সামাজিক আস্থার সংকট সৃষ্টি করছে দুর্নীতি
বাংলাদেশে কী প্রায় সব ক্ষেত্রে সামাজিক আস্থার সংকট দৃশ্যমান? ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চলে মানুষের আস্থায়। নানা প্রকার দুর্নীতি আর কেলেংকারিতে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক কমে গেছে এখন। সরকারি অফিস গুলোতে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারের কারণেও তাদের প্রতি আস্থা কম। মানুষ ধরে নিয়েছে যে, একটা ন্যায্য কাজের জন্যও সরকারি-আধা সরকারি দপ্তরে গেলে হয় ঘুষ দিতে হবে, নয়তো প্রভাবশালী হতে হবে।
সামাজিক আস্থা বলতে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যের প্রতি মানুষের আস্থা বোঝায়। একটা সময় বলা হত যে, আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল শ্রম এবং পুঁজি। এখন বলা হচ্ছে, উন্নয়নের জন্য শ্রম বা পুঁজির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সামাজিক আস্থা। সামাজিক আস্থার মূলে এই কুঠারাঘাত এসেছে দুর্নীতির কারণে।
দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি যোগ থাকে সরকারি কর্মকর্তাদের। কিন্তু দেশ তো চালায় রাজনীতিবিদরা। সরকারি কর্মীরাও পরিচালিত হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে নির্দেশে। তাই দিনশেষে সব দুর্নীতিই আসলে রাজনৈতিক দুর্নীতি। রাজনৈতিক নেতৃত্বে দুর্বলতা, উদাসীনতা আর প্রশ্রয়ে সরকারী কর্মীরা যেমন দুর্নীতি করেন, তেমনি উভয়ের যোগসাজসেই বেশি দুর্নীতি হয়। একটি সামাজিক সামাজিক সমস্যা হিসাবে দুর্নীতি কতটা ভয়াবহ তা নির্ণয় করা সহজ নয়। কিন্তু বুঝতে কষ্ট হয় না যে, এ ধরনের দুর্নীতি বৃহত্তর সমাজ এবং সমাজ কাঠামোর উপর যেসব অভিঘাত সৃষ্টি করে, সেগুলো ভয়ংকর।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের আসল গভীরতা ও ব্যাপ্তি আমাদের অনুমানের চেয়েও ঢের বেশি। কিন্তু আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি। ভয় হয় দুর্নীতির কারণে যেভাবে সামাজিক বৈষম্য এবং অসহিষ্ণুতা মারাত্মক চেহারা নিচ্ছে, যে অনাস্থা তৈরি হচ্ছে তা আমাদের না জানি কোন ক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়।
রাজনীতি আর আমলাতন্ত্রের যোগসাজসে যে দুর্নীতি হচ্ছে তার কারণে সামাজিক আস্থায় ফাটল ধরছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সরকারি অফিসের উপরে আমাদের যে আস্থা, ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় তা আর নেই বললেই চলে। এর ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যকারিতা এবং প্রাসঙ্গিকতা বিপুল ভাবে হ্রাস পাচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলির মান অত্যন্ত সঙ্গীন হয়ে পড়ছে।
একজন মেধাবী ছাত্র যখন ভাল ফলাফল করেও রাজনৈতিক কারণে বা অর্থ লেনদেন করতে না পারায় বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষক হতে পারেনা তখন সমাজ একজন ভাল শিক্ষককে হারায়। এরকম করে মেধাবী এবং যোগ্যদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ফিরিয়ে দেয়ার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ এবং প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে বেড়ে গেছে মধ্যমেধার রাজত্ব।
এর ফলাফল মারাত্মক। বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ আসতে থাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠান শুধু নয়, এখানে যারা চাকরি করেন, তাদের দিকেও মানুষ অনাস্থা নিয়ে তাকাচ্ছে আজ। ধরেই নেয় এরা ঘুষ দিয়ে চাকরি বাগিয়েছে এবং এরা ঘুষ খায়। এতে করে দু’একজন ভাল কর্মীও অভিযোগের বাইরে থাকে না। একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এতে করে বেসরকারি খাতও এই ধারণার বাইরে থাকছে না। এখন ধরেই নেয়া হচ্ছে যে, একজন একজন সফল ব্যবসায়ী মাানেই তিনি সফল হয়েছেন অসৎ উপায়ে, সরকারি কর্মকর্তাদের ‘নজরানা’ দিয়ে।
এই অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হওয়ার কারণ দুর্নীতিবাজ এবং অদক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আজ বহুমাত্রিক দুর্নীতির কারণে আন্তঃব্যক্তিক আস্থায়ও ঘুণ ধরাচ্ছে। আমরা এখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করছি না, সবাই সবাইকে সন্দেহ করছি। দুর্নীতি আমাদের একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখতে শেখায় বলেই আমাদের মধ্যে এক রকমের আদিম মানসিকতা গড়ে ওঠে, যা সর্বক্ষণ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের স্বার্থপর ও আত্মসর্বস্ব হতে বলে। এই ধরনের মানসিকতাই রাজনৈতিক চরমপন্থা, আন্তঃগোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, এবং বিভিন্ন মতাদর্শিক গোষ্ঠীর মধ্যে মেরুকরণের মতো ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি সৃষ্টি করেছে।
রাজনীতির সাথে সরকারী দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মসংস্কৃতির নিবীড় সম্পর্কের কারণে সমাজ ভেঙে যাচ্ছে। নদী ভাঙনের মতো করে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সব নীতি নৈতিকতা। একটা গোটা সমাজ আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে আছে। সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও বর্গের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের নেটওয়ার্ক থাকা এবং এর যথাযথ কার্যকারিতা একটা গোটা সমাজের সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেউ ভাবছে না এই সুস্থতা নিয়ে।
আমরা তো বেশি করে সামাজিক পুঁজির কথা বলি। এর মৌলিক দুটি দিক হলো মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি মানুষের আস্থা। যে সমাজে এই দুই ধরনের বিশ্বাসের মাত্রা যত বেশি, সামাজিক পুঁজির নিরিখে সেই সমাজের অবস্থা তত উন্নত। আজ চারদিকে এত বেশি দুর্নীতির কথা উচ্চারিত হওয়ায় সামাজিক পুঁজির সব স্তম্ভকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের আপামর মানুষ আজ একটা ক্ষতবিক্ষত সমাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। শুধু কিছু মানুষের প্রবৃদ্ধি আর গড় মাথাপিছু আয় দিয়ে শাসন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থনৈতিক সঙ্কটের আসল গভীরতা ও ব্যাপ্তি আমাদের অনুমানের চেয়েও ঢের বেশি। কিন্তু আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি। ভয় হয় দুর্নীতির কারণে যেভাবে সামাজিক বৈষম্য এবং অসহিষ্ণুতা মারাত্মক চেহারা নিচ্ছে, যে অনাস্থা তৈরি হচ্ছে তা আমাদের না জানি কোন ক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল।
এইচআর/এএসএম