পুলিশকে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হবে

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশিত: ০৯:৩৩ এএম, ১০ আগস্ট ২০২৪

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পূর্বেই তার মন্ত্রিসভার অনেকে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। বাকিরা আত্মগোপন করেছেন। তবে গোটা দেশের থানাগুলো পুলিশশূন্য হয়ে গেছে তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা প্রকাশিত হবার আগেই। বিভিন্ন কারণে জনতার নিকট দেশের গোটা পুলিশ বাহিনী মনের দিক থেকে আমার, তোমার, আপনার, সবার- বন্ধু স্বজনের শত্রু হিসেবে বিবেচিত হবার দুঃখজনক প্রেক্ষাপটে একটা নাজুক অবস্থা সূচিত হয়েছে। কিন্তু সব পুলিশতো রাজনীতির সংগে যুক্ত নন। সবাই আওয়ামী সমর্থক নন। সব পুলিশতো মিছিলের নিরীহ জনতাকে গুলি করে হত্যা করেননি। যারা বাধ্য হয়ে গুলি ছুঁড়েছেন তারা নিজেদের চাকুরি বাঁচাতে উর্ধ্বতনের আদেশ ফলো করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়ে গণমাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

পুলিশের অনেকেই আক্ষেপ করে অভিযোগ করেছেন- গুটিকয়েক উচ্চপদস্থ অফিসারের হটকারী আদেশ পালন করতে গিয়ে তারা গোটা দেশের মানুষের কাছে ভয়ংকর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন মোকাবিলা করতে গিয়ে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে তাদেরকে হার্ডলাইনে যাবার নির্দেশনা দিয়ে নিষ্ঠুরতার হোলিখেলায় নামতে বাধ্য করা হয়েছে। জনগণের বন্ধু পুলিশ হয়ে গেছেন বাস্তব সিনেমার ভিলেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন করে হয়ে গেছেন গণশত্রু। শেষ পর্যন্ত নিজেদের জীবন রক্ষার্থে কর্মস্থল ছেড়ে সবাই একযোগে সটকে পড়েছেন। এই নাজুক অবস্থা পৃথিবীর আর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কখনও ঘটেছে বলে জানা যায়নি। যেটা গোটা জাতির জন্য চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

কয়েকজন পদলোভী, তোষামোদকারী, ঘুসখোর অফিসারের জন্য দেশের গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে ভিলেন বানানো হয়েছে। অর্থ ও পদের ধান্ধায় নৈতিকভাবে অন্ধ যাওয়ায় তারা বহু বছর আগে থেকে দেশের মানুষের নিকট ভিলেন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তারা অফিসে ঠিকমতো সময় না দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের পদলেহন করে ‘ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেতে’ তৎপর হয়ে পড়েছিলেন। মামলা বা অফিসিয়াল এ্যসাইনমেন্ট নিয়ে পেশাদারী গভীর চিন্তা, কেসস্টাডি, গবেষণা, কল্যণমুখী এ্যকশান তারা একপ্রকার ভুলে গিয়ে আত্মকল্যাণের নেশায় নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখায় দেশের নিরীহ সেবাপ্রার্থীরা সবসময় তাদের বিরেুদ্ধে অভিযাগ তুলেছেন। কিন্তু তারা সেসব অভিযোগকে কখনই পাত্তা দেননি। এমন ঘটনা ঘটেছে যে পুলিশ হয়েও নিজের কাজ করাতে গিয়ে পুলিশের নিকট ঘুস না দিয়ে পার পাননি। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কি হতে পারে?

যে যত আয় করে আখের গোছাতে পারে-এমন পরিস্থিতি কিছুদিন আগে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে বেনজীরসহ অনেক উচ্চপদস্থদের কাহিনীতে। এদের মূল কাজ ছিল পেশাদারিত্বের বাইরে চারদিকে ত্রাস সৃষ্টি করে হিরোইজম ফলানো এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সুবিধা আদায় করা। সেটাতে তারা সফল হয়েছেন ব্যাপকভাবে। কিন্তু রেখে গেছেন এক দুর্বল, ভঙ্গুর পুলিশি ব্যবস্থা। যার চরম পরিণতি প্রকাশিত হয়েছে- সামান্য কোটা সংস্কার সামলানোর চরম ব্যর্থতায়। এই আন্দোলনের সময় কো-অর্ডিনেশন না থাকায় দায়িত্বশীলরা একেকজন মনগড়া তত্বকে কাজে লাগাতে গিয়ে মানুষকে অসম্মান, অপমান করতে কুন্ঠিত হননি। যার চরম পরিণতি ছিল খেই হারিয়ে নদীর গতি মহাসমুদ্রে ফেলে মহীরুহে রুপান্তর করে সরকারকে পালাতে বাধ্য করার মাধ্যমে।

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে জনগণ পুলিশের প্রতি ক্ষিপ্ত হবার কারণগুলো পুলিশকে জনগণের উপর তাদের সেবাদারিত্বের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলায় আজ এক গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছে এই মহৎ প্রতিষ্ঠানকে। এছাড়া জনরোষের ভয়ে হোক বা অভিমান করে হোক দেশের সব পুলিশ একযোগে কর্মস্থল ত্যাগ করে নিষ্ক্রিয় হয়ে চুপ করে থাকবেন সেটাও রহস্যজনক।

এক সবাই একযোগে আত্মগোপনে চলে যাওয়া অথবা গোপন অবস্থান থেকে ভিডিও বার্তা প্রেরণ করে কি কোন সেবাদারী প্রতিষ্ঠান চালানো যায়? সম্প্রতি এটাও বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। রক্ষকের ভক্ষক হয়ে যাওয়া এবং জনশান্তি নিশ্চিত করার শপথ নিয়ে জনমনে কৌতূহলোদ্রেক ঘটনা সৃষ্টি করে সেবাদান থেকে বিরত থাকাও পুলিশের কাজ হতে পারে না।

