বিশ্ব পারিবারিক চিকিৎসক দিবস

পারিবারিক চিকিৎসা পদ্ধতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে

ডা. রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল
ডা. রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল ডা. রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল , সহযোগী অধ্যাপক
প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ১৯ মে ২০২৪

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও আজ (১৯ মে) উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব পারিবারিক চিকিৎসক দিবস। ২০১০ সাল থেকে সারা বিশ্বে প্রতিবছর বিশ্ব পারিবারিক চিকিৎসক দিবস পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব পারিবারিক চিকিৎসক সংস্থা (ওয়ার্ল্ড অরগানাইজেশন অব ফ্যামিলি ডক্টরস) দিবসটি চালু করে। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ সোসাইটি অব জেনারেল ফিজিশিয়ানস বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক চিকিৎসকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন, বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প, র্যালি ও আলোচনা সভা।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে পারিবারিক চিকিৎসক পদ্ধতি বা জিপি সিস্টেম প্রচলিত আছে। পারিবারিক চিকিৎসক এবং জেনারেল ফিজিশিয়ানস একই। যুক্তরাষ্ট্রে পারিবারিক চিকিৎসক এবং যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে জেনারেল ফিজিশিয়ানস হিসেবে পরিচিত। এই সিস্টেমে প্রতিটি এলাকার জন্য একটি নিদিষ্ট জেনারেল ফিজিশিয়ানস বা জিপি সেন্টার থাকে। ওই এলাকার সকল মানুষ যে কোনো অসুস্থতায় ওই সেন্টারে যান। এই সেন্টারেই সকল ধরনের চিকিৎসা হয়।

উক্ত সেন্টারের জেনারেল ফিজিশিয়ানস বা পারিবারিক চিকিৎসক যদি রোগীকে রেফার করেন তবেই শুধুমাত্র রোগী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাতে পারেন বা হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন। হাসপাতালে বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিয়ে উক্ত রোগী আবারও তার জিপি সেন্টারে ফিরে আসেন এবং সেখানে বাকি চিকিৎসা ও ফলোআপ সম্পন্ন হয়। এটি খুবই সুন্দর একটি সিস্টেম, কারণ মানুষের যত প্রকার রোগ আছে তার শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ একজন জিপি বা পারিবারিক চিকিৎসকের চিকিৎসায় সুস্থ হওয়া সম্ভব।

জিপি সিস্টেমে অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা জিপি সেন্টারে হওয়ায় হাসপাতাল এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রোগীর ভিড় তেমন থাকে না। এসব হাসপাতাল পরিচালনায় ব্যয় অনেক কমে যায় এবং জটিল রোগীদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত সময় পান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। পারিবারিক চিকিৎসক একজন ব্যাক্তির ব্যক্তিগত সামগ্রিক এবং সকল সময় (যে কোনো দুর্যোগ, মহামারি) চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে থাকেন।

মূলত পারিবারিক চিকিৎসকদের উপর একটি দেশের জনগণের সুস্বাস্থ্য ও সুচিকিৎসা নির্ভর করে। পারিবারিক চিকিৎসকদের এই কর্মকান্ডের স্বীকৃতি প্রদানের জন্যই ওয়ার্ল্ড অরগানাইজেশন অব ফ্যামিলি ডক্টরস ২০১০ সাল থেকে ১৯ মে বিশ্ব পারিবারিক চিকিৎসক হিসেবে পালন করা শুরু করে।

আমাদের দেশে সরকারিভাবে পারিবারিক চিকিৎসক বা জিপি সিস্টেম নেই। তাই যে কোনো অসুস্থতায় প্রথমেই ওষুধের দোকানদার বা নন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক বা সরাসরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হোন রোগীরা। এতে করে রোগীদের যেমন অপচিকিৎসা বা ভুল চিকিৎসা হবার সম্ভাবনা বেশি হয় অপরদিকে সরাসরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা নেয়ায় ছোট ছোট অসুস্থতার জন্যও অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় হয়।

