বিদ্যুতের দাম আরও ৩ বছর বাড়লে অর্থনীতির ক্ষতি কতটা?
একটি দৃশ্যকল্প ভাবুন। বাইরে খরতাপ। ঘরে ফ্যান কিংবা শীতাতপ যন্ত্র আছে, কিন্তু বন্ধ। নিরূপায় হয়ে হাত পাখা দিয়ে গায়ে বাতাস করছেন আপনি। বিদ্যুৎ নেই তাই ফ্রিজ-টিভি বন্ধ; মটরেও পানি উঠছে না। লম্বা সময়ের লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে আপনি ভাবছেন এমন বিদ্যুৎ সংযোগ থাকার কী দরকার ছিল!
আবার এ-ও ভাবছেন, ফেব্রুয়ারিতেই মাত্র বাড়তি দরের বিল পরিশোধ করেছেন। কিন্তু তাতে লাভ হলো কী? ন্যায্যমূল্যে নিরবচ্ছিন্ন ও গুণগতমানের বিদ্যুৎ পাওয়া গ্রাহকের অধিকার হলেও দেশের গ্রাম অঞ্চলে গরমকালের শুরু থেকেই কোথাও কোথাও ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
খোদ রাজধানীও এই ‘বিভ্রাট’ থেকে পুরো মুক্ত নয়। এমন চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পরিস্থিতি এমন যে, আমদানি সীমাবদ্ধতার কারণে সহসাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ঘাটতি পূরণ সম্ভব হবে না। গ্যাসের দেশি মজুতও কমছে ক্রমাগত। এদিকে, দফায় দফায় দাম বাড়ানোর পরও সময় মতো বিদ্যুৎ না পাওয়ায় উৎপাদন ও সেবা খাতের ক্ষতি যা হওয়ার তা ঠিকই কিন্তু হয়ে যাবে, হচ্ছেও তাই।
এবার আসি ভোক্তার সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে সেই বিশ্লেষণে। গত বছরের গোড়াতেই জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে ভোক্তা পর্যায়ে তিন দফায় মোট ১৫ শতাংশ দাম বাড়িয়ে জনমনে এক আতঙ্ক তৈরি করেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। যদিও নির্বাচনের আগে থেমে ছিল এই প্রক্রিয়া। নতুন সরকার দায়িত্ব নিলো। এরপর ফেব্রুয়ারির শেষে রাতেরবেলা ঘোষণা এলো- নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের সব ধরনের গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানো হলো ।
এবার বাড়ানো হয়েছে গড়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। বছরজুড়ে যেহেতু এখনো বড় অংকের ভর্তুকি দিতে হয় তাই সামনের দিনগুলো এমন মধ্যরাতের ঘোষণা আরও আসতে পারে। এরই মধ্যে নতুন মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েই দাম বাড়ানোর আগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘ঘাটতি মেটাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে, আগামী তিন বছর ধরে দাম সমন্বয় করা হবে’। তবে এই সমন্বয় মানে যে দাম বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই ।
বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করায় লোকসান হয় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি’র। এই লোকসান পূরণ করা হয় বাজেটের ভর্তুকি দিয়ে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের শর্ত আছে, বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি তুলে দিয়ে প্রকৃত দরে সরবরাহ করতে হবে।
বহুদিন ধরেই অভিযোগ আছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অব্যাহত লোকসান হচ্ছে মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেসরকারি মালিক ও ব্যবসায়ীদের অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নাম করে ‘লাগামহীন দুর্নীতি’ চলতে দেওয়া এবং সাথে ব্যবস্থাপনাগত অদক্ষতা পুষে রাখার কারণে। যদিও হিসাবের ভাষায় অতিরিক্ত খরচকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে আজ এ আলোচনায় না গিয়ে আসল কথায় আসি।
অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, পণ্যের দাম বাড়লে চাহিদা কমে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি সম্প্রতি হিসাব করে দেখিয়েছে, মোট চারবারে লাইফ লাইন গ্রাহকের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ষষ্ঠ ধাপের গ্রাহকের জন্য ২১ দশমিক ৫ শতাংশ, সেচের বিদ্যুতে ২০ শতাংশ এবং শিল্পে ২১ শতাংশ। তবে দাম বাড়ানোর ফলে বিদ্যুতের ব্যবহার কমছে কি না, কমলে তার কী প্রভাব পড়ছে জীবনমানে, শিল্পের উৎপাদন, কর্মসংস্থান কিংবা কৃষিতে? একটু পরিসখ্যানের হিসাব মেলাতে চাই।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদেই শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে বাংলাদেশে। পাহাড়ি এলাকা, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ কিংবা চরাঞ্চল কোনো এলাকাই বাদ পড়েনি বিদ্যুৎ সংযোগের সুবিধা থেকে। পাওয়ার সেলের তথ্যমতে চলতি বছরের ৪ মার্চ পর্যন্ত দেশে মোট বিদ্যুৎ গ্রাহক সংখ্যা ৩ কোটি ৫৮ লাখ। দেশজুড়ে বিতরণ সেবার বিশাল নেটওয়ার্ক থাকায় মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় ৫৫ শতাংশই যায় শুধু আবাসিক খাতে।