তবে আমাদের গৌরবময় পুলিশ বাহিনীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে যিনি বা যারা স্বার্থ হাসিলের খেলায় মেতে উঠেছিলেন তাদেরকে খুঁজে বের করার সময় এসেছে। তাদেরকে চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে সংস্কার করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি কম্যুনিটি পুলিশকে বেতন ও মর্যাদায় শক্তিশালী করে মাঠ পর্যায়ে জনসেবাকে রাজনীতিমুক্ত করার শক্ত ভূমিকা নেবারও সময় এখন তৈরি হয়েছে।

পুলিশ ছাড়া আমাদের সমাজ একদিনও ঠিকমতো চলতে পারে না। গতকাল (৬ জুলাই, ২০২৪) আমার একজন পরিচিত ব্যক্তি হঠাৎ বাসায় এস হাজির। তিনি হাউমাউ করে বর্ণনা দিচ্ছিলেন তাকে পথে তার এক প্রতিবেশী মাস্তানসহ আক্রমণ করেছে। জামাকাপড় ছিঁড়ে দিয়েছে। এটা কোনো রাজনৈতিক কোন্দল নয়। তার প্রতিবেশীর সাথে জমিজমা নিয়ে বহুদিনের মামলা চলছে। দেশের এই ক্রান্তিকালে যখন থানায় কোনো পুলিশ নেই, নেই কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা সেটাকে পুঁজি করে সে তার নিকট থেকে দলিলে সই করে নেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে যাচ্ছিল।

ভাগ্যিস, পথে আরেকজন পরিচিত মহিলা তাকে এই অবস্থায় দেখে চিৎকার কের লোক জড়ো করে ছাড়িয়ে নিয়েছে। ঘটনার পর তিনি তার পরিবারের লোকজন নিয়ে থানায় গিয়ে দেখে থানার দরজা বন্ধ। সেখানে কেউ নেই। থানার আশেপাশেও কেউ নেই। প্রাণভয়ে তিনি আমাদের কাছে এসে আশ্রয় চাচ্ছেন।

মাত্র দুই দিনের পুলিশবিহীন অবস্থায় দেশে আরো কত শত হাজারো বিপজ্জনক ঘটনা ঘটে চলেছে তার রেকর্ড রাখার মতো কোনো পরিস্থিতি এই মুহূর্তে নেই। তই দ্রুত বিপদের গতির রশি টেনে ধরতে হবে। গত পাঁচ ও ছয় জুলাই দুইদিন পুলিশ বাহিনী ঠিকমতো ফাংশনাল না থাকায় বোঝা যাচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এ বাহিনীর ভূমিকা কতটা। তাই আমাদের উচিত দেশকে রক্ষার্থে পুলিশের পাশে এসে দাঁড়ানো, পুলিশকে সহযোগিতা করা এবং বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে তাদের পাশে গিয়ে সাহস যোগানো। এ মুহূর্তে পুলিশকে অবিলম্বে সকল দুঃখ-কষ্ট, অভিমান ভুলে দেশ জনগণের কল্যাণে নিজ কর্মস্থলে ফিরে কাজ শুরু করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

দেশের স্বার্থে আমরা সবাই পুলিশের পাশে দাঁড়াই। পুলিশের প্রতি কেউ ক্ষিপ্ত হবেন না। তারাও দেশের মানুষ তারাও দেশের যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। তাদেরও পরিবার আছে, সন্তান আছে। আরো আছেন বৃদ্ধ ও নির্ভরশীল পিতা-মাতা, নিকটজন। পুলিশের পোশাকধারী কিছু মানুষ হয়তো বা খারাপ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু গোটা বাহিনী বা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট খারাপ নয়। গুটিকয়েক এর জন্য সকলকে ভুল বুঝবেন না। তারা আমাদেরই ভাই-বোন, আমাদের আত্মীয়-স্বজন। তাদের প্রতি আর কোনো আক্রোশ বা প্রতিশোধ নয়।

গণমানুষের সেবার জন্য পুলিশ, আমাদের ও দেশের কল্যাণের জন্যই পুলিশ। তাদের অনেকের মধ্যে ইনসাফ আছে, ন্যায়বোধ আছে। সকল সৎ পুলিশকে একত্রিত হয়ে সজাগ হতে হবে। ক্রিমিনাল ও পেটুয়া, বদমেজাজী পুলিশদেরকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে সরাতে হবে। তা না হলে পুলিশের অতীতের সব গৌরবময় অর্জন আরো ম্লান হয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক আন্দোলন ঠেকানোর ঘটনাপ্রবাহে জনগণ পুলিশের প্রতি ক্ষিপ্ত হবার কারণগুলো খুব স্পষ্ট। এজন্য সবার আগে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিহীন পেশাদারী পুলিশকে সক্রিয় হওয়া দরকার। রাজনৈতিক লেজ ধরে এবং অবৈধ অর্থের ধান্ধায় গুটিকয়েক পুলিশ ভিলেন হলেও দেশের সকল পুলিশ যেমন খারাপ নয়, পুলিশ ডিপার্টমেন্টও খারাপ নয়। এটা আমাদের সবার প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের সবাই মিলে মিশে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেশের কল্যাণে নতুন উদ্যমে আবারো কাজ শুরু করি- আজকের দিনে এটাই হোক আমাদের লক্ষ্য।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।