আস্থার জায়গাগুলো যখন প্রশ্নবিদ্ধ
ছোটবেলা থেকেই সংবাদপত্রে চোখ বুলানোর মাধ্যমে দিন শুরুর একটা অভ্যাস ছিল। সে অভ্যাসটা দিন দিন ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। আগে সংবাদপত্রে অগ্রগতির সংবাদ থাকতো বেশি। এখনকার সব সংবাদপত্রে প্রথমেই থাকে দেশের নানান সংস্থার পদধারীদের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সংবাদ।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের ঊর্ধ্বমুখী পরিসংখ্যানিক চার্টের সাথে পরিচিত হচ্ছি। পাশাপাশি যেন পাল্লা দিয়ে দুর্নীতির সূচকও ওপরের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের গাড়িচালক, দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা, কাস্টমস কর্মকর্তা, পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসার, সরকারি আমলা, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তা থেকে গাড়িচালক কেউ বাকি নেই এই দুর্নীতিবাজের তালিকায়।
আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মরতে মরতে বেঁচে আছে। সাধারণ মানুষ দুর্নীতি করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যেসব সংস্থার জন্ম সেসব সংস্থার কর্মকর্তারা যখন দুর্নীতিবাজের তালিকায় চলে আসে তখন দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখাকে যেন বিলাসিতা মনে হতে শুরু করে।
কেন ঘটছে এমন অনিয়ম? যাকেই কোনো পদে বসানো হচ্ছে সেই যেন হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ। এ যেন এক অলিখিত পরিণতির দিকে হাঁটছি আমরা। ভার্চুয়াল জগতে মানুষ হইচই করছে। নেই রাস্তার কোনো আন্দোলন। তাহলে প্রতিরোধ কোথায়?
ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের অনেকেই কেবল দেশকে ভালোবেসে বিদেশে পাড়ি দেইনি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভেবেছি বাঁচা মরা সব এদেশে থেকেই হবে। বিদেশে গিয়ে পরাধীন থাকার চাইতে স্বাধীন বাংলাদেশের একজন সামান্য নাগরিক পরিচয় আমাকে অনেক বেশি শক্তি দেয়। সেই স্বপ্নের গোড়াপত্তন করে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে ব্যক্তি নিজের সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য হাসিমুখে ত্যাগ করেছিলেন কেবল একটি দেশের মানচিত্রের দাবিতে। সেইসব ত্যাগী মানুষগুলো স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ও সবল বাংলাদেশ হবে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ওপর যে দেশের জন্ম সে দেশে এখন দুর্নীতিবাজদের জয় জয়কার চলছে।
হ্যাঁ, এ কথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে দুর্নীতিবাজদের তালিকা প্রকাশিতও হচ্ছে। আবার ধরাও পড়ছে কেউ কেউ। কিন্তু বড় বড় রাঘববোয়াল এখনও রয়ে যাচ্ছে হাতের নাগালের বাইরে। পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর একজন পরিচিত মানুষ ছিলেন, যাকে রীতিমতো সেলিব্রিটি হিসেবে গণ্য করা হতো। তিনি যখন কোনো কথা বলতেন সে কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতো সবাই। দেখতে ও চলনে বলনে তিনি ছিলেন আইকনিক একজন মানুষ। অথচ সেই বেনজীর সাহেবের ঠিঁকুজি এখন সবার মুখে মুখে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী যার ওপর দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গুরু দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন তিনি সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আজকে দুর্নীতির আইকনে পরিণত হয়েছেন। যখন বিষয়টা চারদিকে ছড়ালো ততদিনে তিনি পরিবারসহ পাড়ি জমিয়েছেন দেশের বাইরে।
একই কাহিনি শোনা যাচ্ছে পুলিশের সাবেক আরও অনেকের নামে। নিয়মিত পরীক্ষা ছাড়াও বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটনা এদেশের কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনকে নষ্ট করতে বসেছে। সেই ফাঁসকাণ্ডে এবার নাম এসেছে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের ড্রাইভারেরও। ছয় হোতার মধ্যে ড্রাইভার একজন অন্যতম দোষী।
বিসিএস নিয়ে গোটা দেশে এখন চলছে আন্দোলন। কোটা থাকবে কি থাকবে না সে নিয়ে যখন রাষ্ট্রের ওপর মহলেও চলছে উত্তপ্ত আলোচনা তখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের হোতা হিসেবে চেয়ারম্যানের ড্রাইভারের নাম আসাটা কোনদিকে ইঙ্গিত দেয় সেটা সহজেই অনুমেয়।
এমন অনেক ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। এদেশে একদল মানুষ নিয়মিত তাদের তিনবেলা খাবারের নিশ্চয়তা নিয়ে সংগ্রাম করছে। বাজারমূল্যের অনিয়ন্ত্রিত অবস্থার গরম এসে লাগছে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষের গায়ে। ছা-পোষা মানুষগুলো প্রতিদিন অফিসে আসার পথে রাস্তায় যে পরিমাণ হেনস্তা হচ্ছে সেগুলোর আলাপ সামনে আসে খুবই কম। মেট্রোরেল উপহার দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেই মেট্রোরেলেও যেন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। অস্থিরতায় দিন কাটাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
একটা স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়মতান্ত্রিকতার রাস্তায় না হেঁটে ক্রমাগত অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে যেন। মন্ত্রণালয়গুলোর কাজকর্ম তেমন স্বচ্ছ নয় আমাদের কাছে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়েও আছে দুর্নীতি। দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হচ্ছে আমাদের ভালোবাসার বাংলাদেশ। অথচ বছর বছর করের বোঝা চেপে বসছে সৎপথে থাকতে চাওয়া মানুষগুলোর কাঁধে। কেন?
কেন ঘটছে এমন অনিয়ম? যাকেই কোনো পদে বসানো হচ্ছে সেই যেন হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ। এ যেন এক অলিখিত পরিণতির দিকে হাঁটছি আমরা। ভার্চুয়াল জগতে মানুষ হইচই করছে। নেই রাস্তার কোনো আন্দোলন। তাহলে প্রতিরোধ কোথায়? রাষ্ট্র তার জায়গা থেকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চাইছে। প্রতি বছরের বাজেটে কর্মসূচির পসরা দেওয়া হয়। উন্নয়ন তো হচ্ছে বা হবেও কিন্তু সে উন্নয়নের টেকসই নিয়ে কি আদৌ আমরা চিন্তিত? টেকসই উন্নয়ন যদি নিশ্চিত করা না যায় তাহলে সমাজে বর্ধমান বৈষম্যের কী হবে? ধনীরা চুরি করে আরও ধনী হচ্ছে আর গরিব তার গরীবি হালকে হয়তো কিছুটা কমাতে পারলেও গরিব তকমা থেকে বের হতে পারছে কি?
২০৪১ সালের যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই স্বপ্ন কি কেবল রাষ্ট্রের স্বপ্ন হয়েই থাকবে নাকি সেই স্বপ্নের সারথী হবে এদেশের ১৭ কোটি মানুষ? দিনশেষে আমাদের একটাই আশ্রয়স্থল। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যাকে কেনা যায় না। যিনি কাজ করে যাচ্ছেন সবার কথা মাথায় রেখে। কিন্তু উনার আশেপাশের পিলারগুলো যদি ঘুনে খাওয়া হয় তাহলে কীসের ওপর ভর করে দাঁড়াবে এই রাষ্ট্র?
লেখক: কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম