বরই, খেজুর ও সাবেক মন্ত্রীর ভাষা

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ১৩ মার্চ ২০২৪

বাজারে খেজুরের দাম আকাশছোঁয়া। ধর্মীয় বিধান কি আছে সেই বিবেচনার চেয়ে আবেগের বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে এ সুযোগে। আরব মুল্লুক থেকে আমদানি করা এই খেজুরকে মনে করা হয় নবী (সা.) এর জন্মস্থান থেকে আসা পবিত্র ফল এবং ইফতারে রাসুল (সা.) খেজুর খেতেন তাই এটি সুন্নাতও বটে। আরবের খেজুর বাংলার রোজাদারের জন্য খাওয়া অপরিহার্য কি না সেই প্রশ্ন তলিয়ে দিয়েছে এ ফলের উচ্চমূল্য। উচ্চমূল্যের কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছে শুল্ক বেশি, কিনতে হয় বেশি দামে তাই বাজারে এর প্রতিফলন ঘটেছে।

এদিকে কিছুদিন আগে সরকারিভাবে বলা হয়েছে, খেজুর আমদানিক্ষেত্রে শুল্ক কমানো হয়েছে। যদিও এই কমানোর প্রভাব পড়েনি খেজুরের দামে। বরং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে রোজা শুরুর আগে থেকেই। বাজারের আগুন স্পর্শ করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সুযোগটি গ্রহণ করেছে রাজনৈতিক মাঠের নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ খেজুরের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ।

যে মুহূর্তে খেজুরের অস্বাভাবিক মূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়েছে, তখনই শিল্পমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের ফল বরই দিয়েও ইফতার খাওয়া চলে। বাতাসের গতিতে মন্ত্রীর এই কথা ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-সবাই কঠিন প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন। এই সমালোচনার মাত্রায় যুক্ত হয় অশালীন খিস্তিখেউর। শিল্পমন্ত্রীর মন্তব্যের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যারা ইফতারে খেজুর খাওয়া সুন্নত মনে করেন, তাদের কিছু মন্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় তারা মূলত বিষয়টি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন।

খেজুর অবশ্যই খাদ্যমানে উন্নত একটি ফল। এবং রাসুল (সা.) ইফতারে খেজুর খেতেন এমন তথ্য একাধিক হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং খেজুরের খাদ্যমান এবং রাসুল (সা.) এর খেজুর খাওয়া নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ নেই। তবে পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করতে হবে।

একটি অংশ আছে, যারা মনে করেন খেজুর খাওয়া সুন্নত। এবং মন্ত্রী মহোদয় সুন্নত পালন করাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় এটি। ধর্মীয় জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এ বিষয়ে আমি একজন মুফতি সাহেবের মতামত চাইলে তিনি বলেন- খেজুর অবশ্যই খাদ্যমানে উন্নত একটি ফল। এবং রাসুল (সা.) ইফতারে খেজুর খেতেন এমন তথ্য একাধিক হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং খেজুরের খাদ্যমান এবং রাসুল (সা.) এর খেজুর খাওয়া নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ নেই। তবে পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করতে হবে।

রাসুল (সা.) যা করেছেন তা যেমন সুন্নত আবার তিনি যা করেছেন তা সবই আবশ্যিক অনুসরণীয় নয়। যেমনি তিনি সেলাই ছাড়া লুঙ্গির মতো কাপড় পরতেন। তিনি যবের ছাতুও খেতেন, মাথায় শরীরে জয়তুনের তেল ব্যবহার করতেন।

এগুলো ওখানকার উৎপাদিত এবং সেখানে সহজলভ্য। তিনি এগুলো ব্যবহার করতেন তাই আমরা যদি না করি তাহলে সুন্নতের বরখেলাফ হবে এটা যৌক্তিক নয়। ইফতারে খেজুর খাওয়াকে মুফতি সাহেব সুন্নত নয় বলে মনে করেন। তবে খাদ্যমান বিবেচনায় সাধ্য অনুযায়ী খেজুর খেতে মানা নেই। এবং না খেলেও তা সুন্নত অমান্য হবে না। এই মত নিয়েও যুক্তি-তর্ক প্রকাশের সুযোগ আছে। কেউ মুফতি সাহেবের সঙ্গে ভিন্নমতও প্রকাশ করতে পারেন।

যেমনি রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানকারীদের ক্ষেত্রেও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হতে পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে কোনো ক্ষেত্রেই উগ্রতা কাম্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার দেখা মন্তব্যগুলোর অধিকাংশই মনে হয়েছে পরিপুষ্ট এবং আবেগাসৃত, কারও কারও মন্তব্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইঙ্গিত আছে। এটাও থাকতে পারে এবং সেটা অবশ্যই স্বাভাবিক বিষয়।

খেজুরের মূল্যবৃদ্ধি এবং শিল্পমন্ত্রীর পরামর্শকে কেন্দ্র করে, জাসদ (ইনু) প্রধান ও সাবেক তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর একটি মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোনার সুযোগ হয়েছে আমার। তিনি জনসমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শিল্পমন্ত্রীর বরই প্রসঙ্গটি এমন ভাষায় আক্রমণ করেছেন, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই শুধু নয়, গণমাধ্যমের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে ভাইরাল হয়।