এছাড়াও সকল রোগী (সর্দি, কাশি থেকে জটিল রোগী) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা হাসপাতালে আসায় জটিল রোগীরা যথেষ্ট সময় ও গুরুত্ব পান না। এই বিষয়গুলোর কথা মাথায় রেখে রোগীদের স্বল্পমূল্যে সঠিক চিকিৎসা দিতে বাংলাদেশ সোসাইটি অব জেনারেল ফিজিশিয়ান্স বেসরকারি উদ্যোগে জিপি সেন্টার মডেল 'ডাক্তারখানা' প্রতিষ্ঠা করে। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ডাক্তারখানা যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে সারাদেশে মোট ১৮৪ টি ডাক্তারখানা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ডাক্তারখানা একটি নির্দিষ্ট এলাকার সকল মানুষের প্রয়োজনীয় সকল চিকিৎসা প্রদান করছে এবং ওই এলাকার মানুষ ডাক্তারখানার সেবায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সেসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডাক্তারখানা প্ৰতিদিন গড়ে ১ হাজার ৫০০ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। ডাক্তারখানার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো প্রতি ৬ হাজার পরিবারের জন্য একটি জিপি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হলে চিকিৎসা সেবা মানুষের একদম হাতের নাগালে চলে যাবে এবং এসডিজি টার্গেট পূরণ হবে।

বাংলাদেশর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে আলাদা। এখানে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, এরপর ইউনিয়ন সাব সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতাল। মানুষ অসুস্থ হলে কমিউনিটি ক্লিনিকে যাবেন। এরপর সেখানে সুস্থ না হলে ইউনিয়ন সাব সেন্টারে গিয়ে জেনারেল ফিজিশিয়ানসকে দেখাবেন, এরপর উপজেলা-জেলা- মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করবেন রোগীর অবস্থা অনুযায়ী। এই সিস্টেমে স্বাস্থ্য সেবার অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে, কারণ ইউনিয়ন লেভেলের ৮০ ভাগ রোগের চিকিৎসা হবে।

শুধু জটিল রোগীগুলোই হাসপাতালে ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাবে, চিকিৎসা ব্যয় ও জটিলতা কমবে। তবে এসব বাস্তবায়নের জন্য দরকার দক্ষ জনবল, দরকার জেনারেল ফিজিশিয়ানস বা পারিবারিক চিকিৎসক তৈরির যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং সেন্টারগুলোর সার্ভিস মনিটরিং। ডাক্তারখানা স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে একটা পথ দেখিয়ে দিয়েছে, এই পথকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা। একমাত্র সরকারই পারবে উন্নত দেশের আদলে জিপি-রেফারেল সিস্টেম তৈরি করে স্বাস্থ্য সেবা মানুষের দোড় গোড়ায় পোঁছে দিতে। তাহলে একদিকে যেমন রোগীদের দুর্ভোগ কমবে, সময় বাঁচবে, খরচ কমবে তেমিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যথেষ্ট সময় নিয়ে জটিল রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারবেন।

চিকিৎসকরা রোগীদের জন্য কম সময় দেন-এ অপবাদও ঘুচবে। সার্বিকভাবে উন্নত হবে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, আমাদের রোগীদের আর চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে না। দেশেই মিলবে সুন্দর ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবা। আশা করি সরকার পারিবারিক চিকিৎসা পদ্ধতির গুরুত্ব অনুধাবন করে, এ পদ্ধতি বাস্তবায়নে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, প্রাইম মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠাতা- ডাক্তারখানা।

এইচআর/এমএস

আমাদের দেশে সরকারিভাবে পারিবারিক চিকিৎসক বা জিপি সিস্টেম নেই। তাই যে কোনো অসুস্থতায় প্রথমেই ওষুধের দোকানদার বা নন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক বা সরাসরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হোন রোগীরা। এতে করে রোগীদের যেমন অপচিকিৎসা বা ভুল চিকিৎসা হবার সম্ভাবনা বেশি হয় অপরদিকে সরাসরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা নেয়ায় ছোট ছোট অসুস্থতার জন্যও অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় হয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।