সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী পোস্ট করবো কী করবো না?
সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে নানাপক্ষের নানা মতামত সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই আন্দোলন এমন একটি সর্বজনগ্রাহ্য রুপ পেয়েছিল, যা সত্যি অসাধারণ। অনেক ধরনের অন্যায়, অসমতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এদেশের পঁচিশ ঊর্ধ্ব সচেতন জনগোষ্ঠী ও সুশীল সমাজ যখন শিড়দাড়া সোজা করে দাঁড়ানোর সাহস দেখাতে পারেনি, ঠিক সেরকম একটি মুহূর্তে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এই মোর্চা তাদের এক দফা দাবিতে এতটাই সোচ্চার হয়ে উঠেছিল, যা এদেশের মানুষকে একাত্ম করে তুলেছিল। সবাই আবার ধারণা করতে পেরেছে যে ছাত্র আন্দোলন এখনো জাতিকে পথ দেখাতে পারে।
সবই ঠিকঠাক মতো চলছিল। কিন্তু যখন পুলিশের গুলিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একের পর এক নিহত হতে থাকলো ও দুষ্কৃতকারীদের এলোপাথাতাড়ি হামলায় আহত হলো, তখন আর বিষয়টি স্বাভাবিক থাকলো না। ছাত্রছাত্রীসহ সবাই ফুঁসে উঠলো। পুলিশ-ছাত্র-জনতা মুখোমুখি হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তেই থাকলো।
আন্দোলন চলতে চলতে একসময় অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ালো যে মানুষ আরো খবরের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলো। যেহেতু জাতীয় গণমাধ্যমগুলোকে তাদের যার যার সম্পাদকীয় নীতি মেনে, অনেক দিক ভেবেচিন্তে, খবরের সত্যতা ক্রস চেক করে খবরাখবর দিতে হয়, তাই সময় ক্ষেপণ হয় বেশি। ঠিক এরকম একটি ক্রাইসিসের সময় মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সামাজিক মাধ্যমের উপর। ফেসবুক, ইউটিউব ভিডিও, চ্যানেল ও পত্রপত্রিকার ভিডিওগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ উৎস হয়ে উঠেছিল। সহিংসতা চলার একপর্যায়ে বিভিন্ন কারণে সামাজিক মাধ্যমেও মানুষের প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেল।
যখন সামাজিক মাধ্যম চালু ছিল, তখন আমরা প্রায় সবাই সেখানে যা কিছু পেয়েছি, তাই শেয়ার করেছি নিজেদের মতামতসহ। যে ব্যক্তি, যে পক্ষের তিনি সেইদিকের তথ্যই প্রচার করেছেন। এর পেছনে কোনো যুক্তি, সত্যতা এবং এর প্রভাব কী হতে পারে কিছু ভাবিনি। অনেকেই চলমান ঘটনাকে উস্কে দেয়ার জন্য নানান বক্তব্য খন্ডিতভাবে বা নিজেদের পছন্দ মতো শেয়ার করেছি। ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ও মুক্তিযুদ্ধকেও অপমান করতে ছাড়িনি। অসংখ্য গুজব নির্ভর তথ্য শেয়ার করেছি বুঝে এবং না বুঝে। একবারও ভেবে দেখিনি এই গুজবের ফলাফল কী হতে পারে।
শুধু এই ছাত্র আন্দোলনই নয়, অতীতেও বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তে সামাজিক মাধ্যমকে তথ্য ও একই সাথে বিভ্রান্তি ছড়ানোর উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছি। অবাক হয়ে লক্ষ করেছি যে উচ্চশিক্ষিত মানুষ এমন তথ্য শেয়ার করছেন, যার কোনো ভিত্তি নেই। কভিডকালীন, হেফাজতের সড়ক দখল করার সময়, গণজাগরণ মঞ্চ চলাকালে এমনকি বিডিআর হামলার সময়েও অনেকে নানাধরনের অসার তথ্য শেয়ার করেছেন।
চাঁদে সাঈদীর মুখ দেখা যাচ্ছে এই তথ্য সাধারণ মানুষতো বটেই, শিক্ষিতজনও বিশ্বাস করেছেন। পাউডার দিয়ে হেফাজতীদের মরদেহ গুঁড়িয়ে ফেলা, ট্রাকে করে অসংখ্য মানুষের লাশ ভারতে পাচার করে দেয়ার মতো মুখরোচক খবরও প্রচার করেছি ও বিশ্বাস করেছি। বাংলাদেশে গুজব ছড়ানোর ও বিশ্বাস করার মতো খুব অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। যথাযথ তথ্যের অভাব, মানুষের সচেতনতার অভাব এবং শিক্ষার হার কম বলে এই পরিবেশে একটি গুজব তৈরি হলে, তা ডালপালা মেলতে সময় লাগেনা।
সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার সময় প্রথম বছরেরই পড়ানো হয়েছিল- সঠিক তথ্যের অভাব, গুজব সৃষ্টি করে। মানুষ কোনো বিষয়ে অনিশ্চয়তা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেনা, তখন তাদেরই একটি অংশ নিজের মতো করে তথ্য ছড়ায় এবং তথ্য গ্রহণ করে। অনেকসময় সরকারও নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য তথ্য গোপন করে। আর কেউ কেউ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। একটি গ্রুপ সবসময়ই যেকোনো ক্রান্তিকালে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।
আমরা দেখেছি কভিডকালে করোনার জীবাণু জানালা দিয়ে বের হতে পারে, এরকম একটি ধুয়া তুলে তেজগাঁওতে আকিজ গ্রুপের হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করার সময় এলাকার একদল মানুষ এসে হামলা চালিয়েছিল। তারা নির্মাণাধীন হাসপাতালটি ভাংচুর করতেও দ্বিধা করেনি। যদিও এই প্রচারণার পেছনে ছিল সমাজের মন্দ মানুষের প্ররোচনা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ। কিন্তু সাধারণ মানুষকে বুঝানো হয়েছিল এখানে করোনা রোগী থাকলে হাসপাতালের জানালা দিয়ে জীবাণু ছড়িয়ে পড়বে।
ট্রলারযোগে গ্রামের বাড়িতে ফেরার পথে হামলার শিকার হয়েছিল পাঁচটি পরিবার। ট্রলারে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ আছে, মসজিদের মাইকে এমন গুজবের ঘোষণা দিলে নদীর একপাড়ের অতি উৎসাহী মানুষের ছোঁড়া ইট-পাটকেলের আঘাতে ট্রলারের যাত্রীরা আহত হয়েছিলেন। অথচ নারায়ণগঞ্জ শহরে দিনমজুরের কাজ করে এমন কয়েকটি পরিবার বাড়ি ফিরছিলেন সেই নৌকায়।
স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে মানুষ কেন গুজব রটায়? স্বার্থান্বেষী মহলের নানাধরনের উদ্দেশ্য থাকে। মানুষের আগ্রহ আছে এমন বিষয়েই সাধারণত গুজব ছড়ানো হয়। গুজবের উৎস খুব সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না, আবার মাঝেমাঝে কখনোই খুঁজে পাওয়া যায় না। গুজব নিয়ে সেই পুরোনো ফর্মুলা ‘মাউথ টু ইয়ার’ এর কথা আমরা জানি। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী উইলিয়াম স্টের্ন ১৯০২ সালে এই থিওরি দিয়েছিলেন। উনি বলেছিলেন, অনেক মুখে কথা ঘুরতে ঘুরতে ‘তথ্য’ ছোট হতে হতে একেবারে অন্য তথ্যও হয়ে যেতে পারে। শতকরা ৭০ ভাগ বার্তা হারিয়েও যেতে পারে।
আমরা দেখি যে সাধারণত ঘটনা বা তথ্যের ‘রসালো’ বা ‘মূল’ অংশটুকু নিয়ে গুজব ছড়ানো ও ভাইরাল করা হয়। যেমন, ছাত্র আন্দোলনের চরম অবস্থায় সরকার যখন বিপাকে, তখনই ফেইসবুকের মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্পেনে চলে গেছেন, জাতিকে বিপদের মধ্যে ফেলে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর অনেক আগের কর্মসূচি ছিল স্পেন ও ব্রাজিলে যাওয়ার, যা উনি বাতিল করেছেন। যারা সাধারণত চলমান ঘটনা নিয়ে আতংকে থাকেন, তারাই বেশি গুজবে বিশ্বাস করেন। কারণ এর মাধ্যমে তাদের মনের অনিরাপত্তা দূর হয় বলে তারা মনে করেন।
এই গুজবকে পুঁজি করে বর্তমান সময়ে শুরু হয়েছে ভাইরালের ছড়াছড়ি। সবকিছু দেখে মনেহয় ভাইরাল না হলে, ফেইসবুকে লাইক না পেলে, ইউটিউবে ভিউজ না পেলে কোন ঘটনাই ঘটনা নয়, কোন খবরই খবর না। ভাইরাল করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললেই বাধে যতো বিপত্তি। সস্তা জনপ্রিয়তা, লাখ লাখ ভিউজ পাওয়ার জন্য যখন নিন্মমানের, অসত্য, অর্ধসত্য, রুচিহীন, দৃষ্টিকটু ও আপত্তিকর কন্টেন্ট তৈরি করে ছড়িয়ে দেয়া হয়, তখন সেটা ভয়াবহ ফলাফল বয়ে আনে ব্যক্তির জীবনে ও সমাজে। এর চেয়েও অপ্রীতিকর কাজ হচ্ছে গুজব ছড়িয়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্মান নষ্ট করা, তাকে হেনস্তা করা, দেশে গোলযোগ বাঁধিয়ে ফেলা।
দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধের সময়কার ১ হাজার গুজবের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৪ সালে “এ সাইকোলজি অব রিউমার” শীর্ষক একটি পেপার লিখেছিলেন রবার্ট এইচ ন্যাপ। উনি বলেছেন বিশ্বাস করার জন্য কোনো সমস্যা বা সমাধানবিহীন ইস্যুকে যখন সাময়িক কোনো রেফারেন্স দিয়ে বর্ণনা করা হয় এবং কোনো অফিসিয়াল কনফারমেশন ছাড়া, তখনই সেটা গুজব হয়। সাধারণত কমিউনিটির আবেগকে পুঁজি করে গুজব ছড়ানো হয়।
