মাহে রমজান
যে রোজা জান্নাত লাভের নিশ্চয়তা দেয়
আজ মাহে রমজানের নাজাতের দশকের চতুর্থ দিনের রোজা আমরা অতিবাহিত করছি। আল্লাহপাকের ভালোবাসা লাভ করার সর্বোত্তম মাধ্যম হলো রোজা। কেননা রোজা কেবল মাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই রাখা হয় আর এর পুরস্কারও স্বয়ং আল্লাহতায়ালাই দিয়ে থাকেন। রমজানের ফরজ রোজা বা অন্যান্য দিনের নফল রোজা, যে রোজাই হোক না কেন তা আমাদের আত্মার সংশোধনের কারণ হয়ে থাকে। আর বিশেষ করে পবিত্র মাহে রমজানের রোজা আমাদের পুরো বছরের দোষত্রুটি ক্ষমার কারণ হয়।
মানুষ যখন আল্লাতায়ালার জন্য জাগতিক আরাম-আয়েশ, চাওয়া পাওয়া ইত্যাদি থেকে বিরত থাকে তখন সে তার নাফসকে পুণ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে অধিক শক্তি পায়। কিন্তু এ বিষয়টি স্মরণ রাখা উচিত, রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য কেবল উপবাস থাকা নয়। যদি উপবাস থাকার ফলে খোদার জান্নাত পাওয়া যেত তাহলে প্রতিটি ব্যক্তি এ জান্নাত পাওয়ার চেষ্টা করতো। কেননা উপবাস থেকে মৃত্যু বরণ করে নেওয়াটা তেমন কোন কঠিন বিষয় নয় বরং কঠিন বিষয় হলো আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক পরিবর্তন সাধন করা।
রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, মানুষের নাফস অর্থাৎ আমাদের আত্মা যেন পবিত্র হয়। তিনি চান মানুষ যেন রোজার মাধ্যমে সকল প্রকার পাপ কাজ পরিহার করে হৃদয়কে পাক পবিত্র এবং পরিষ্কার করে ধৌত করেন। এমন হৃদয় যে হৃদয়ে খোদার জ্যোতির বিকাশ ঘটবে।
এছাড়া এই রোজার মাধ্যমে মানুষের শারীরিক, চারিত্রিক, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক সকল প্রকার কল্যাণও লাভ হয়। যেভাবে বাহ্যিক খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমরা শারীরিকভাবে শক্তি লাভ করি ঠিক তেমনি রোজার ফলে আমাদের রুহ বা আত্মায় শক্তি লাভ করে আর এই শক্তির বলে একজন মুমিন তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। আমাদের রোজা তখনই আত্ম সংশোধনের কারণ হবে যখন সকল প্রকার মন্দ পরিহার করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রোজা রাখব। আমাদের প্রিয়নবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা এবং এর ওপর আমল করা থেকে বিরত থাকেনা আল্লাহতায়ালার জন্য তার উপবাস থাকা এবং পিপাসার্ত থাকার কোন প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ তার রোজা রাখা বেকার বলে গণ্য হবে’ (বুখারি, কিতাবুস সওম)।
মোটকথা, রোজা শারীরিক সুস্থতারও কারণ আর আধ্যাত্মিক দিক থেকেও এর অনেক কল্যাণ রয়েছে। রোজার মাধ্যমে আমরা অনেক ধরনের মন্দ থেকে বাঁচতে পারি এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারীও হতে পারি। এছাড়া রোজার মাধ্যমে আমরা গরিবদের দু:খ কষ্টের বিষয়টিও অনুধাবন ও অনুভব করতে পারি আর সেই সাথে তাদেরকে সাহায্য করার অনুভূতি হৃদয়ে সৃষ্টি হয়। পবিত্র রমজান মাস আমাদের মাঝে এজন্যই বার বার আসে, যেন আমরা আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জন করতে পারি, পাপ থেকে বিরত থাকতে পারি, নিজেদের মাঝে আধ্যাত্মিক শক্তি এবং ধৈর্য সৃষ্টি করতে পারি, গরিবদের খেয়াল রাখতে পারি, অভাবীদের অভাব পূরণ করতে পারি এবং নিজের নাফসের অর্থাৎ আত্মার আত্মশুদ্ধি করি।
সুতরাং এটি হলো পবিত্র ও বরকতময় রমজানের মূল বাণী, রমজানের মাধ্যমে আমাদের আত্মা যেন হয়ে যায় সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। তারাই ধন্য, যারা এই বাণীকে উপলব্ধি করে এবং আল্লাহতায়ালার হুকুম অনুযায়ী চলে রমজানের দিনগুলো অতিবাহিত করে।
কানজুল উম্মালের এক হাদিসে এসেছে, হজরত নবি করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে জেনে বুঝে পাপ করে বা কোন মুমিনকে নিয়ে কুৎসা রটনা করে, কোন নেশাদ্রব্য ব্যবহার করে তাহলে আল্লাহতায়ালা তার সমস্ত আমলকে নষ্ট করে দিবেন। সুতরাং তোমরা পবিত্র রমজান মাসে খোদা ভীতি অবলম্বন কর। কেননা এটি আল্লাহতায়ালার পবিত্র মাস’।
ইসলামের মূল উৎস কুরআন করিম। এতে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘হে যারা ইমান এনেছ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)।
উল্লিখিত আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, কেবল ইসলামের সাথেই রোজার সম্পৃক্ততা সুনির্দিষ্ট নয়, বরং কুরআন করিম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ধর্মগুলোতেও রোজাকে একটি ধর্মের বিশেষ অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
তবে একমাত্র ইসলাম ধর্মেই এই উপবাস ব্রতের মধ্যে নবরূপ ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য তুলে ধরেছে। ইসলাম পরিপূর্ণ ধর্ম। তাই ইসলামেই রোজাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে একে পালনের জন্য ফরজ করা হয়েছে এবং এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
পবিত্র রমজান মাসের রোজা, রোজাদারের যাবতীয় পাপ ধূইয়ে মুছে সাফ করে জান্নাত লাভের নিশ্চয়তা প্রদান করে। যেভাবে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত নবি করিম (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাস, আন্তরিকতার ও উত্তম ফল লাভের বাসনায় রমজান মাসে রোজা রাখে, তার পূর্বের সর্বপ্রকার পাপ ক্ষমা করা হবে’ (বুখারি, মুসলিম)।
এছাড়া হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়, রোজা ধৈর্যের অর্ধেক আর ধৈর্য্য ইমানের অর্ধেক। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মাঝে রমজানের রোজা মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে বান্দার সাক্ষাৎ লাভের অতি উত্তম স্তম্ভ হিসাবে পরিগণিত। আর এ জন্যই আল্লাহর বাণী হাদিসে কুদসির মাধ্যমে হজরত নবি করিম (সা.) বলেছেন: ‘সম্মান ও মর্যাদার প্রভু আল্লাহ বলেন, মানুষের অন্যসব কাজ তার নিজের জন্য। কিন্তু রোজা একান্তই আমার জন্য এবং আমি এর জন্য তাকে পুরস্কৃত করব’।
রমজানে রোজা পালনের ফলে প্রত্যেক রোজাদার ধৈর্যের চূড়ান্ত নমুনা প্রদর্শন করে থাকেন। হাদিসে কুদসি হতে জানা যায়, হজরত মহানবি (সা.) বলেছেন: ‘আল্লাহ বলেন, রোজাদার তার ভোগ লিপসা এবং পানাহার শুধু মাত্র আমার জন্যই বর্জন করে, সুতরাং রোজা আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান’ (মুসলিম)।
হজরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবি (সা.) বলেছেন: ‘শয়তান মানুষের ধমনীতে চলাচল করে। তোমরা যদি শয়তান হতে আত্মরক্ষা করতে চাও তবে রোজার মাধ্যমে তোমাদের ধমনীকে সংকীর্ণ করে দাও। বর্ণনাকারী আরো বলেন, সর্বদা জান্নাতের দরজার কড়া নাড়তে থাক, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! তা কীভাবে? তিনি (সা.) উত্তর দিলেন, রোজার মাধ্যমে’। অপর একটি হাদিস হজরত আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যখন রমজান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজা খুলে যায় আর জাহান্নামের দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং শয়তানের পায়ে জিঞ্জির পড়ানো হয়’ (বুখারি)।
প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তিকে স্মরণ রাখতে হবে, রোজা রাখার অর্থই হল কতগুলো বিষয় থেকে বেঁচে থাকা আর কতগুলো বিষয়কে বর্জন করা। রোজা পালনের মাঝে বাহ্যিকতার কোন কাজ নেই। অন্য যে কোন ইবাদত মানুষের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে কিন্তু রোজা এমন এক ইবাদত যা শুধু মাত্র আল্লাহর দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে। রোজার মূল শিকড় রোজাদার ব্যক্তির হৃদয়ে বিরাজ করে আর তা তাকওয়ার সাথে সম্বন্ধ যুক্ত।
আমাদের অন্তরে রয়েছে আশা-আকাঙ্ক্ষার একটি খনি এবং ইচ্ছা ও অভিব্যক্তির সুবিশাল প্রান্তর এবং সেখানে অবস্থান করছে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অসংখ্য প্রয়োজনীয়তার অগণিত সম্ভার। এইসব অগণিত আশা আকাঙ্ক্ষাকে ত্যাগ করে খোদার সন্তুষ্টির জন্য তার কথা মত চলাই আমাদের জন্মের উদ্দেশ্য। আমরা যদি খোদাতায়ালার হুকুম মতে চলি তাহলেই তার সন্তুষ্টি লাভ করতে পারবো আর রোজাই হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে রমজানের অবশিষ্ট দিনগুলো অনেক বেশি ইবাদতে রত থেকে অতিবাহিত করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
[email protected]
এইচআর/এএসএম