মাটির টানে জ্ঞানের সন্ধানে
বাংলাদেশের মানুষ ভাগ্যের সন্ধানে যেমন শহরে পাড়ি জমায় তেমনি আবার উৎসবে আনন্দে গ্রামে যায়। বিশেষ করে দুই ঈদে মানুষের প্রিয়জনের সান্নিধ্যে যাওয়ার সেকি প্রাণাকর চেষ্টা। মওকা বুঝে বাস মালিকদের ভাড়া বৃদ্ধি, রেলের টিকিটের জন্য রাতভর অপেক্ষা, সড়ক মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট ইত্যকার কষ্টকর নানা সমস্যা উজিয়ে ঘরে ফেরার আনন্দই হয়ে ওঠে মুখ্য। আসন্ন রমজানের ঈদ সামনে রেখেও একই চিত্র দৃশ্যমান।
মানুষজন প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ছুটছে নাড়ির টানে। ঠাঁই নেই, তবুও যেতে হবে। বাস, ট্রেনের কামরায় ভেতরে দাঁড়িয়ে, সেখানে ঠাঁই না হলে ছাদে। লঞ্চেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্লোরে বসে, ডেকে দাঁড়িয়ে এমনকি ছাদের ওপর বিছানা পেতে সেখানেই গন্তব্যের জন্য বসে পড়া। ঈদ সামনে রেখে প্রতি বছর একই অবস্থা হয়। যেভাবেই হোক বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। এ টান যে বড়বেশি প্রাণের। এ টান নাড়ির। দুনিয়ার কোথাও কি মানুষ এভাবে ছুটে প্রাণের টানে, শেকড়ের সন্ধানে? কীসের এতো মায়া? কীসের জন্য মানুষের এই ঘরে ফেরার আকুতি? সেকি কেবলই প্রিয়জনের সান্নিধ্য? নাকি তারও অতিরিক্ত অন্যকিছু?
কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ হয় কী মায়া গো, কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামকে দেখার জন্য আকুতি? ইট-কাঠ-পাথরের এই শহর ছেড়ে মুক্তভাবে শ্বাস নেওয়ার জন্য? নাকি জীবনানন্দের বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার মতো ‘দুদণ্ড শান্তির’ জন্য এই যাত্রা? যারা গ্রাম থেকে শহরে আসে তাদের প্রাণটা আসলে পড়ে থাকে গ্রামেই। বিশেষ করে যারা গ্রামে বড় হয়েছেন। এই নাগরিক জীবন হয়তো অনেক কিছু দেয়। শিক্ষা-দীক্ষা, ভাত-কাপড়, রুটি রোজগারের নিশ্চয়তা। অনেক উত্তেজনা। ভোগ বিলাস আনন্দ। কিন্তু জীবনের সব পাওয়া, সব তৃষ্ণা কি মেটে তাতে? কিছুই কি বাকি থাকে না?
এই শহরে তো দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ নেই, জোয়ার ভাটায় দোলে ওঠা নদী নেই, বৃক্ষের শ্যামল ছায়া নেই, ধানের ক্ষেতে রোদ ও ছায়ার লুকোচুরি খেলা নেই, ঘাসের ডগায় শিশির নেই, রাখালের বাশের বাঁশি নেই, গোধূলির আলো নেই, বাউকুড়ানির ডগায় ঝরাপাতার নৃত্য নেই, পাখির কলকাকলি নেই, পিঠেপুলি পাটিসাপটার আয়োজন নেই, আউল, বাউল জারি সারি, ভাটিয়ালির হৃদয় উদাস করা সুর নেই, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ নেই, নেই এক চিলতে উঠোন । এইসব নেই-এর পাল্লা এতটাই ভারী যে তা লিখে শেষ করার নয়।
সে জন্যই কি আমাদের ছুটে চলা? গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথে পায়ে ধুলো মাখিয়ে হাঁটার জন্য? নাকি আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে এসব কথা? মানুষ কী আর এত হিসাব নিকেশ করে চলে। কয়েকটা দিন ছুটি পেলাম আর কোথাও ঘুরে এলাম- এই রকম তো। আটপৌরে বাঙালি। কোথায় আর যাবে। বেড়ানোর কী ফুরসত আছে? যে মাইনে আর রোজগার তাতে সংসারের হাঁড়ি টানতেই তো সব যায়। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া সামাল দিতেই তো হিমশিম খেতে হয়। সে জন্য বিদেশ বিভূঁই নয়, ‘ঘর হতেই আঙিনা বিদেশের মতো’ দেশের বাড়িতেই (নিজগ্রাম) ঈদ করা। কিন্তু সেই গ্রামও কি আর আগের মতো আছে?
নাগরিক সুযোগ সুবিধার অনেকখানিই পাওয়া যায় এখন গ্রামে বসেই। বিদ্যুৎ পৌঁছেছে বেশির ভাগ গ্রামেই। সেজন্য বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন। এমনকি ডিশ লাইন থাকায় মুম্বাই-কলকাতা ঢাকার চেয়েও কাছের। সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন । কম্পিউটার, সাথে ওয়ারলেস ইন্টারনেট সংযোগ।
মফস্বলে দৈনিক পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা এখন হাতে লিখে, ফ্যাক্স করে সংবাদ পাঠান না। কম্পিউটারে কম্পোজ করে ইন্টারনেটে ই-মেইলের মাধ্যমে দ্রুত তারা পাঠিয়ে দেন খবরাখবর। ব্যবসা-বাণিজ্যের খবরও চলে মোবাইলে। মৎস্য চাষী, পোল্ট্রি ফার্মের মালিক কিংবা সবজি চাষী মোবাইলে জেনে নেন কেমন বাজার যাচ্ছে ঢাকায়। এভাবে ভার্চুয়াল একটা যোগাযোগ তো আছেই গ্রামের সঙ্গে শহরের। শহরের সঙ্গে গ্রামের। কিন্তু তাতেও তো সব হয় না। দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে?
এর জন্য তো আসল দুধই চাই। আর সেটি পেতে হলে তো ‘গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু’র দেশে যেতে হবেই। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে গ্রামের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাটা এখনো আশানুরূপ নয়। এ জন্য ঘরমুখো মানুষজনকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। কিন্তু তাতে কি? যেতে তো হবেই।
শিশির ভেজা সবুজ ঘাস, ছোটবেলার স্কুলে যাওয়ার মেঠো পথের স্মৃতি, হাডুডু আর ফুটবল খেলার মাঠ কিংবা টাকার অভাবে পড়তে না পারা স্কুলজীবনের সেই সহপাঠীর প্রিয়মুখ ফিরে দেখার আনন্দ কোথায় পাওয়া যাবে এই শহরে। পাশের বাড়ির সাপের ফনার মতো বেণী দুলানো দুরন্ত সেই কিশোরীর হাসি কোথায় মিলবে এই শহরে।
এই শহরে নির্ভেজাল জীবনান্দ কোথায়? এখানে যেন মানুষ নয়, শোষক আর শোষিত, আমলা আর কামলা (মজুর), মালিক-শ্রমিক, পুঁজিপতি আর নিঃস্ব, হাইরাইজ বিল্ডিং বনাম রেললাইনের পাশের বস্তির বিস্তর ব্যবধানের মধ্যে সরকার কিংবা বিরোধী দলের শিলপাটার ঘষাঘষির রাজনীতির মধ্যে বসবাস। জীবন কোথায় এখানে?
সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে, তার থেকে অন্ধকার দূর করতে হলে পাঠাগার হতে পারে অন্যতম আলোকবর্তিকা। এজন্য ঈদে যারা গ্রামে ফিরবেন বিশেষ করে বিত্তবান মানুষরা প্রচেষ্টা চালাতে পারেন নিজ নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আজকের একজন তরুণ-তরুণী যেন বইয়ের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
চারদিকে ঠগ, প্রবঞ্চক, প্রতারক, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি। কী নির্মম, কী পাশবিক এই জীবনধারা। যানজট আর জনজটে রাস্তায় চলাই দায়। ঘুষখোর কর্মকর্তা ইলিশ কেনে ১০-১৫ হাজার টাকা হালি, আর সাধারণের পুঁটি কিনতেই নাভিশ্বাস। নব্য গজিয়ে ওঠা কোটিপতি গার্মেন্টস মালিকের ড্রয়িংরুমে শোভা পায় হরিণ কিংবা ডোরাকাটা বাঘের চামড়া, লাখ লাখ টাকার শোপিস ইত্যাদি। অথচ গার্মেন্টসকর্মীদের তিন হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ঠিক মতো দিতে তারা গলদঘর্ম হয়ে যান।
ওইসব খেটে মানুষের জীবনেও ঈদ আসে। তারাও ঘরে ফেরে। শরীরের প্রায় শেষ শ্রমটুকু নিঙ্ড়ে দিয়ে তাদের যখন ছুটি মেলে ফেরার নিশ্চয়তাটুকুও নেই। মধ্যরাত পর্যন্ত বাক্স-পেটরা হাতে রাস্তার পাশে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। অথচ এদের ঘাম-শ্রমের বিনিময়েই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে।
রেমিট্যান্সপ্রবাহ জিডিপির হার বাড়ায়, যা এই দেশকে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছেন আর এখন এইসব জীবনযোদ্ধা দেশ গড়ছেন। আসলে এই যে এতসব ঝক্কিঝামেলা সহ্য করে ঘরে ফেরা এটাও তো দেশপ্রেমেরই অংশ। আমরা তো আমাদের মায়ের কাছেই ফিরি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ফিরে চল মাটির টানে যে মাটি/ যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে...’।
দেশও তো মায়ের সমতুল্যই। মা ছাড়া আর কারও জন্য কি এভাবে জীবন বাজি রাখা যায়? একাত্তরে যা করেছে বীর বাঙালি। মনে রাখা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ উন্নত একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল সবার সম অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সে জন্যই আমাদের মাটির টানে ফিরে যেতে হবে। মূলে, দেশের জন্মসূত্র একাত্তরে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। জ্ঞানের আধার হচ্ছে পাঠাগার। গ্রন্থাগার হচ্ছে লেখক, পুস্তক ও পাঠকের সম্মিলনস্থল। সভ্যতার দর্পণ। একটি দেশ তথা সমাজের সার্বিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্রও এই পাঠাগার। সমাজের বিত্তবান অনেকেই আছেন যারা তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করেন। পাঠাগার হতে পারে এর জন্য উত্তম জায়গা।
সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে, তার থেকে অন্ধকার দূর করতে হলে পাঠাগার হতে পারে অন্যতম আলোকবর্তিকা। এজন্য ঈদে যারা গ্রামে ফিরবেন বিশেষ করে বিত্তবান মানুষরা প্রচেষ্টা চালাতে পারেন নিজ নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আজকের একজন তরুণ-তরুণী যেন বইয়ের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য পাড়া মহল্লায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
সমাজের সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে পাঠাগার। কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে আমরা আমাদের সমাজটাকে যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধাররূপে গড়ে তুলতে পারব ততই সমাজ এগিয়ে যাবে। একটি উন্নত সমাজ ব্যবস্থায় উৎসব হবে আরও আনন্দময় এবং অর্থপূর্ণ। শেকড়ের টানে ঘরে ফেরাও তখন সার্থক হবে। আমাদের লক্ষ্য হোক সেই দিকে। সবার ঘরে ফেরা নিশ্চিত ও নির্বিঘ্ন হোক সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এমনটিই প্রত্যাশিত।
লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক।
[email protected]
ফারুক/জেআইএম