কোটা সমস্যার ন্যায্য সমাধান সরকারকেই করতে হবে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৩০ এএম, ১৩ জুলাই ২০২৪

অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটা– সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়কে স্থগিত করেছেন এক মাসের জন্য। কিন্তু এতে করে প্রত্যাশা মতো কোটা বিরোধী আন্দোলন এর ফলে সৃষ্ট জন ভোগান্তি কমলো না। কোটা বিরোধীরা নির্বাহী বিভাগ এ সংক্রান্ত ঘোষণা দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে সড়ক অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার। কয়েক বছর ধরে সে অনুযায়ী কোটাবিহীন নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু একটি রিটের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি হাইকোর্ট কোটা বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করলে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়।

যেহেতু আদালতের মাধ্যমে ফিরেছিল কোটা, আবার আদালতই স্থগিত করেছে তাই আন্দোলনকারীদের এটা মানা উচিৎ। কোটা বা সংরক্ষণ প্রথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউ জিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকায় ‘পজিটিভ ডিস্ক্রিমিনেশন” নামে কোটা আছে। ফ্রান্সে সরকারি চাকরিতে বড় অংকের নারী কোটা আছে। ব্রাজিলে আদিবাসীদের জন্য চাকরিসহ সব ক্ষেত্রে কোটা প্রথা বজায় আছে।

এটাই স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশের ভাবনাটা পশ্চিমা সমাজের চাইতে ভিন্ন হবে। বহু বছর ধরেই পিছিয়ে পড়া মানুষদের সামাজিক ন্যায় ও আর্থিক মানোন্নয়নকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯-এর ৩ (ক) অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলোকে অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করে ১৯৮৫ সালে সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য শতকরা পাঁচ ভাগ কোটা সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়।

এ ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে উপজাতি কোটা রাখা হয়। কোটাব্যবস্থা পেয়ে তাদের জীবনমান ও আর্থ-সামাজিক সূচকে কিছুটা হলেও অগ্রগতি হয়েছে। তেমনিভাবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠির জন্যও কোটা আছে এবং এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কেউ আপত্তি করছে না। ক্ষেত্র বিশেষে নারীদের জন্যও কোটা ব্যবস্থা বড় অবদান রেখেছে।

এই সংরক্ষণ প্রথার সুফল হিসাবে স্বাধীন দেশে সমাজে অন্যদের থেকে তুলনামূলক ভাবে আর্থিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মানুষরা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। কোটা তাই সমাজে ন্যায্যতা বজায় রাখতে অবদান রাখছে। প্রশ্ন হতে পারে কোটা প্রথা কতটুকু এবং কীভাবে থাকবে? এ বিষয়ে বড় ঐক্যমত প্রয়োজন। যারা কোটা বাতিল চান তারা বুঝতে পারছেন না যে, শ্রেণি, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গীয় অসমতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই দেশে কোটা বাতিল সমাজের অসমতা এবং বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

এ কথা সত্য যে কোটা প্রথায় মেধা কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে বাস্তবতা হলো অতি দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া পরিবারের সন্তানরাও কোনো কাঠামোতেই সেভাবে লেখাপড়া করতে পারে না যে মেধা প্রদর্শন করবে। মেধা ও যোগ্যতা কোনো বায়বীয় পদার্থ নয় যে, তা এমনি এমনিই সকলের মধ্যে গড়ে উঠবে। পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উপর তা প্রায় সরলরৈখিক ভাবে নির্ভরশীল।

যে পড়ুয়া শহুরে বড় প্রতিষ্ঠান, ভাল ভাল শিক্ষকের কাছে পড়ছেন আর যে প্রান্তিক পর্যায়ে অতি ভগ্ন কাঠামোতে ভাল শিক্ষক ছাড়া পড়ছেন, যে পড়ুয়া প্রতিটি বিষয়ে দু’জন করে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ার চেয়ে যোগ্যতর হয়ে উঠেছেন, তাদের যোগ্যতা কি সত্যিই তুলনীয়!

সরকারি চাকরিতে প্রাপ্ত সুবিধা গড়পড়তা বেসরকারি চাকরির থেকে বেশি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই কোটার কারণে চাকরি পাওয়া ব্যক্তির সামাজিক ও আর্থিক মানোন্নয়ন হয়। তিনি স্বচ্ছন্দে তার পরিবারের জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান নিশ্চিত করতে পারেন।

সেই সঙ্গে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দ্বিধাহীন ভাবে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করতে পারেন। সন্তানদের দিতে পারেন সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চিত আশ্বাস। তবে সমাজের বাকি অংশের কাছে সংরক্ষণের সুবিধা সমান ভাবে পৌঁছে দিতে একটা বিকল্প ভাবনা ভাবা যেতেই পারে।

রাজনীতিকরা কোটা সংরক্ষণকে ভোটের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সেখানে অনেকাংশে গৌণ থাকছে। বাংলাদেশশের জন্মই হয়েছিল বঞ্চনা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে। সমতার মতাদর্শ চিন্তা করলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, দলিত, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র পেশাজীবী, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বহাল রাখতে হবে।

মনে রাখা দরকার পিছিয়ে পড়া এই মানুষগুলো মোট জনসংখ্যার যত অংশ জুড়ে আছেন, তারা যদি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সমান ভাবে পেতেন, তা হলে সর্বস্তরে প্রতিযোগিতা বেড়েই যেত, কমত না। তাই কোটার বিতরণ কীভাবে হবে সেটা নিয়ে জেদাজেদির পরিবর্তে যৌক্তিক ভাবনাই বেশি প্রয়োজন।

সমাধান করতে হবে সরকারকেই। এখানে জেদাজেদির সুযোগ কম। আন্দোলনকারীরা যতই শ্লোগান দিক যে ‘কোটা প্রথার কবর চাই’, বাস্তবতা হলো কোটাব্যবস্থা তাদের মানতে হবে। প্রয়োজন হল সংস্কার করা। দেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী যারা আছেন, তাদের জন্য অবশ্যই সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধ করা শহীদ পরিবার, যুদ্ধাহত পরিবারগুলোর কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। তেমনিভাবে নারী কোটাও থাকা দরকার। তবে সার্বিক বিবেচনায় ৫৬ শতাংশ কোটা নয়, কোটায় নিয়োগ সব মিলিয়ে ১৫ শতাংশের মতো হলে তা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচিত হতে পারে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল।

এইচআর/এমএস

মুক্তিযুদ্ধ করা শহীদ পরিবার, যুদ্ধাহত পরিবারগুলোর কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। তেমনিভাবে নারী কোটাও থাকা দরকার। তবে সার্বিক বিবেচনায় ৫৬ শতাংশ কোটা নয়, কোটায় নিয়োগ সব মিলিয়ে ১৫ শতাংশের মতো হলে তা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচিত হতে পারে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।