সুপ্রিম কোর্টে যুথিকাণ্ড
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে যা ঘটলো তা শুধু দুঃখজনক নয়, আমাদের স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। পেশাজীবীদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শে ভিন্নতা আছে এবং আছে বলেই এই ফোরামগুলোতে নির্বাচন হয়। কিন্তু তাই বলে এমন কাণ্ড ঘটবে সেটা কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে ভাবা সম্ভব হচ্ছে না।
কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখছি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে না। জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ বিএনপির সহিংস বিরোধিতার সংস্কৃতি এই প্রাঙ্গণে আরও বেশি করে দৃশ্যমান হচ্ছে। বিভিন্ন সময় বিএনপির সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ আদালতের এই প্রাঙ্গণ প্রায়ই উত্তপ্ত থাকছে। তার একটা প্রভাব পড়ছে সমিতির নির্বাচনেও। কিন্তু এবার যে মারামারি হলো তা ভয়ংকরভাবে নিকৃষ্ট এবং সেটা হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলের ভিতরে।
ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে হাঙ্গামা, ভোট গণনার আগেই একজন প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করতে বাধ্য করা, বহিরাগতদের নিয়ে হামলা চালানো, একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অনেকের আহত হওয়ার ঘটনা ছিল খুবই উদ্বেগজনক।
দলমত নির্বিশেষে এ ঘটনাকে ডাকা হচ্ছে যুথিকাণ্ড নামে। খোদ সরকারদলীয় আইনজীবীরাই বলছেন, এ ন্যক্কারজনক নজিরবিহীন ঘটনার জন্য এককভাবে দায়ী নাহিদ সুলতানা যুথি। যুথি বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের প্রথম সারির একজন সদস্য, আর এ পরিষদের মূল নেতা হচ্ছেন শেখ ফজলে নূর তাপস। যুথির স্বামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ। সম্পাদক পদে নির্বাচন করতে এখানে তিনি মনোনয়ন চেয়েছিলেন কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি। তাই তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছেন। এটুকু হলেও চলতো। কিন্তু যুথি যা করেছেন তা সবাইকে হতবাক করেছে এবং সরকারদলীয় আইনজীবীদের লজ্জিত করেছে।
নির্বাচনের পর ভোট গণনা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এ সময় বিএনপি সমর্থক ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কেউ কেউ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। একপর্যায়ে নাহিদ সুলতানার নির্দেশে যুবলীগের নেতাকর্মীরা সরকার সমর্থক আইনজীবীদের ওপর হামলা করেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ উঠেছে, ফল গণনার আগেই তিনি নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপ-কমিটির আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবুল খায়েরকে বাধ্য করেছেন তাকে জয়ী ঘোষণা করতে।
আজকাল পেশাজীবীদের এসব নির্বাচনে সরাসরি দলের বিশেষ করে দল প্রধানের সম্মতিতে প্যানেল গঠিত হয়। তাই ধরেই নেওয়া যায় যে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের মতো এত বড় একটা ফোরামের নির্বাচনের প্যানেল প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিতই ছিল। সে হিসেবে বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সরকার সমর্থিত ফোরামের বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচন করেছেন যুথি এবং যুবলীগের কর্মীদের ব্যবহার করে মাস্তানি করে নির্বাচনের ফলাফল ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছেন।
এ ঘটনায় আহত ও আক্রান্ত সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এস আর সিদ্দিকী সাইফ স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথির পাশাপাশি বিএনপি সমর্থক প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস কাজলের বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ কাজলকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়। তবে হামলা ও জোর করে বিজয়ী ঘোষণার মতো অভিযোগের মূল অভিযুক্ত যুথি রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে যুথির বাসা থেকে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা যুথির হুকুম পালন করা যুবলীগ কর্মী।
এ ঘটনার পেছনে যে আরও অনেকে ছিলেন, তিনজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়াই তার প্রমাণ। যুথির ভূমিকা এবং একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় তিন সহকর্মীর অব্যাহতি প্রমাণ করে সরকারদলীয় আইনজীবীদের বিরোধটা কোন পর্যায়ে গেছে। আইনজীবীদের দলীয় রাজনীতি করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আদালত অঙ্গনে সেই দলীয় রাজনীতি টেনে এনে আদালত অঙ্গন কলুষিত করা হলো তাকে খারাপ নজির হিসেবে সবাই দেখছেন।
অনেকদিন ধরেই দেশের পেশাজীবীরা মোটা দাগে সরকারি দল আর বিরোধী দলে ভাগ হয়ে পড়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্যানেলের একটি হয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত, অন্যটি বিএনপি সমর্থিত; এতে কোনো রাখঢাকের বালাই থাকে না। এই বিভাজন আছে শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদসহ সরকারি পিয়ন থেকে সচিব পর্যন্ত সবার ভিতরে। কিন্তু আইনজীবীরা কয়েক বছর ধরে যা দেখাচ্ছেন তা ভয়ংকর।
স্বাভাবিকভাবে সব ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দলের পেশাজীবীদের দাপট থাকে বেশি। কারণ সুযোগ আর সম্পদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে প্রবল। বিরোধী পক্ষ অপেক্ষায় থাকে কবে তারা আবার ক্ষমতায় যাবে। বিএনপি তো প্রতিপক্ষ আছেই, কিন্তু টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় এই দলের পেশাজীবীরা নিজেদের ভিতর বিভক্ত হয়ে পড়েছেন আরও প্রবলভাবে। সেটা কি রকম হতে পারে তার প্রমাণ দিয়েছেন যুথি।
পেশাজীবীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ এমন এমন রূপ নিয়েছে যে, এখন চাইলেও একে আর সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এই দলীয়করণ এখন অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে। পেশাদারত্বের অবহেলা সর্বত্র এবং তার চাইতে বেশি হলো জিঘাংসা এবং নির্মূলের মানসিকতা। সেটা নিজ গ্রুপে হলেও।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/ফারুক/এমএস