এক জায়গায় সবাই একাকার!
ছেলেবেলার এক বন্ধু এসেছিল আমাদের বাসায় বেড়াতে। বহুদিন আগে সে এই রাজধানীতে এসেছিল। তখন রাস্তাঘাট এত উঁচুনিচু ছিল না। তাই বাসা চিনতে কষ্ট হতো না। এবার দুপুর বেলা কমলাপুরে ট্রেন থেকে নেমে সিএনজি স্কুটারে করে বাসার কাছাকাছি এসেও বাসা খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই মোবাইল ফোনে বার বার কল দিচ্ছিল। সিএনজিওয়ালা বন্ধুটির অসহায়ত্ব বুঝে ফেলে বোধহয় মওকা খুঁজছিল কিভাবে তার যাত্রীর সাথে প্রতারণা করা যায়। আড়াইশ’ টাকার ভাড়া মেটাতে গিয়ে খুচরা টাকা না থাকায় একটি এক হাজার টাকার নোট এগিয়ে দেয়। সে আবার আমাকে কল দেয়ার সময় সিএনজিওয়ালা একহাজার টাকার নোটটি নিয়ে বাকি টাকা ফেরত না দিয়ে দ্রুত স্কুটার চালিয়ে পালিয়ে যায়! এই, থামো থামো বলে বাকি টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি।
এরকম চুরি, ছ্যাঁচড়ামি, হাইজ্যাকিং, প্রতারণা, জালিয়াতি, দুর্নীতি আমাদের সমাজের নিত্যদিনের ঘটনা। এসব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষ বাহিনীরা তদারকিতে দিনরাত ব্যস্ত রয়েছেন। এজন্য বিভিন্ন প্রকারের দুর্নীতিদমনকারী সংস্থার কার্যক্রম প্রচলিত রয়েছে। তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা হচ্ছে কি-না তা পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে আরো অনেক গোয়েন্দা উইং।
সব ধরনের প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে পরিদর্শন বিভাগ নামক শাখা রয়েছে। কিন্তু দমনকারীরাই যখন দুর্নীতিবাজ হয়ে যায় তখন সমস্যা আরো জটিলতর রূপ ধারণ করে ফেলে। সেগুলো পরিদর্শনের জন্য নিয়োজিত রয়েছেন শত শত পরিদর্শক। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে নিজস্ব পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রয়েছে স্কুল কলেজ পরিদর্শন শাখা-উপশাখা। সহকারী শিক্ষা পরিদর্শকগণ মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচি তদারকি করে থাকেন। এজন্য তাদের ট্যুর প্রোগাম নির্ধারণ করা হয়। গণমাধ্যমে দেখা গেছে, এই ট্যুর প্রোগাম ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপার ঘটছে। এসব ট্যুর প্রোগাম করতে যাওয়া বেশ লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় এটা বিক্রয় করার মতো পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে।
কারণ, এখানে নাইকে হ্যাঁ বা মন্দটাকে ভাল বলে রিপোর্ট প্রদান করলেই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। ফলে কর্মস্থলে অনুপুস্থিত থেকেও চাকুরি করা যায় অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি, ভবন, খেলার মাঠ, ল্যাবসুবিধা না থাকলেও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি মেলে। এসব অনুমতি মেলার পেছনের শক্তিকে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করে দেন দুর্নীতিবাজ দায়িত্বশীলরা।
দেশে ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে বহুলাংশে পরিচালিত হচ্ছে বড় বড় নির্মাণকাজগুলো। অনেক ঠিকাদারের ঠিকাদারী সনদ নেই। অনেকের সনদ আছে কিন্তু ভেজাল অথবা ধার করা। এখানে কাজ প্রাপ্তির আগে টাকা ভাগবাটোয়ার বিনিময়ে কাজ বাগানো হয়। অভিজ্ঞ একজনের নাম ভাঙ্গিয়ে অনভিজ্ঞ আরেকজন বা বহুজন সেসকল কাজের অংশীদার সেজে কাজ করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সমাপ্ত করতে না পেরে সরকারী অর্থের অপচয় ঘটিয়ে বাজে বাড়িয়ে দেবার আন্দোলনের নামে কাজ বন্ধ করে রাখেন। এটা আমাদের দেশের নির্মাণ সরকারী কাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এজন্য জাপান বা মালয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের দেশে নির্মাণ কাজের খরচ বেশী গুণতে হচ্ছে।
এখনও নতুন পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে কালক্ষেপণ সমস্যা টাকা ছাড়া সমাধান হবার নজির নেই। সরকারী চাকুরি পেতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হেনস্তা হবার ঘটনা আমাদের দেশে স্থায়ী রুপ লাভ করেছে। এজন্য একজন বিসিএস ক্যাডারকেও প্রমোশনের জন্য ভেরিফিকেশন রিপোর্ট পেতে অবৈধ অর্থ খরচ করার নজির রয়েছে।
কিছুদিন আগে একজন এমপি ঘোষণা দিলেন তার ১ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা নির্বাচনী খরচের কথা! যেটা নির্বাচন কমিশনের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার কথা। কিন্তু নিক সেটাকে পাশ কাটিয়ে গেছেন!
