যে কারণে কোটা ব্যবস্থা থাকা জরুরি
বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আমি মনে করি এই ধর্ম বিশ্বাসী শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা থাকা দরকার। কারণ স্বাধীনতার ৫৪ বছরে খ্রিষ্টান সমাজের কোনো ব্যক্তিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার করা হয়নি। এমনকি হাতে গোনা কয়েকজন অধ্যাপক রয়েছেন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে। যদিও এদেশের মিশনারি স্কুল-কলেজগুলো শত বছর যাবৎ শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে চলেছে, তবু নিজেদের সমাজের উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণই হলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। সরকারি চাকরিতে খ্রিষ্টান সমাজের জন্য কোটা সুবিধা থাকলে এই সমাজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে কর্মে নিয়োজিত হওয়ার উৎসাহ বৃদ্ধি পেত। যেহেতু এ ধর্মবিশ্বাসীর ১০ লাখ জনগোষ্ঠী সরকারি চাকরিতে কোনো অর্থেই সুযোগ-সুবিধা পায় না সেজন্য পিছিয়ে পড়েছে আমাদের খ্রিষ্টান সমাজ। আশ্চর্য হলো ব্রিটিশ আমলের সেন্সাস রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় সেখানেও এই ধর্মবিশ্বাসীদের কোনো আলাদা সুযোগ-সুবিধা কখনো প্রদান করা হয়নি। বরং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য বেশি চিন্তা করেছে এবং সমকালে নানা ধরনের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিল। এজন্য সেন্সাসগুলোতে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, অবহেলিত-অস্পৃশ্য পরিবার, নিম্নবর্গ ইত্যাদির পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ করা হতো। ভারতের রাজনীতিতে তপসিলি চেতনা ও অধিকার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। তফসিলি জাতি (এসসি) ও তফসিলি জনজাতি (এসটি) হচ্ছে সরকারিভাবে স্বীকৃত ভারতের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত আর্থসামাজিক জনগোষ্ঠী। আর তাদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেখানেও খ্রিষ্টান সমাজের জন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকায় জাতীয় পর্যায়ে ওই ধর্মবিশ্বাসীদের বিচরণ একেবারেই হাতে গোনা। কথা বলছিলাম বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সমাজ নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে উপজাতি জনগোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের কথা ভেবে হতাশায় নিমজ্জিত হই। চাকমা, বড়ুয়া প্রভৃতি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে উপাচার্য, সরকারি আমলা এবং বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী। পক্ষান্তরে খ্রিষ্টান সমাজের শূন্যতায় ব্যাপ্ত চরাচর। সরকারি চাকরিতে খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থা জরুরি হয়ে উঠেছে।
আর এসব বিবেচনায় চলমান কোটা বাতিলের আন্দোলনকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। বরং কোটা সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা জরুরি বলে মনে করি। শেখ হাসিনা সরকার ২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ভুল করেছিল। কারণ সরকার প্রধান শেখ হাসিনার কথা থেকেই আমরা জানতে পেরেছি, কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার ফলে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা কমে গেছে। কোনো কোনো সুবিধাবঞ্চিত জেলার কেউ-ই চাকরি পায়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান চিত্র এরকম-কোটা ব্যবস্থা রদের পর পর বিসিএস(পুলিশ)-এ নারী কর্মকর্তা ও জেলাভিত্তিক কোটার বর্তমান অবস্থা হলো- কোটাভিত্তিক নিয়োগ ৩৮ ব্যাচ পর্যন্ত বহাল ছিলো। কিন্তু ৪০ ও ৪১ ব্যাচ নিয়োগে কোনো কোটা ছিলো না। কোটা বাতিলের পর বিসিএস পুলিশে নারীদের নিয়োগের সংখ্যা কমে আসতে শুরু করে। তাছাড়া ৪০ ব্যাচে ২৪টি জেলা ও ৪১ ব্যাচে ১৮টি জেলা থেকে কোন কর্মকর্তা নিয়োগ লাভ করে নি। নারী কোটা সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক তথ্যাদি হচ্ছে-৪০ ব্যাচের সুপারিশকৃত মোট সংখ্যা ৫৭৪ জনের মধ্যে নারী সুপারিশকৃত ১২১ জন। যা মোট সুপারিশকৃত সংখ্যার ২১.০৮%। ৪১ ব্যাচে সুপারিশকৃত মোট সংখ্যা ৮১৬ জনের মধ্যে নারী সুপারিশকৃত ১৭৩ জন। যা মোট সুপারিশকৃত সংখ্যার ২১.২০%। ৪৩ ব্যাচের সুপারিশকৃত মোট সংখ্যা ৬৪৫ জনের মধ্যে নারী সুপারিশকৃত ১১০ জন। যা মোট সুপারিশকৃত সংখ্যার ১৭.০৫%। এ তথ্য সাধারণ ক্যাডার সংক্রান্ত, যা কোটার প্রভাব বা অভিঘাত সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা দেয়। অথচ ৩৮ ব্যাচের সকল ক্যাডারের সুপারিশকৃত কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ২২০৪, নারী সুপারিশকৃত ৫৭৮, যা মোট সুপারিশকৃতের ২৬.৮৭%। ৩৭ ব্যাচের সকল ক্যাডারের সুপারিশকৃত কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ১৩১৩, নারী সুপারিশকৃত ৩০৯ জন। যা মোট সুপারিশকৃতের ২৪.৭৩%। ৩৬ ব্যাচের সকল ক্যাডারের সুপারিশকৃত কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ২৩২৩, নারী সুপারিশকৃত ৫৮৪ জন। যা মোট সুপারিশকৃতের ২৫.৮৯%।
