চলমান তাপপ্রবাহ এবং আমাদের করণীয়

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৪৪ এএম, ০৫ মে ২০২৪

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাবেদ হোসেন ও মোঃ মমিন ইসলাম

যখন কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাক আসে তখন তা চলে আসে মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এর কারণ ও প্রতিকার নিয়ে চলতে থাকে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ। কে কতটা দায়ী তা নিয়েও উঠে চায়ের কাপে ঝড়। এবং তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। বস্তুনিষ্ঠ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা-সমালোচনা থেকে সাধারণ মানূষ পায় সঠিক তথ্য এবং নীতি নির্ধারকগণ পায় নির্দেশনা। অন্যথায় ভুল তথ্য ও উপাত্ত প্রচারে সকলেই হয় বিভ্রান্ত।

সাম্প্রতিক রুদ্র আবহাওয়ার পরিপ্ররেক্ষিতে কিছু আলোচনা এমন ভাবে হচ্ছে যেনো ঢাকা শহর তথা বাংলাদেশ এই তাপপ্রবাহের উৎস এবং এর সমাধানও একক ভাবে ঢাকার হাতে। ফলে তাপপ্রবাহ শুরুর প্রথম দিকেই অর্থাৎ এপ্রিল মাসের শুরুতেই দেখা গেলো বৃক্ষরোপণ করতে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বৃক্ষরোপণ করতে হয় বর্ষা মৌসুমে তথা আষাঢ় মাস থেকে। তা নাহলে উদ্ভিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।

বস্তুত, আমাদের তাকাতে হবে এই সমস্যার গভীরতা এবং ব্যাপকতার দিকে। বর্তমান তাপদাহ বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের একটি অন্যতম অভিঘাত মাত্র। বাংলাদেশ্র মত আরও অনেক উন্নয়নশীল দেশ এই অভিঘাতের গুরুতর শিকার হলেও এর জন্য বেশি দায়ী শিল্পোন্নত দেশ। এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত প্রয়াস। এক দিনে এর সমাধান সম্ভব নয়।

এখন আসা যাক বিদ্যমান তাপপ্রবাহের বিস্তৃতি কতটুকু, কারণ কী এবং এর জন্য দায়ী কে? সাধারণত মে মাসের শেষ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হয় যার ফলে হয় মৌসুমী বৃষ্টিপাত। আবার প্রাক-মৌসুমী বায়ুর ফলে এপ্রিল-মে মাসে হয় কালবৈশাখী ঝড়সহ কিছুটা বৃষ্টিপাত। যেটা এ বছর হচ্ছেনা বলেই এই তীব্র খড়া। মৌসুমী বায়ূ যদি দক্ষিণ দিকে বেশি সময় অবস্থান করে তাহলে বাংলাদেশ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়। মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হলে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং বৃষ্টিপাতের কারণে দিন এবং রাতের তাপমাত্রার পার্থক্যও কমে আসে।

বর্তমানে বৃষ্টিপাত না হওয়ার প্রধান কারণ হলো এল-নিনোর প্রভাব যা মূলত মহাসামুদ্রিক বায়ু প্রবাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাই বর্তমান তাপপ্রবাহ দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার একটি বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে বিদ্যমান যা ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়া পর্যন্ত।

উল্লেখ্য, বিশ্বখ্যাত অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতোপূর্বে এ বছরের এই তাপপ্রবাহ সম্পর্কে আগাম সতর্ক বার্তা প্রচার করেছিল। দক্ষিণ এশিয়ার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে আবার কিছু অঞ্চল আছে যেখানে এই তাপপ্রবাহের তীব্রতা তুলনামূলকভাবে বেশি। তার মধ্যে রয়েছে ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর ও ঢাকা।

ভৌগোলিকভাবে এ অঞ্চলগুলো প্রায় লাগোয়া। সুতরাং অত্র এলাকার তাপপ্রবাহের কারণও প্রায় একই। তাপদাহের এই আঞ্চলিক তারতম্যের জন্য উল্ল্যেখযোগ্য নিয়ামকগুলোর মধ্যে রয়েছে ভৌগোলিক অবস্থান, বায়ু প্রবাহ ইত্যাদি। তাছাড়া শহরাঞ্চলের তাপপ্রবাহের জন্য দায়ী কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বৃক্ষ নিধন, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, নগরায়ণ, শিল্পায়ণ, ইত্যাদি। কংক্রিটের রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো এবং কাঁচের তৈরি দালান যা “হিট আইল্যান্ড” হিসেবে কাজ করে তা স্থানীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে থাকে।

তাহলে প্রশ্ন আসে তাপপ্রবাহের কারণ কী? তাপপ্রবাহের প্রধান কারণ দুটি; একটি হল তাপমাত্রা এবং অপরটি আর্দ্রতা। বর্তমান বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের পিছনে রয়েছে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া। আর আর্দ্রতার কারণ হলো ভূ-পৃষ্ঠের বাষ্পীভূত এবং উদ্ভিদ থেকে প্রস্বেদিত পানি। আবার পানির এই দুই উৎসই বৃষ্টিপাতের জন্য অপরিহার্য। বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকা সত্ত্বেও বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণ হলো মেঘ সৃষ্টি না হওয়া।

সুতরাং বলা যায় ভূ-পৃষ্ঠের যে অঞ্চলে উন্মুক্ত জলাধার এবং বৃক্ষরাজি বেশি থাকবে সেখানে জলীয়বাষ্পও বেশি তৈরি হবে। ফলে তাপপ্রবাহের মাত্রাও বেশি থাকবে। কারণ বাতাসের জলীয় বাষ্পের কণাসমূহ সূর্য থেকে আগত বিকিরণ সরাসরি শোষণ করে আবার ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত বিকিরণও শোষণ করে। এতে পানির কণাসমূহ নিজে উত্তপ্ত হয় এবং তাপ ত্যাগ করে পরিবেশকেও উত্তপ্ত করে তোলে।

অন্যদিকে জলীয়বাষ্প না থাকলে সূর্য থেকে আগত বিকিরণ বাধাহীন হয়ে ভূপৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে আবার আকাশে চলে যায়। অর্থাৎ বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্প অন্যতম একটি গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে কাজ করে। আর বাতাসের আর্দ্রতার জন্য প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে প্রাণিকূল অধিক তাপমাত্রা অনুভব করে যাকে “ফিল লাইক” তাপমাত্রা বলা হয়। এই কারণে মরুভূমিতে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও আর্দ্রতা কম থাকায় “ফিল লাইক” অবস্থা থাকে না। ফলে মরুভূমিতে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও তুলনামূলকভাবে তাপদাহ কম অনুভূত হয় যেটা আমাদের এই অঞ্চলে বেশি হয়।

উদ্ভিদরাজি প্রয়োজনীয় জলীয়বাষ্প তৈরি করে বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে। সুতরাং বনভূমি রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বনভূমি ধ্বংস করা মানে বিপর্যয় ডেকে আনা। এছাড়া যে অঞ্চলে উদ্ভিদরাজি রয়েছে সে এলাকার মাটি হয় উর্বর। আর এ কারণেই আমাদের এই অঞ্চলের জমি পৃথিবীর অন্য অনেক অঞ্চল থেকে উর্বর এবং সুজলা-সুফলা।

সাম্প্রতিক তাপদাহের সময় “দেশী বনাম বিদেশী” গাছের একটি বিতর্কেরও অবতারণা শুরু হয়েছে। যা অহেতুক মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। এই তাপপ্রবাহের সাথে তথাকথিত “বিদেশী” গাছের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও প্রচার করা হচ্ছে। যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। “দেশী” এবং “বিদেশী” শব্দ দুটি কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের রাজনৈতিক সীমানা দিয়ে নির্দিষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাংলাদেশ, ভারত আর মিয়ানমার প্রত্যেকেই একে অন্যের কাছে বিদেশী। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো যে উদ্ভিদটি এই যে কোনো একটি দেশে জন্মায় তাকে কি আমরা প্রতিবেশ বিজ্ঞানের ভাষায় বিদেশী বলবো? যে গাছটি ভারতে জন্মায় সেটি বাংলাদেশে জন্মালে এমন কোনোও কারণ নেই যে তা বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে।

প্রকৃতির কোনো উদ্ভিদ কিংবা প্রাণির রাজনৈতিক সীমানা নেই। যেখানে উপযুক্ত পরিবেশ নেই সে নিজেকে সেখানে খাপ খাওয়াতে পারে না আর যেখানে পারে সেখানে অভিযোজিত হয়। অনেক উদ্ভিদ রয়েছে যা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দেখা যায়। এদেরকে বলা হয় কসমোপলিটান। এদের অভিযোজন ক্ষমতা বেশি এবং বিস্তৃত। যেমন ইউক্যালিপ্টাস। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এদের দেখা যায়।

অনেক উদ্ভিদ মানুষের প্রয়োজনে কিংবা অনিচ্ছাকৃত কারণে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং অভিযোজিত হয়েছে। যেমন আমাদের দেশের ফসল উৎপাদনকারী অধিকাংশ প্রজাতি অন্য দেশ থেকে আসা। আবার সৌন্দর্য্যবর্ধনকারী উদ্ভিদও সারা পৃথিবীতে একই কারণে ছড়িয়ে পড়েছে। যার কারণে কিছু শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদ পৃথিবীর প্রায় সব শহরাঞ্চলে সাধারণভাবে দেখা যায়।

এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। একই কারণে ঢাকা শহরে যে উদ্ভিদসমূহ আছে তা আমাদের জীববৈচিত্রের অংশ। সুতরাং চলমান তাপদাহের সাথে তথাকথিত “বিদেশী” গাছপালার সংশ্লিষ্টতা আছে বলে যে প্রচার করা হচ্ছে তা সম্পুর্নরূপে তথ্য-উপাত্তহীন এবং অবৈজ্ঞানিক প্রপাগান্ডা। এ ধরণের প্রচারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রকৃতির এই নিরীহ প্রজাতিসমূহ সম্বন্ধে মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে। এবং এদেরকে মানুষের কাছে শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর প্রতিটি প্রজাতি লক্ষ লক্ষ বছরের পরিক্রমায় সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা নিরন্তর অক্সিজেন সরবরাহ, কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ এবং প্রস্বেদনের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে।

সুতরাং চলমান এই বৈরি তাপদাহ পরিস্থিতিতে সবার উচিত করণীয়সমূহ যথাযথভাবে পালন করা। বিশেষ করে এই মুহূর্তে প্রয়োজন স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিসমূহ যথাসম্ভব এড়িয়ে নিরাপদে থাকা। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা।

সর্বোপরি বলা যায় পরিবর্তিত বৈশ্বিক জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রের সক্ষমতা অর্জন করা অতি জরুরি। শহর থেকে গ্রামাঞ্চল সব জায়গায় তাপপ্রবাহ কিংবা শৈত্য প্রবাহের সময় সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য টেকসই পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এখনই। বর্তমান তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি যেন হয় ভবিষ্যতে প্রস্তুতির লক্ষ্যে আমাদের জন্য শিক্ষা।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাবেদ হোসেন, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ এবং মোঃ মমিন ইসলাম, লেকচারার, আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস

উদ্ভিদরাজি প্রয়োজনীয় জলীয়বাষ্প তৈরি করে বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে। সুতরাং বনভূমি রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বনভূমি ধ্বংস করা মানে বিপর্যয় ডেকে আনা। এছাড়া যে অঞ্চলে উদ্ভিদরাজি রয়েছে সে এলাকার মাটি হয় উর্বর। আর এ কারণেই আমাদের এই অঞ্চলের জমি পৃথিবীর অন্য অনেক অঞ্চল থেকে উর্বর এবং সুজলা-সুফলা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।