এসব লেখা নিয়ে যখন ভাবছিলাম তখন হঠাৎ মাথায় বজ্রাঘাতের মতো একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকের প্রথম পাতায় সংবাদ শিরোনাম এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিল। তা হলো- সাবেক র্যাবের এক মহাপরিচালকের অর্থিক নিয়মের বিষয়টি। পত্রিকাটিতে নানা অনিয়মসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি, ফ্লাট, স্থাপনা ক্রয় এবং একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট তৈরির জন্য ছবিসহ নানাতথ্য।
পত্রিকাটি আবাদী জমিতে রিসোর্ট তৈরির জন্য লিখেছে, ‘কেনা জমির কয়েকজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্রমাগত চাপ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেন। ভয়ভীতিতে কাজ না হলে ভেকু দিয়ে জমির মাটি নিয়ে যেতেন। গভীর গর্ত করে শেষ পর্যন্ত জমি বিক্রি করতে বাধ্য করতেন। পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন পদে থাকায় তাঁর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি জমির মালিকরা।’
দলবাজ অপরাধীরা সবসময় দলের কৃপা ও দয়া পেয়ে ছাড় পাবার নিয়ম আমাদের কৃষ্টিতে নতুন করে বিকশিত হচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে হেডলাইন সংবাদ বের হলেও তাদের বিরুদ্ধে তদন্তেও দুদকের ধীরগতির কথা সংবাদে প্রচরিত হচ্ছে। ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের’পক্ষে রাজনৈতিকভাবে একচোখা ও দলকানা নীতিও সাড়ম্বরে চালু হয়ে গেছে। তাই এখন শুধু অপেক্ষা এসব মেগা-অপরাধমূলক ঘটনার প্রেক্ষিতে কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয় তা দেখার।
পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘শুধু তাই নয়, রিসোর্টটির নিরাপত্তায় পাশেই বসানো হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থায় উন্নতি না হলেও এই রিসোর্টে প্রবেশ স্বাচ্ছন্দ্য করতে সাত কিলোমিটার সড়ক পাকা করা হয়েছে সরকারি খরচে।’
এছাড়া সাবেক ওয়াসা এমডি, কতিপয় সাবেক ভিসি, মহাপরিচালক ইত্যাদির দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির খবর বেশ চাউর হলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়াতে খুবই ধীরগতি লক্ষ্যণীয়। এদেশে ছাত্র সংসদের নেতা হওয়া বেশ লাভজনক। তাই ছাত্রনেতা হবার দৌড়ে লবিং, তোয়াজ-তোষণ, তোড়জোর, নির্বাচনী প্রচার খরচের বাহুল্য পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে কি-না তা জানা যায়নি। দেশের টেকনিক্যাল ও গবেষণাধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতির বাইরে রাখার আহ্বান কেউ কর্ণপাত করছেন না।
দেশের সিংহভাগ আমলা ও রাজনীতিবিদরা সন্তানদেরকে বিদেশে পড়াশুনার জন্য পাঠান। স্কলারশিপ ছাড়া বিদেশে পড়ার এত টাকা একজন সরকারী চাকুরে কিভাবে যোগাড় করেন? একসময় রেলে কালো বিড়াল ছিল বলে তৎকালীন মন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেই কালো বিড়ালের অস্তিত্ব ডিজিটাল টিকেটসহ গোটা রেল পরিবহন ব্যবস্থাপনায় এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, ‘কালো বিড়াল বনের মধ্যে বসতি গেড়েছে।’
কিন্তু আমার তো মনে হয় কালো বিড়াল দেশের সব জায়গায় ওৎ পেতে থেকে গোঁফে তা দিচ্ছে। তাদের গায়ে ঢিল ছোঁড়ার কেউ নেই। কারণ, এই পৃথিবীতে যে যত বড় অপরাধী তার নেটওয়ার্ক তত বেশী শক্তিশালী। এর সাথে থাকে সমকালীন রাজনৈতিক যোগাযোগ ও ভাবাটোয়ারা অর্থনীতির যোগসাজশ। পদবীধারী ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা’ চটকদার কথা বলে নানা কায়দায় জাল বিস্তার করে ভয়ভীতি দেখিয়ে অসহায় মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে নিজেদের ভোগবিলাসের পথ প্রশস্থ করছে। বিপদ আঁচ করে এসব মাফিয়া স্মার্টরা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আরো বেশী প্রচারে অর্থ খরচ করে ও মেগাদুর্নীতি শুরু করে দিয়েছে।
দুর্নীতির বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। কেউ যদি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন, দুদক তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’.. আইনে প্রভাবশালী নিয়ে কিছু বলা নেই। সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীরও দুর্নীতির বিচার হয়েছে। সুতরাং যে কারো দুর্নীতির বিষয়ে দুদক চাইলে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘.. কারো বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির তথ্য উঠে এলে অবশ্যই সরকারকে গুরুত্বসহকারে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরের এ বিষয়ে বিশদভাবে অনুসন্ধানে নামা উচিত। তিনি আরো বলেন, সরকারের যেকোনো পর্যায়েই চাকরি করুন না কেন বৈধ উপায়ে কোনোভাবেই এত সম্পদ অর্জন করা সম্ভব নয়। ..যদি সত্যিই এত সম্পদের মালিক হয়ে থাকেন, সেটি বিস্ময়কর। ...তার দুর্নীতির পুরো চিত্র উন্মোচন করা উচিত। কারণ আইন সবার জন্য সমান।’
অন্য এক পত্রিকায় বলা হয়েছে, এব্যাপারে ‘...অনেকে ষড়যন্ত্র বা সন্দেহও প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু তাতে কারো দুর্নীতি কিংবা রাজকীয় আবাসস্থল, রিসোর্ট, বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ার এসবকে তো আর বায়বীয় বলা যাবে না। একজন সরকারি চাকরিজীবী, যার মাসিক বেতন এক লাখ টাকাও নয়, সে কিভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের এত সম্পদের মালিক হলেন? এমন প্রশ্নের জবাব তো দেশের মানুষ চাইতেই পারে।’
সেদিন এক ভিক্ষুক প্রচন্ড গরমের মধ্যে দড়িতে পা বেঁধে রাজপথে বস্তা গায়ে গড়াগড়ি দিয়ে শুয়ে থালা পেতে ভিক্ষা করছে.. নিকটস্থ এক দোকানী ব্যক্তি দীর্ঘসময় সেটা পর্যবেক্ষণ করে তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বললে সে রাজী হয়নি। কিন্তু একটি লাঠি হাতে নিয়ে তাড়া করতেই সেই ভিক্ষুক উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেল। এদের সাথে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজ ও মেগা-অপরাধীদের অমিল কোথায়? মিল একজায়গায় অবশ্যই আছে। তা হলো ভিক্ষুকরা ভিক্ষার পয়সা দিয়ে চাঁদা দেয় মাস্তানদেরকে। আর বড় অপরাধীরা বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেশের নীতিনির্ধারকদের।
আসলে ছোট-বড়, ভদ্র, স্মার্ট, সব দুর্নীতিবাজরা এক জায়গায় সবাই একাকার হয়ে গেছেন। তা হলো অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন। স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, চাঁদাবজি, পরিদর্শণ, পরবী, জালিয়াতি, চুরি, ভেজালকরণ ইত্যাদি যেন সবার মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলবাজ অপরাধীরা সবসময় দলের কৃপা ও দয়া পেয়ে ছাড় পাবার নিয়ম আমাদের কৃষ্টিতে নতুন করে বিকশিত হচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে হেডলাইন সংবাদ বের হলেও তাদের বিরুদ্ধে তদন্তেও দুদকের ধীরগতির কথা সংবাদে প্রচরিত হচ্ছে। ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের’পক্ষে রাজনৈতিকভাবে একচোখা ও দলকানা নীতিও সাড়ম্বরে চালু হয়ে গেছে। তাই এখন শুধু অপেক্ষা এসব মেগা-অপরাধমূলক ঘটনার প্রেক্ষিতে কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয় তা দেখার।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। [email protected]
এইচআর/জেআইএম