উল্লেখ্য, কোটা পদ্ধতি বাতিল হয় ৪০ বিসিএস থেকে। কোটাযুক্ত সর্বশেষ ব্যাচ ছিল বিসিএস ৩৮ ব্যাচ। ২০২০ সালের পর পুলিশের চাকরিতে কোটা না থাকায় মাত্র চার জন নারী অফিসার সুযোগ পেয়েছে, আর ফরেন সার্ভিসে মাত্র দুইজন নারী প্রার্থী সুযোগ পেয়েছে। ২৩ টি জেলায় একজনও পুলিশের চাকরি পায় নি। অন্যদিকে ৫০ টি জেলায় নারীরা চাকরির ক্ষেত্রে কোন সুযোগ পায়নি। যখন কোটা পদ্ধতি ছিল নারীদের চাকরিপ্রার্থী কম বেশি ২৬ পার্সেন্ট এর উপরে চাকরি পেয়েছিল। কোটা তুলে দেওয়ার ফলে এই চাকরি প্রাপ্তি কোন কোন বছর ১৯ পার্সেন্টে নেমে এসেছে। একমাত্র মেডিকেলে ডাক্তারদের চাকরি ক্ষেত্রে মেয়েরা কিছুটা অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে।
২০১৮ সালে যারা কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল তারা কেউই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বা প্রিলিমিনারিতেও যোগ দেয় নি। তাহলে ২০১৮ সালের মতো ২০২৪ সালে এসে তাদের এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। এ দেশে যে কোন চাকরি সর্বপ্রথম মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সন্ত্রাস-সন্ততি নাতি-নাতনীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার মেধাবী না, মেধাবী হল রাজাকারের নাতি পুতিরা? আন্দোলনকারী কেন পিএসসি-এর পরীক্ষা দিল না, অংশগ্রহণ করলো না? জবাব তাদের দিতে হবে। ৩০% কোটা অবশ্যই থাকতে হবে। অগ্রাধিকার পাবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, তারা চাকরি পাবে আগে। যোগ্য কাউকে না পাওয়া গেলে কিংবা যদি না থাকে কেউ তাহলে বাকি যা থাকবে অন্যরা পাবে। এভাবেই কোটা ব্যবস্থা প্রচলিত থাকবে।
মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনা সরকারই শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পরিপত্র জারি করে। ফলে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত বাতিল হয় সব ধরনের কোটা। কিন্তু কোটা পুনর্বহালের দাবিতে ২০২১ সালে আদালতে রিট করেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ৫ জুন কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ফলে ১০ জুলাই হাইকোর্টের রায়ের উপর ৪ সপ্তাহের স্থিতাদেশ দেয় আপিল বিভাগ। স্থগিত হয় কোটা পুনর্বহালের রায়। অর্থাৎ কোটা ব্যবস্থা ফিরে আসা এখন কোর্টের রায়ের উপর নির্ভর করছে। সরকারের দায় নেই। বরং আন্দোলনকারীদের মনে রাখা দরকার শেখ হাসিনা সরকার কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ভুল করেছিল। কারণ কোটা ব্যবস্থা পৃথিবীর নানা দেশে প্রচলিত আছে। আর জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক নানা স্তরের জন্য কোটা ব্যবস্থা সংরক্ষণ আবশ্যক। এমনকি বাংলাদেশে কোটা ব্যবস্থা প্রচলিত থাকার সময় বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের রিপোর্ট ২০২০ অনুসারে বিগত ৩৫ থেকে ৩৯তম বিসিএস-এর ৫টি নিয়োগ পরীক্ষার পরিসংখ্যান দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, কোটায় চাকরি পাওয়ার সংখ্যা নগণ্য। ওই সময়ে মোট নিয়োগ পেয়েছে- ১৪,৮১৩ জন। তার মধ্যে মোট কোটা ৯,৮১৮ জন (৬৬.২%)। এর মধ্যে জেলা কোটা ২১২৪ জন, নারী কোটা ১৪২৬ জন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ১২৯৮ জন (৮.৭%), ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ১৩১ জন এবং প্রতিবন্ধী কোটায় ১৬ জন নিয়োগ পেয়েছেন।
উপরের পর্যালোচনা ও পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিয়ে আমরা মনে করি বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা অবশ্যই প্রচলিত থাকতে হবে। উপরন্তু খ্রিষ্টান সমাজের জন্য স্বতন্ত্র কোটার প্রচলন সময়ের দাবি। অবলিম্বে কোটা ব্যবস্থার পুনর্বহাল এবং খ্রিষ্টান কোটা প্রচলন করে সমগ্র জনগোষ্ঠীর মঙ্গল করলে সম্প্রীতির দেশ, সমৃদ্ধির দেশ গড়ে উঠবে।
লেখক : বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
এইচআর/এএসএম