গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির সংবাদ যে প্রভাব ফেলে

মো. বজলুর রশিদ
মো. বজলুর রশিদ মো. বজলুর রশিদ , লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।
প্রকাশিত: ০৯:২৭ এএম, ০২ জুলাই ২০২৪

গণমাধ্যমে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হওয়া প্রতিদিনের ঘটনা। এসব সংবাদ সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে। দুর্নীতি সমাজের একটি পুরোনো ব্যাধি, যা বিভিন্ন দেশের এবং সংস্কৃতির মধ্যে বিভিন্নভাবে দেখা যায়। গণমাধ্যম যখন দুর্নীতির সংবাদ প্রচার করে, তখন এটি একদিকে সচেতনতা বাড়ায়, অন্যদিকে সমাজের মধ্যে হতাশা এবং অবিশ্বাসের বীজ বপন করে।

দুর্নীতির সংবাদ সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করতে পারে। যখন জনগণ দেখে যে তাদের নেতা এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং নিজেদের স্বার্থে জনগণের টাকায় দুর্নীতি করছেন, তখন তারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে হতাশ বোধ করেন। এই হতাশা জনগণের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং সমাজের সামগ্রিক মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

গণমাধ্যমে দুর্নীতির সংবাদ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলে। দুর্নীতি অর্থনীতির জন্য একটি বড় হুমকি। যখন কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা সংস্থা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে, তখন এটি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করে। এই অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও দুর্নীতির সংবাদে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্নীতির সংবাদে প্রভাবিত হয়। দুর্নীতি একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। জনগণ যখন দেখে যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দুর্নীতিতে লিপ্ত, তখন তারা তাদের নেতাদের ওপর আস্থা হারায়। এই আস্থার অভাব জনগণের মধ্যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ কমিয়ে দেয় এবং গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এক্ষেত্রে, একটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, যেখানে নতুন রাজনৈতিক দল বা আন্দোলনগুলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে।

দুর্নীতির সংবাদ ব্যক্তি জীবনের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। মানুষের জীবনে স্থায়িত্ব এবং নিরাপত্তার বোধ দুর্বল হয়ে পড়ে। যখন মানুষ দেখে যে দুর্নীতি তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং মৌলিক চাহিদাগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে, তখন তারা নিজেদের অসহায় মনে করে। দুর্নীতির কারণে অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা সমাজের শান্তি এবং শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে।

সামাজিক মনোবিজ্ঞানেও দুর্নীতির সংবাদ প্রভাব ফেলে। মানুষ তাদের চারপাশের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে নিজেদের জীবন সম্পর্কে মতামত তৈরি করে। দুর্নীতির সংবাদ যখন নিয়মিতভাবে প্রচারিত হয়, তখন এটি সমাজে নেতিবাচক মানসিকতা ও চিন্তাধারার সৃষ্টি করে। সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যায় এবং পারস্পরিক বিশ্বাস কমে যায়। এক্ষেত্রে, সমাজে সহমর্মিতা এবং সহযোগিতার অভাব দেখা দিতে পারে।

গণমাধ্যমের ভূমিকা একটি গণতান্ত্রিক সমাজে অপরিসীম। এটি একাধারে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করে, সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি রাখে এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়। গণমাধ্যম যখন বড় বড় দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করে, তখন এর প্রভাব কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

দুর্নীতির সংবাদ সাধারণত জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। জনগণ যখন দেখে যে, তাদের কষ্টার্জিত অর্থ অসৎ উপায়ে আত্মসাৎ করা হচ্ছে, তখন তাদের মধ্যে হতাশা এবং অবিশ্বাস জন্মায়। ফলে সাধারণ জনগণ তাদের সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। এ আস্থা হ্রাসের প্রভাব এতই গভীর যে, তা সমাজের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা এবং শৃঙ্খলাও বিঘ্নিত করে। জনগণের আস্থা না থাকলে, সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্ষমতা হ্রাস পায় এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির সংবাদ জনগণের ওপর বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে। ফলে সমাজে আস্থা হ্রাস, হতাশা এবং ভীতি জন্মালেও এটি জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যমের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এক অমোঘ সত্য, যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি অমূল্য সম্পদ।

অপরদিকে, গণমাধ্যমের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রকাশ জনমত গঠনে সহায়ক হতে পারে। দুর্নীতির সংবাদগুলো যখন প্রকাশিত হয়, তখন জনগণের মধ্যে আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই আলোচনা ও বিতর্ক সমাজে সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে, যা পরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সংগঠিত হয়। এভাবেই গণমাধ্যম জনগণের মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে।

দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করে। এতে আদালতে মামলার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়। জনগণ যখন দেখে যে, দুর্নীতিবাজরা আইনের চোখে অপরাধী হলেও কার্যত তারা শাস্তি পাচ্ছে না, তখন তাদের মধ্যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস জন্মায়। এটি একটি গুরুতর সমস্যা, কারণ বিচার ব্যবস্থা একটি সমাজের ভিত্তি এবং এর প্রতি জনগণের আস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গণমাধ্যম যখন দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করে, তখন তা কখনও কখনও সমাজের মধ্যে ভীতি এবং অস্থিরতারও সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে, যদি দুর্নীতির মাত্রা খুব বেশি এবং তার প্রভাব ব্যাপক হয়, তখন জনগণ নিজেদের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই ভীতি সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি করে এবং অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতার পথও প্রশস্ত করে।

তবে, এসব নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে একটি ইতিবাচক দিকও রয়েছে। দুর্নীতির সংবাদ যখন প্রকাশিত হয়, তখন তা জনগণকে সচেতন করে তোলে এবং তাদের মধ্যে একটি নতুন ধরনের প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলে। জনগণ নিজেদের মধ্যে একত্রিত হয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামতে উৎসাহী হয়। এটি সমাজে একটি নবজাগরণের সূচনা করে, যা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে সহায়ক হতে পারে।

সংক্ষেপে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির সংবাদ জনগণের ওপর বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে। ফলে সমাজে আস্থা হ্রাস, হতাশা এবং ভীতি জন্মালেও এটি জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যমের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এক অমোঘ সত্য, যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি অমূল্য সম্পদ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।