অত্যন্ত মেধাবী এবং দীর্ঘদিন রাজনীতি করা মানুষ হাসানুল হক ইনু বরই প্রসঙ্গে শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্যে এতই ক্ষুব্ধ হয়েছেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলেছেন এমন মন্ত্রীকে যেন ‘পাছায় লাথি মেরে বের করে দেন’। তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় আরও কিছু বাক্য ব্যবহার করেন, যার দুটি হলো- ‘বরই মুখে ঢুকিয়ে দেব’ শেষ পর্যন্ত বলেছেন ‘ তুই আঙুর খাবি’।

হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদদের একজন। গত সাধারণ নির্বাচনে নিজ দলীয় প্রতীক মশাল ত্যাগ করে তিনি নৌকা মার্কায় নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন একটি সরকারে তিনি মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। গত সংসদে এমপি হিসেবেও সংসদে গেছেন।

এমন অভিজ্ঞ মানুষ কারও সমালোচনা করবেন, এটা তার অধিকার এবং জনগণ তার সমালোচনা শুনবে এমনকি সরকারও তার বক্তব্য গুরুত্বসহ বিবেচনা করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমালোচনার ভাষা যদি হয় আক্রমণাত্মক এবং অশালীন তখন বিপরীতটাই ঘটার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে যায়। বাস্তবেও তাই হয়েছে।

গণমাধ্যমে তার এ বক্তব্য প্রচারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। মানুষও শুনছে। বিশ্বাস করি,তারা বরই- খেজুরের গুণাগুণ এবং শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্যের চেয়ে ইনু সাহেবের বক্তব্যের দিকেই মনোযোগ দিয়েছে বেশি। তাদের অবশ্যই প্রশ্ন আসতে পারে-একজন মেধাবী অভিজ্ঞ বর্ষীয়ান সাবেক মন্ত্রী কি করে এমন ভাষায় তার মতো আরেকজন রাজনৈতিক নেতাকে আক্রমণ করতে পারেন। তিনি একটি দলের প্রধানই শুধু নন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধেরও বীর সৈনিক।

নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মীরা তাকে অনুসরণ করার কথা। নেতাই যদি এমন অশোভন শব্দ মাধ্যমে অন্য নেতাকে আক্রমণ করেন তাহলে কর্মীরা আরেক ধাপ নিচে নামবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেছেন তাকে ক্ষমতা দেওয়া হলে তিনি আড়াই ঘণ্টার মধ্যে চাঁদাবাজি বন্ধ করবেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি কথা বলেন।

চাঁদাবাজির ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। ফল সাধারণ মানুষ ভোগ করছে-দ্রব্যমূল্য তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায়। একজন জননেতা হিসেবে এমন বিষয় সামনে আনায় তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। এখন তার প্রতিপক্ষ যদি প্রশ্ন করে, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে কি চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছিল? কিংবা এখনকার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল?

ওই সময়ের পত্রিকাগুলো তল্লাশি করলে দেখা যাবে, চাঁদাবাজি একটি ক্রনিক ব্যাধির মতো। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন যে, রাজনীতি থাকলে চাঁদাবাজি থাকবেই। এটা তিনি যখন মন্ত্রী ছিলেন কিংবা এমপি ছিলেন তখনও ছিল এখনও আছে। চাঁদাবাজদের সমালোচনা করার সময় সবসময়ই বলা হয়, অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে চাঁদাবাজি চলছে। সুতরাং তিনি ক্ষমতা পেলে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারবেন এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ আছে কি?

খেজুরের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে, এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু মন্ত্রী যখন বলেন, দেশীয় ফল খেয়েও ইফতারি করা সম্ভব তাকেও কি উপহাস করা যায়? ইফতারিতে খেজুর খেতে হবে এমন কোনো বিধান নেই। আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ আগে কখনো ইফতারে খেজুর খেতো না কিংবা বলা চলে খেজুর কেনার মতো তাদের সমর্থ ছিল না।

খুব বেশি হলে ১৫-২০ বছর ধরে মধ্যবিত্তের পাতে খেজুরের মতো দামি ফলই শুধু নয়, আপেল কমলার মতো বিদেশি ফলও দেখা যায়। এটা ব্যক্তির সামর্থ্য বৃদ্ধিরই পরিচায়ক। এজন্য রাষ্ট্রকে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। এই মুহূর্তে ডলারের সংকটের কারণে যদি বলা হয় আমদানি করা ফলের পরিবর্তে দেশীয় ফল সংযোজন করা হোক, এটা কি উপহাসের বিষয় হতে পারে?

মন্ত্রীর বক্তব্যে এমন বলা হয়নি খেজুর আপনি খেতে পারবেন না। এমন হলে সরকার আমদানি নিষিদ্ধ করে দিতো। আর দশটা বিদেশি ফলের মতো খেজুরও বিদেশ থেকে কেনা হচ্ছে। দেশীয় ফল খাওয়া বাড়িয়ে দিয়ে আমদানিনির্ভরতা কমাতে যে কেউ পরামর্শ দিতে পারেন।

এই পরামর্শ কেউ গ্রহণ করতে পারে কেউ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করতে পারেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়া প্রকাশেরও একটা শালীনতাবোধ থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে খ্যাতিমান কারও প্রতিক্রিয়ার ভাষা আর অপসংস্কৃতিবান মানুষের ভাষায় পার্থক্যটা বজায় রাখা জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।