অর্থনৈতিক কারণেই চীনকে বাংলাদেশের দরকার

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১১:৫৮ এএম, ০৬ জুলাই ২০২৪

ভারত সফর শেষ করেই এবার চীন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী সোমবার সকালে ঢাকা থেকে বেইজিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী ৯ জুলাই তিনি বেইজিংয়ে বিজনেস ফোরামে যোগ দিয়ে বক্তব্য দেবেন। পরদিন ১০ জুলাই লি কিয়াংয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবেন।

ভারত সফরের পর পর এই সফর নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে বড় আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন, শেখ হাসিনা চীন এবং ইন্ডিয়ার মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে ‘চীন্ডিয়া’ নীতিতে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল কথাই হলো ‘কারও সাথে বৈরিতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্ব’। সেই জায়গা থেকে দেখলে ভারত সফরের পর চীন সফর নিয়ে এত আলোচনা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে এবং তাতে কিছুটা ঘি ঢেলেছেন খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গত বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়ে ভারতের কোনো আপত্তি নেই। তিনি বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকেই চীন সফরের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভারত কেন একটা স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি স্বাধীন দেশ সফরে আপত্তি জানাবে? তাহলে কী দিল্লীর অনুমতি নিয়েই প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করছেন? এমন একটা কথা বলে সরকার বিরোধী পক্ষকে রাজনীতি করার এক সুযোগ করে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। চীন-ভারত বৈরিতা এখন চরমে এবং সেটা মাথায় রেখে বাংলাদেশ আসলে বলতে চায় যে, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই বাংলাদেশকে অন্য দেশের সাথে সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চাচ্ছে। রক্তের সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গী ভারতের সঙ্গে হলেও বাস্তব কারণেই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও আর্থিক সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে। ভারত কী ভাবছে সেটা ভিন্ন বিষয়, কিন্তু বাংলাদেশের প্রয়োজনেই চীনকে দূরে ঠেলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ চীন বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগী দেশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বড় উচ্চতায় পৌঁছুলেও তিন্তার পানি চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মনে ভারত বৈরিতা তৈরি হয়েছে। তিস্তা নিয়ে ভারতের কান্ডে বাংলাদেশের হতাশা আছে। তিস্তার পানি মহা-ব্যবস্থাপনার নতুন উদ্যোগে চীনা প্রস্তাবের আলোচনার মধ্যেই এবার নরেন্দো মোদি জানিয়েছেন তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে ভারতীয় একটা কারিগরি দল সফর করবে। বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট করেই বলছেন যে, চুক্তি থেকে সরে এসে এরকম কারিগরি টিম পাঠানোর অর্থই হলো ভারত চুক্তি বাস্তবায়ন না কৌশল নিয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ যখন চীনের সাথে ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় যেতে চাচ্ছে তখন নিজেরা আগ বাড়িয়ে এসে সব আয়োজন পিছিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন তিস্তার একটা সঙ্কটের সঙ্গে আরও একটি সঙ্কট সৃষ্টি করে তিস্তা নিয়ে দুটি সমস্যা সৃষ্টি করছে ভারত। দীর্ঘসূত্রতার নতুন কৌশলকে দেখা হচ্ছে ভারতের নতুন খেলা হিসেবেও।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়েই দেখছে ভারত। কারণ ভারতে সঙ্গে চীনের বড় শত্রুতা আছে। সীমান্তে প্রায়ই দুই দেশের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে। কূটনৈতিক যুদ্ধেও চীনের কাছে পর্যদুস্ত হচ্ছে ভারত। তাই ভারত বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে ভাল দৃষ্টিতে দেখে না। ভারত-চীনের এই শত্রুতা-মিত্রতার খেলায় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে আছে তা বোঝা মুশকিল।

চীনকে বাংলাদেশের লাগবে। কারণ ডলার সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশের অর্থ প্রয়োজন এবং সেটা চীনই দিতে পারবে। একদিন আগেই, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, দ্রুত শিল্পায়নের জন্য চীনকে বাংলাদেশের প্রয়োজন। গত ১৫ বছরে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ২০১০ ও ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর দুই দেশের মধ্যে বর্তমান উষ্ণ সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেলসহ বড় বড় প্রকল্পে সহযোগিতা করে অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে চীন। এ পর্যন্ত ২১টি সেতু, ১১টি মহাসড়কসহ ৫৫০ কিলোমিটার সড়ক এবং ২৭টি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে চীন। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যও বাড়ছে। ২০২০ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন। পরে তা বাড়িয়ে ৯৮ শতাংশ করা হয়। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি অর্জনের অভিযান, ভিশন-২০৪১ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ অর্জনে বাংলাদেশের সাথে কাজ করার আগ্রহ ও দৃঢ় অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের অংশীদার চীন। তো এমন একটা শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ককে কীভাবে এড়িয়ে চলবে বাংলাদেশ এবং তাও শুধু ভারতের কারণে?

চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথাতেও আমাদের লাভ-লোকসানের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে। একক দেশ হিসেবে চীনের কাছ থেকেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে এবং ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও চীন বাংলাদেশের বড় অংশীদার। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে আব্দুল মোমেন পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘চীনের কাছে টাকা আছে যা আমাদের দরকার’। অন্যদিকে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্তানকে বিবেচনায় রেখে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।