মানুষ কেন কোনো ঘটনার সত্যতা বিচার না করেই তা সামাজিক মাধ্যমে ও লোকমুখে ছড়িয়ে দেয়? এ প্রসঙ্গে ন্যাপ মনে করেন, এর পেছনে কয়েকটি কারণ বা মনস্বত্ত্ব কাজ করে, যেমন, মানুষ যা আশা করে, বা যা দেখতে চায়, সেরকম খবরই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যদি সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের কথাই ধরি, তাহলে আন্দোলনের ধরন, ছাত্রছাত্রীদের উপর পুলিশী নির্যাতন ও তাদের দুর্দশা, ছাত্রদের প্রতি সাহায্যের আবেদন ইত্যাদি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে এতবেশি ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানো হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশে নানাধরনের সংঘাত বাড়িয়ে তুলেছে। একশ্রেণির মানুষ ঘৃণা বা বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য প্রচার করছেন এবং এর উপর নির্ভর করে বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশে জনগণের বড় একটা অংশ কম পড়াশোনা জানা ও নিরক্ষর। তারা ডিজিটাল মিডিয়ার প্রচার-প্রচারণা নিয়ে খুব একটা সচেতনও নন। যা দেখেন, তাই বিশ্বাস করেন। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে থাকে অসাধু ব্যক্তিরা।
অনেকেই এই ঘটনাগুলোর কোনো উৎস ব্যবহার না করেই ফেসবুকে তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয়ত, ভয় ছড়ানোর জন্যও গুজব ভাইরাল করা হয়। যেমন চারিদিকে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে, অসংখ্য মানুষ নিহত হচ্ছে, হাতিরঝিলে শতশত মরদেহ ভেসে উঠছে, হেলিকপ্টার থেকে অনবরত গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে ইত্যাদি। তৃতীয়ত, কোনো গোষ্ঠী বা গ্রুপকে হেয় করার জন্যও গুজব ছড়ানো হয়। তবে নেতিবাচক সংবাদের বা ঘটনার গুজব বেশি ছড়িয়ে পড়ে।
বাজারে এসেছে ট্রল। শিল্পী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, কবি-সাহিত্যিক কেউ বাদ যাচ্ছেন না ট্রলের হাত থেকে। নারীকে যৌন হয়রানি, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধকে আঘাত করা, রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থির করা ও অনিশ্চিত পরিবেশ তৈরি করার মত জঘন্য অপরাধও ঘটিয়ে থাকে এই ট্রল করতে গিয়ে। বিষয়টি আনন্দ বা নিছক মজা না হয়ে তখনই সমস্যা দাঁড়ায়, যখন জাতি বা সমাজের ক্রান্তিকালে এইগুলো করা হয়।
অথচ এই সময়গুলোতে শুধুমাত্র ভাইরাল হওয়ার জন্য বা ভিউ বাড়াবার জন্য মানুষ যা খুশি লিখতে পারেন না, প্রকাশ করতে পারেন না বা ছড়িয়ে দিতে পারেন না। যেহেতু সামাজিক মাধ্যমের জয়জয়কার, তাই ‘ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা’ বিষয়টি এখন ফিরে এসেছে সামাজিক মাধ্যমের উপর ভর করে। যেহেতু এখানে কোন ‘গেট কিপিং’ হয় না, তাই যার যা ইচ্ছা ছড়িয়ে দিতে পারেন।
‘কোটা বিরোধী’ ছাত্র আন্দোলন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যা যা প্রচারিত হয়েছে, এর প্রতিটি কথাই বিশ্বাস করেছে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ। তারা প্রশ্ন করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনী যে হামলা চালিয়েছে, কেন প্রধান নিউজ মিডিয়াগুলো ১৯৭১ এর ২৫ মার্চে পাকিস্তানি হামলার সাথে এর তুলনা করছে না? তারা কি ভয় পেয়েছে? সামাজিকমাধ্যমেতো অনেক শিক্ষক, কবি, ব্লগার, নারীনেত্রী, লেখক একে ৭১ এর ’কালরাত’ এর সাথে তুলনা করছেন। বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, অনেকে ইতিহাস পড়েনি, হয়তো পরিবারের কাছে গল্পও শুনেনি। তাই তারা ধরেই নিয়েছে যে ৭১ এর ‘কালরাত’ এ এমনটাই হয়েছিল। কিন্তু অনেকেই জানেন যে সেইসময় ঐ আক্রমণ ছিল আরো বহুগুণ ভয়াবহ। এবার হলগুলোতে ও রাজপথে ছাত্রছাত্রীদের উপর যে হামলা চালানো হয়েছে, সেটাও ভয়াবহ। কিন্তু জাতীয় গণমাধ্যম একে ’৭১ এর কালরাতের সাথে তুলনা করতে পারে না, যেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পারে। এই কারণেই দেখলাম ছাত্রছাত্রীদের মনে জাতীয় গণমাধ্যমের প্রতি রোষ।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল লার্নার বলেছিলেন, গণমাধ্যম জনগণের মানসিকতাকে উন্নত করে। তিনি সাংবাদিকদের সমাজের ‘গেট কীপার‘ বলেছেন। কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বড় বাজার সৃষ্টি হওয়ায়। একটা লেখায় পড়লাম, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও সংবাদপত্রের মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে ইন্টানেটের রমরমা অবস্থাকেই দায়ী করেছেন।
ওবামার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল সিনেমার জন্মের পরও তো সমানভাবেই বইয়ের আকর্ষণ ছিল। মানুষতো বই পড়তে ভুলে যায়নি। তবে কেন ইন্টারনেট কেড়ে নেবে সংবাদপত্রের গুরুত্ব? ওবামা অল্প হেসে জবাব দিয়েছিলেন, “কারণটা সহজ, ব্যবসা” তিনি বলেছিলেন, “দেখুন, মধ্যবিত্তের সুখের দিন গিয়েছে। রোদে পিঠ দিয়ে বসে খবরের কাগজ পড়াটা এখন বিলাসিতা”
ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে একদিকে যেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করা যায়, তেমনি এর অপব্যবহার হলে তা অন্য মানুষের মর্যাদা, শান্তি, অধিকার লংঘন করতে পারে। ঠিক এই ইস্যুতেই গণমাধ্যমকে কাজ করতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে তাদের বুঝাতে হবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন কিছু প্রচার ও সম্প্রচার করা যাবে না, যা বিদ্বেষপূর্ণ ও ঘৃণাসূচক এবং যা জনশৃঙ্খলা বা শান্তি নষ্ট করতে পারে, সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে বা সহিংসতা উসকে দিতে পারে।
ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে এতবেশি ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানো হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশে নানাধরনের সংঘাত বাড়িয়ে তুলেছে। একশ্রেণির মানুষ ঘৃণা বা বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য প্রচার করছেন এবং এর উপর নির্ভর করে বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশে জনগণের বড় একটা অংশ কম পড়াশোনা জানা ও নিরক্ষর। তারা ডিজিটাল মিডিয়ার প্রচার-প্রচারণা নিয়ে খুব একটা সচেতনও নন। যা দেখেন, তাই বিশ্বাস করেন। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে থাকে অসাধু ব্যক্তিরা।
প্রায় শতকরা ৮৬ জন তরুণ-তরুণীর স্মার্টফোনের প্রবেশাধিকার রয়েছে। এত বড় একটা অংশ ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করলেও এদের কতজন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে ভাবছেন? অথবা অনলাইনের ঘৃণামূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন? অনেকে শুধুই নেতিবাচক মন্তব্য করে সামাজিক মাধ্যমের কমেন্টবক্স ভরে ফেলেন। এগুলোকেও কি আমরা ভিউজ হিসেবে ধরে নেবো? এদের কারণে দেশের মূলধারার গণমাধ্যমও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাকলুহান মনে করেন ‘মিডিয়াম ইজ দ্যা মেসেজ’ অর্থাৎ মাধ্যমই সংবাদ। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অনেক খবর ও ছবিকে এডিট করে যেকোন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে যেমন বিপদে ফেলা যায়, তেমনি সমাজেও হাঙ্গামা সৃষ্টি করা যায়। এসব বানানো বা অর্ধ সত্য জিনিস লাখ লাখ ভিউয়ার্স দেখে, কমেন্ট এবং শেয়ার করে। বিপদজনক ব্যাপারটা হচ্ছে, এই ক্ষেত্রেও কিন্তু মিডিয়াম ইজ দ্যা মেসেজ।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম