ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা
আজ ১লা মে, মহান মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। ইসলামের শ্রমিকের মর্যাদা অপরিসীম।
ইসলাম এমন একটি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায় যেখানে থাকবে না ভেদাভেদ ও বৈষম্য। শ্রমিক-মালিকের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে এমনই একটি শান্তিময় পরিবেশ গড়ার শিক্ষা দেয় যেখানে একে অপর যেন ভাই ভাই রূপ ধারণ করে।
ইসলাম যেহেতু শান্তি ও কল্যানের ধর্ম তাই যা কিছুতে শান্তি ও কল্যাণ আছে তা-ই ইসলাম করতে উৎসাহিত করে। ইসলাম কখনো এই শিক্ষা দেয় না যে, জোর-জুলুম করে অপরের মাল ভক্ষণ কর। কারণ এতে কল্যাণ নেই।
মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমজীবীর উপার্জনই উৎকৃষ্টতর যদি তা সৎ উপার্জনশীল হয়’ (মুসনাদ আহমদ)।
মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের শ্রমের ওপর জীবিকা নির্বাহ করে তার চেয়ে উত্তম আহার আর কেউ করে না। জেনে রাখ, আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজের শ্রমলব্ধ উপার্জনে জীবিকা চালাতেন’ (বুখারি, মেশকাত)।
একজন সৎকর্মী শ্রমিক যখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে তখন আল্লাহপাক তার প্রতি এতই সন্তুষ্ট হন যে, তার গোনাহ মাফ করে দেন। এ ব্যাপারে হাদিসে উল্লেখ আছে যে, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শ্রমজনিত কারণে ক্লান্ত সন্ধ্যা যাপন করে সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তার সন্ধ্যা অতিবাহিত করে’ (তিবরানি)। একজন সৎকর্মশীল শ্রমিকের জন্য এর চেয়ে আনন্দ ও আশার বাণী আর কি হতে পারে?
ইসলাম যেমনভাবে শ্রমের প্রতি উৎসাহ জুগিয়েছে এবং একে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছে তেমনিভাবে কাজ-কর্ম না করে সমাজ ও দেশের বোঝা হয়ে থাকাকে খুবই অপছন্দ করে। এছাড়া পরিশ্রম না করে ভিক্ষার হাত প্রসারিত করাকেও ইসলাম অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায় হিসেবে অভিহিত করেছে। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করবে সে আল্লাহর সঙ্গে এমনভাবে সাক্ষাৎ করবে যে, তার চেহারায় এক টুকরো গোস্তও থাকবে না’ (বুখারি, মুসলিম)। এছাড়া ভিক্ষালব্ধ খাদ্যকে হজরত নবি করিম (সা.) ‘অগ্নিদগ্ধ পাথর বলে অভিহিত করেছেন’ (মুসলিম)।
তাই পবিত্র ধর্ম ইসলামে শ্রমিকের কাজকে সর্বোচ্চ মূল্য দেয়া হয়েছে। হজরত রাসুল পাক (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার মজুরি পরিশোধ কর।’ ‘শ্রমিক-মালিক ভাই ভাই, মালিকের রক্ষক হল শ্রমিক। শ্রমিকের প্রতি জুলুম করা হলে ভয়াবহ অভিশাপ লাগবে।’
মহানবি (সা.) আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজে নিজে রোজগার করে জীবন পরিচালনা করেন, আল্লাহ তার প্রতি খুশি। একবার হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর কাছে কোন এক সাহাবা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোন ধরণের উপার্জন শ্রেষ্ঠতর? উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, নিজের শ্রম দ্বারা অর্জিত উপার্জন।
আজ আমরা দেখতে পাই শ্রমিকরা তাদের শ্রম ঠিকই দিচ্ছেন কিন্তু মালিক পক্ষ সঠিক পারশ্রমিক দিচ্ছেন না আর এর ফলে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে।
ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থা পৃথিবীর সব রকমের সমস্যার প্রকৃত সমাধান এখানে রয়েছে। ইসলাম তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ গঠন করতে মানুষকে শিক্ষা দিয়ে আসছে। আর ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্টই হলো ন্যায়বিচার এবং শ্রমিকের মর্যাদাকে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। ইসলামের দৃষ্টিতে একজন শ্রমিক মালিকের কাজের দায়িত্ব নিয়ে এমন এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যা শুধু তার সংসার নির্বাহের জন্য নয় বরং আখেরাতের সফলতা অর্জন করার ক্ষেত্রেও এ দায়িত্ব বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
তাই ইসলামে মালিক ও শ্রমিকের ওপর আবশ্যক বিধিমালা উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করেছে। কেননা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই যেকোনো বিষয়ে সঠিক ফয়সালা হতে পারে। শ্রমিকদের সম্পর্কে হজরত রাসুল (সা.) বলেছেন, যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার মধ্যে ঈমানও নেই। সুতরাং শ্রমিকের উচিত, তাদের ওপর অর্পিত দায়ীত্ব ও কর্তব্য বিশ্বস্ততার সঙ্গে সুসম্পন্ন করা।
শ্রমিক ভাইদেরও কিছু গুণ থাকা চাই, যেমন শক্তি, যোগ্যতা, সততা ও আমানতদারী। কোন শ্রমিক যদি তার অপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে মজুরী আদায় করে তাহলে হাশরের ময়দানে তাকে কঠিনভাবে আল্লাহপাকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অপর দিকে শ্রমিকের প্রতি মালিককে পরম সহানুভূতিশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে শরিয়ত।
হজরত রাসুল করিম (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শ্রমিককে দিনে সত্তরবার হলেও ক্ষমা করো।’ রাসুল পাক (সা.)-এর জীবনভর খেদমত করেছেন হজরত আনাস (রা.)। তিনি বলেন, ‘আমার দীর্ঘ খাদেম জীবনে রাসুল (সা.) কখনও আমাকে ধমক দিয়ে কথা বলেননি।’
সুতরাং শ্রমিকের প্রতি মালিকের এমন আচরণ কোনোভাবেই সঙ্গত নয়, যা তার জন্য শারীরিক বা মানসিক কষ্টের কারণ হয়। শ্রমিকের মজুরি এবং মর্যাদা সম্পর্কে হুজুর পাক (সা.) বলেছেন, আমি রোজ কেয়ামতে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হব, প্রথম হলো যে আমার নামে প্রতিশ্রুতি করেছে অথচ তা রক্ষা করেনি, দ্বিতীয় যে ব্যক্তি স্বাধীন লোককে বিক্রয় করে তার মূল্য ভোগ করেছে আর তৃতীয় হলো যে ব্যক্তি স্বাধীন মজুরের দ্বারা সম্পূর্ণ কাজ করিয়ে তার মজুরি প্রদান করেনি।
এ জন্য শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি আমাদেরকে নজর দিতে হবে। কারণ যে দেশে শ্রমিকরা সুখী সে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। আমাদের দেশের গার্মেন্টস ও শিল্পকারখানার মালিকরা যদি ঠিকমতো শ্রমিকদের বেতন ও মজুরি পরিশোধ করেন তাহলে হয়তো আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় কলকারখানায় ভাংচুর, আগুন, মারা-মারি, রাস্তা-ঘাট বন্ধ এসব আর দেখতে হতো না।
মালিকদের উচিত শ্রমিকদের খোঁজ-খবর নেয়া, তাদের সুখ-দু:খে পাশে গিয়ে দাঁড়ানো।
আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
[email protected]
এইচআর/এএসএম