঠদান পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
• শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ বাংলাদেশের শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষকরা প্রায়শই একটি কর্তৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক সাধারণত সামনে বসেন বা দাঁড়ান এবং শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধভাবে বসে থাকে, যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি ক্ষমতার দূরত্ব তৈরি করে। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুখস্থ করার প্রবণতা রয়েছে। এটি একধরনের সাংস্কৃতিক চর্চা, যেখানে পরীক্ষার ফলাফল এবং সার্টিফিকেট পাওয়ার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়।
এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা প্রায়শই সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তার পরিবর্তে নির্দিষ্ট তথ্য মুখস্থ করে। শিক্ষকরা ক্লাসে প্রধান নির্দেশক এবং শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। এটি সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন, যেখানে শিক্ষকদের জ্ঞানী এবং অভিভাবক হিসেবে দেখা হয়। শিক্ষকরা পাঠদানের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথ্য সরবরাহ করেন এবং শিক্ষার্থীরা তা শোনে ও শিখে।
• শ্রেণিকক্ষের সেটআপঃ বাংলাদেশি শ্রেণিকক্ষ সাধারণত কাঠের প্রথাগতভাবে ডেস্ক এবং চেয়ার দিয়ে সজ্জিত থাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাধারণত ছাত্রদের জন্য কমপ্যাক্ট ডেস্ক বা বেঞ্চে সজ্জিত করা হয়। মাধ্যমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয়ে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন প্রজেক্টর এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ বোর্ডের ব্যবহার বাড়ছে, কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানে এখনও প্রথাগত সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই শ্রেণিকক্ষের আকার অনুযায়ী বসার ব্যবস্থা করা হয় না। ছাত্র-শিক্ষক এর হার আনুপাতিক হারে বণ্টণ করা হয় না। অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীবান্ধব নয়।
২। শিক্ষকদের ভূমিকা : শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণে সংস্কৃতির প্রভাব বিষয়ে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুমুখী। একটি দেশের শিক্ষার মান এবং শিক্ষার্থীদের গুণগত পরিবর্তন মূলত শিক্ষকের ওপর নির্ভরশীল। সংস্কৃতির প্রভাবিত শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা এবং দায়িত্ব বেশ অপরিসীম।
• সংস্কৃতির ধারক হিসেবে শিক্ষক: শিক্ষক সমাজ সংস্কৃতির ধারক হিসেবে কাজ করে। তারা শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্য বিষয় শেখান না, বরং দেশের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান দান করেন। শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমন একটি পরিবেশে পরিণত করতে পারেন, যেখানে সংস্কৃতি চর্চা ও মূল্যবোধের সংমিশ্রণ ঘটে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয় সম্পর্কে সচেতন হয় এবং তা লালন করতে শেখে।
• সংস্কৃতিনির্ভর শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা: প্রতিটি সংস্কৃতি তার নিজস্ব শিক্ষাদান পদ্ধতি তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু সংস্কৃতিতে পাঠদানের সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক থাকে, আবার কিছু সংস্কৃতিতে শিক্ষককে উচ্চ মর্যাদায় রাখা হয় এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। শিক্ষকদের এই প্রেক্ষাপট বুঝে শিক্ষাদান করতে হবে, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশে সহজে মানিয়ে নিতে পারে।
• বহুসংস্কৃতিবাদ এবং বিশ্বায়ন: আধুনিক সমাজে বিশ্বায়নের ফলে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে মেলবন্ধ ঘটছে। একাধিক সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিষয়ে জ্ঞান থাকা শিক্ষকদের জন্য অপরিহার্য। তাদের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিতে শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে, যাতে তারা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারে। এছাড়াও শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতা ও বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে ভূমিকা পালন করতে পারেন।
• মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ: সংস্কৃতির প্রভাব শিক্ষার্থীদের মনোজগতে কীভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য শিক্ষকদের মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং আবেগিক চাহিদা বুঝে শিক্ষাদান করতে হবে। মনে রখাতে হবে ডিজিটাল যুগে শিক্ষার্থীরা প্রথাগত ভাবে অনেক কিছুই শিখতে চায় না বা তাদের জোর করে বিষয়ের ধারণা চাপিয়ে দেওয়া যায় না। সব শিক্ষক যেমন এক দৃষ্টিভঙ্গির নয় তেমন সব শিক্ষার্থীই এক রকম মেধাবী নয়। প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এবং শ্রেণিকক্ষ অবশ্যই শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়া প্রয়োজন।
• সমাজবিজ্ঞান ও শিক্ষাবিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান: শিক্ষকরা সমাজবিজ্ঞান এবং শিক্ষাবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিলে, তারা শিক্ষার্থীদের সামাজিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে ভালোভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন। শিক্ষাদানের বিভিন্ন পদ্ধতি, যেমন— সামাজিক শিক্ষণ, সহযোগিতামূলক শিক্ষা এবং গঠনমূলক শিক্ষণ শেখা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের নির্দিষ্ট বা সীমিত ধারণার বাইরে মূল পাঠ্য বিষয়ের গভীরে জ্ঞান থাকা উচিত।
• প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা: আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত, যাতে তারা আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী শিক্ষা দিতে পারেন।
৩। শিক্ষকদের পাঠদানের কৌশল
শিক্ষকদের পাঠদানে কিছু বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করা উচিত, যা সংস্কৃতির প্রভাবকে বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও মূল্যবোধ উন্নত করতে পারে। যেমনঃ
• শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও সংস্কৃতি অনুযায়ী পাঠ পরিকল্পনা: শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক পটভূমি এবং আগ্রহের বিষয়গুলো মাথায় রেখে পাঠ পরিকল্পনা করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে এবং তা তাদের মনের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত হবে।
• আলোচনা ও অংশগ্রহণমূলক পাঠদান: শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের মতামত এবং চিন্তাভাবনার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। সংস্কৃতিভিত্তিক শিক্ষাদানে শিক্ষকদের উচিত আলোচনা এবং অংশগ্রহণমূলক পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া।
• মূল্যবোধের শিক্ষা: শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক, নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। বিভিন্ন সংস্কৃতি এই মূল্যবোধকে কীভাবে চর্চা করে তা শেখানো দরকার, যাতে শিক্ষার্থীরা সহমর্মী এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হতে পারে।
• জ্ঞান এবং জানার আগ্রহভিত্তিক শিক্ষাঃ শিক্ষার্থীদের মূল সাবজেক্টের ওপর বিশদ জ্ঞান আহরণে আগ্রহভিত্তিক পাঠ্যসূচি এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের সংস্কৃতি প্রচলন করা।
সামাজিক মূল্যবোধ, আচার-ব্যবহার, ঐতিহ্য এবং জাতীয় চেতনা শিক্ষার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়। একেকটি সংস্কৃতি একেকভাবে শিক্ষাকে মূল্যায়ন করে এবং সে অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করে। সংস্কৃতি শিক্ষার প্রভাবশালী অংশ হিসেবে কাজ করে, যা বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষাগ্রহণ ও পাঠদান পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য আনে। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির শিক্ষাব্যবস্থা তাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যের প্রতিফলন, যা শিক্ষার উদ্দেশ্য, পদ্ধতি এবং ফলাফল প্রভাবিত করে। শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক গভীর এবং অপরিহার্য, যা প্রতিটি সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ঐতিহ্য সমৃদ্ধ করে।
তথ্য সংগ্রহঃ
• Canadian Information Centre for International Credentials (www.cicic.ca)
• The UK Department for Education (www.gov.uk)
• U.S. Department of Education (www.ed.gov)
• Indian Ministry of Education (www.education.gov.in)
• Sahlberg, Pasi. Finnish Lessons: What Can the World Learn from Educational Change in Finland? (2011)
• Finnish National Agency for Education publications
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।
এইচআর/ফারুক/এমএস