রোজার বাজার

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ০৯ মার্চ ২০২৪

একটা ধারণা পাকাপোক্ত হয়েছে মানুষের মাঝে যে রোজা এলে সব জিনিসের দাম বাড়বেই। বাজারে দুটি পক্ষ। একপক্ষে বিক্রেতার দল, যারা দ্রব্য বিক্রি করেন আর অন্যপক্ষ আমাদের মতো ক্রেতারা যারা সেগুলো কিনে থাকি। অর্থনীতি বলে যে, আমাদের চাহিদা আর বিক্রেতাদের জোগান অনুযায়ী স্থির হয় বাজারে পণ্য ও পরিষেবার মূল্য।

কিন্তু বাংলাদেশে এই তত্ত্ব কাজ করছে না। এখানে বিক্রেতারাই সব। তাদের ইচ্ছাতেই দাম নির্ধারিত হয়। গত কয়েক বছর ধরে নিত্যপণ্যের দাম বাংলাদেশের অস্বাভাবিক। এবং অনাদিকাল ধরে রোজা এলে আমাদের ব্যবসায়ীরা খাদ্যপণ্যের দাম আরও অস্বাভাবিক বাড়িয়ে বিক্রি করেন। এর অর্থ হলো আমাদের সদাশয় সরকার যে বাজার অর্থনীতির কথা বলে সবকিছু বাজারের ওপর ছেড়ে দায়হীন হতে চায় সেই বাজার ফেল করেছে। বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে যা ফল পাওয়া যাচ্ছে সেটা ভোক্তার পক্ষে নয়।

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের অঙ্গীকরা করা হয় বেশ বড়ভাবে। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে এই লক্ষ্যে। কিন্তু দাম কমছে না। মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ এখন অধিক শোকে পাথরের মতো কিছু বলতেও আর পারছে না।

গতকাল শুক্রবার এই লেখা যখন লিখছি তখন দেখা গেল ব্রয়লারসহ সব ধরনের মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা আর ৮০ টাকার নিচে কোনো সবজিই মিলছে না। তবে রোজার আগে বেশি বাড়ছে রোজার পণ্যের দাম। আর মাত্র চারদিন পর রোজা। ক্রেতারা ব্যস্ত রোজার বাজার করতে। কিন্তু মন্ত্রী আর নেতাদের এত এত আশ্বাসের পরও বাজারে কোনো সুখবর নেই। প্রায় সবকিছুই চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। মুরগি আর সবজির কথা তো বলাই হলো, খুচরায় চিনি ও ছোলার দামও বেড়েছে। ইফতারি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এমন সবজির দাম এখন বাড়তির দিকে। নতুন দামের বোতলজাত সয়াবিনের এক ও দুই লিটারের বোতল এখনো বাজারে আসেনি। তাতে ক্রেতাদের এখনো ক্ষেত্রবিশেষে নির্ধারিত দরের চেয়ে কিছুটা বাড়তি দরে সয়াবিন কিনতে হচ্ছে।

বাস্তবতা হলো সরকারি হাঁকডাক, বাজারে অভিযান ও মন্ত্রীদের হুঁশিয়ারির প্রভাব বাজারে খুব একটা পড়ছে না। কারণ হলো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো এবং জ্বালানি তেলের দাম কাঙ্খিত পর্যায়ে নামিয়ে আনতে না পারা। আর সিন্ডিকেট ও কারসাজির প্রভাব তো আছেই।

প্রতিবারই শোনা যায়, এবার আরও বেশি করে শুনতে হচ্ছে যে খেঁজুরের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। রমজান এলে বাজারে খেঁজুরের চাহিদা বাড়ে। ইফতারে সবাই চেষ্টা করেন খেঁজুর রাখার। বাজারে জাত ও মানভেদে নির্ধারণ হয় খেঁজুরের দাম। তবে এবার সব ধরনের খেঁজুরই চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। সংবাদমাধ্যম বলছে, গত বছরের চেয়ে এ বছর এসব খেঁজুরের দামও ৬০ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। এ ছাড়া ভালোমানের খেঁজুরের দামও বেড়েছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। গত জানুয়ারি মাস থেকেই খেঁজুরের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে।

জানুয়ারি মাস থেকেই একঠা ভাবনা ছিল যে, রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটবে তো? রোজার একেবারে কাছাকাছি এসে বোঝা গেল কাটেনি, বরং বাড়লো। মানুষ মুখের কথায় আর আশ্বস্ত হতে পারছে না। কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চেয়েছিল। পুরোনো সেই মজুদদারির কথা নতুন করে আবার শুনতে হচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী নিজে বলছেন এদের বিরুদ্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বলা হচ্ছে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলছে। গরিব মানুষের কথা একবার চিন্তা করে দেখছে না। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না। এটাই এখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিয়মিত বাজার মনিটরিং না হওয়া এবং ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক মুনাফা লোটার বিষয়কে দায়ী করেছেন সাধারণ ভোক্তারা। তবে সুযোগ থাকার পরও শুধুমাত্র সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে জ্বালানি তেলের দাম না কমানোয় বাজারের ইতিবাচক কোনো প্রভাব পড়ছে না। যদিও বৃহস্পতিবার কিছুটা কমেছে জ্বালানি তেলের দাম। ডিজেলের দাম কমেছে মাত্র লিটার প্রতি ৭৫ পয়সা যাকে মশকরা হিসেবেই দেখতে হবে ভোক্তাদের জায়গা থেকে।

পৃথিবীর সব দেশে বিভিন্ন উৎসবে জিনিসের দাম কমে। পবিত্র রমজান উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় রমজানের সব পণ্য এবং পবিত্র বড়দিন উপলক্ষে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোয় পণ্য বাজারে বিশাল মূল্য হ্রাস করে। ভারতেও আমরা পুজার সময় দাম কমতে দেখি। কিন্তু আমাদের দেশে পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টো। রমজান মাস এলেই আমাদের দেশের খুচরা থেকে মাঝারি ও বড় বড় ব্যবসায়ী সাধারণ ভোক্তাদের পকেট কাটার উৎসবে মেতে ওঠে। এ দাম বৃদ্ধির সংস্কৃতি থেকে কোনোভাবেই আমরা মুক্ত হতে পারছি না।

ব্যবসায়ীদের এসব কারসাজি সম্পর্কে সবাই অবগত। কিন্তু সরকার রোজার বাজার নিয়ে বৈঠক করলো সেই ব্যবসায়ীদের সাথেই এবং তাদের কথা মতো সিদ্ধান্ত নিল। ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত যে কোনো নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ একেবারেই নেই বাংলাদেশে। ফলে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর সরকারি নীতি নিধারণী জায়গায় পৌঁছেনা কখনও। মানুষের অধিকারের কথা ভাবলে সেটা সরকার চিন্তা করে দেখতে পারে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।