মানুষের আয়-উন্নতির ফলে, বাসাবাড়িতে নতুন নতুন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম যুক্ত হওয়ার ফলে, বিদ্যুতে মানুষের নির্ভরতা বাড়বে এমনটাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে অনেকদিন ধরে। এতদিন হয়েছেও তা-ই। কিন্তু বাংলাদেশ বিদুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিগত পাঁচ বছরের জনপ্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়ার প্রবণতা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। তথ্য বলছে, দেশে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ মাথাপিছু গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ৬০২ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বিতরণ পর্যায়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ সিস্টেম লস আমলে ধরলে এই পরিমাণটা আরও কমবে। ভারতে যেখানে বছরে জনপ্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় ১২৫৫ কিলোওয়াট, জাপানে ব্যবহার হয় ৭ হাজার ২২২ কিলোওয়াট।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা যে হারে বেড়েছে, সে হার চাহিদা বাড়েনি। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ও চাহিদার পার্থক্য ক্রমাগত বড় হচ্ছে। ৩০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট।
পিডিবির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেখানে বিতরণ করা মোট বিদ্যুতের ৫৩ শতাংশ ব্যবহার করতেন আবাসিক গ্রাহকরা, তার পরের বছরই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশে। কিন্তু এর পর প্রতি বছরই শতকরা হিসাবে ব্যবহার কমছে। ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে বিদ্যুৎ কেনার সামর্থ্যও বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো- আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে চার বছর ধরেই বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার, অতিরিক্ত দামের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে ব্যবহার বাড়াতে পারেনি অনেক ভোক্তা, কেউবা ব্যবহার কমিয়েছেন। বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যায়, এমন সরঞ্জামও অনেকে ঘরে তোলেন নি।
অর্থনীতির স্বার্থে অনেকে বলেন, আবাসিকের বিদ্যুতের খরচ কমানোই ভালো। এতে উৎপাদন খাতে ব্যবহার বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়। শিল্পোন্নত দেশে ওঠার স্বপ্নযাত্রায় এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু পরিসংখ্যান এই প্রত্যাশাকে সমর্থন দিচ্ছে কতটুকু? পিডিবি’র বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ৩০ দশমিক ৩৩ শতাংশ ব্যবহার করেছে শিল্পখাত, তার পরের বছরেই এটা নেমে গেছে ২৭ শতাংশে। তার মানে হলো, বিদ্যুৎনির্ভর শিল্পের চাকা কম ঘুরেছে এই সময়ে। এখানে দুটো কারণ হতে পারে- এক. কারখানাগুলো চাহিদা মতো বিদ্যুৎ পায়নি; দুই. বাড়তি দামে উৎপাদন চালু রেখে লোকসান বাড় করতে চাননি উদ্যোক্তারা।
২০২১ সালে প্রকাশ হওয়া ‘ইন্দোনেশিয়ায় বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে অর্থনীতি ও পরিবেশে এর প্রভাব মূল্যায়ন’ শিরোনামে একটা গবেষণার বরাত দিতে চাই। ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি একসময় ছোট ছিল। ১৫ বছর ধরে দেশটিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রভাব বিশ্লেষণ করে বলা হয়ছে, ১০ শতাংশ বিদ্যুতে দাম বাড়ানো হলে ব্যবহার কমে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। কর্মসংস্থান কমে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। তবে এটার একটা ভালো দিক হলো, দাম বড়লে ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপাদন কমে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
ওই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ক্রমাগত বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে বাজার থেকে উৎপাদন খাত ঝরে পড়ার শংকা তৈরি হয়। তুলনামূলক বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়, এমন অদক্ষ কারখানাগুলো কখনো একদম বসে পড়ে। দাম বাড়লে কারখানা স্থানান্তরের সুযোগ ও শঙ্কা- দুটোই একসাথে সামনে আসে এবং বিনিয়োগ প্রবণতাও নিচের দিকে নামতে থাকে। গবেষণার এ ফলাফল বাংলাদেশের জন্যও ভাবনার বিষয় বলেই মনে করি।
লেখক: চার্টাড সেক্রেটারি, অর্থ-বাণিজ্য বিশ্লেষক।
এইচআর/ফারুক/এমএস