মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতেই হবে
নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর এক মাসের বেশি সময় চলে গেলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে হাকডাক করা হচ্ছে, কিন্তু মূল্য বাড়ানোর নেপথ্য কারিগরেরা কানে তুলো দিয়েই আছে।
এর মধ্যে আসন্ন রমজান মাসকে ঘিরে প্রয়োজনীয় সব নিত্যপণ্য নিয়ে শুরু হয়েছে কারসাজি। রমজান মাস আসার আগেই ব্যবসায়ীদের ‘রোজার ব্যবসা’য় লাভের হিসাব এখনই শুরু হয়ে গেছে। দেশে সরবরাহ সংকট না থাকলেও কিছু অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশ রমজানকে সামনে রেখে অল্প সময়ে বাড়তি মুনাফা তুলে নিতে নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার এবার আগেভাগে কঠোর অবস্থানে থাকলেও দাম কমছে না। এর পেছনে ঘুরেফিরে বারবার সিন্ডিকেটের বিষয় আলোচনায় উঠে আসছে। মূল্য নির্ধারণ, আমদানিতে শুল্ক সুবিধা প্রদান, তদারকি অভিযান এবং জরিমানা করার পরও সিন্ডিকেটের খপ্পর থেকে রেহাই পাচ্ছেন না ভোক্তা।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, চলতি বছরের শুরু থেকে চাল, ডাল, ছোলা, অ্যাংকর, পাম তেল, পেঁয়াজ, খেজুর, ডিম, মুরগি, গরুর মাংসসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। গত এক মাসের ব্যবধানেই পেঁয়াজের দাম ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ছোলা প্রায় ১১ শতাংশ, মসুর প্রায় ২ শতাংশ, পাম তেল ২ শতাংশ, চাল দেড় শতাংশ, খেজুর ৫৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, ডিম ৭ শতাংশ ও গরুর মাংসের দাম প্রায় সাড়ি ৭ শতাংশ বেড়েছে। টিসিবির তালিকায় না থাকলেও রোজা উপলক্ষে সামান্য চিড়া-মুড়ির দামটাও লাফিয়ে বাড়ছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোজা ঘিরে দুই মাস আগে থেকেই পণ্যের অতিরিক্ত মজুদ করছেন অসংখ্য ব্যবসায়ী। এতে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
কৃষকদের কাছ থেকে অনেক কমে কেনা আলু বেশি দামে বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিয়েছে মজুদদাররা। বর্তমানে পণ্যটির দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু একই কায়দায় পেঁয়াজে কারসাজি চলছে।
দীর্ঘসময় পর কয়েকজন ব্যবসায়ীর উদ্যোগে কমতে শুরু করেছিল গরুর মাংসের দাম। দাম কমে ৫৯০ টাকায় নেমে আসা পণ্যটির দাম মাঝে ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করতে বাধ্য হয় মাংস বিক্রেতারা। কিন্তু প্রভাবশালী চক্রের দাপটে এ দাম বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এক মাসের মধ্যেই তা বেড়ে আবারও ৭৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। মাংসের বাজারে সিন্ডিকেট এতটাই সক্রিয় যে, কম দামে বিক্রয়কারীদের হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তাছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের কাজও না। সরকারের কাজ তদারকি করা। কেউ যাতে নিত্য পণ্য মজুত করে অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা। চাহিদা, উৎপাদন, আমদানি এবং সুষ্ঠু সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় সাধনও সরকারের কাজ। রাজনৈতিক সরকার সাধারণত তাই করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এখন রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি। দুচারজন যদি অন্য পেশার মন্ত্রী থাকেনও তারাও কোনো না কোনোভাবে ব্যবসায়ীদের প্রভাববলয়েই আছেন। ফলে মন্ত্রীরা জনগণের স্বার্থের চেয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বেশি দেখবেন, এটাই স্বাভাবিক। মানুষ তার শ্রেণি স্বার্থের বাইরে খুব একটা যেতে পারে না। সেজন্যই সরকারের ওপর জনস্বার্থ রক্ষার অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ সফল হয়েছে- এমন কথা আমরা বলতে পারবো না।
কয়েক বছর ধরেই উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের নামে দেশের সর্বত্র এক ধরনের স্বেচ্ছাচার চলছে। কোথাও কোনো নিয়ম-নীতির বালাই নেই। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজর নেই সেখানেই অন্যায়, সেখানেই অনিয়ম। সরকারি কেনাকাটায় অর্থ লুটপাটের সামান্য যেসব খবর বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে, তাই তো রীতিমতো পিলে চমকানোর মতো। হাজার টাকার মাল লাখ টাকায়, লাখ টাকার মাল কোটি টাকায় কেনা হয়েছে।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ দেশে যে লুটপাটের অর্থনীতি চালু করেছিলেন, এখনও তারই ধারাবাহিকতা চলছে। কান পাতলে বাতাসে নানা রকম কথা শোনা যায়। ব্যাংকের টাকা লোপাট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন-অপশাসনের কথা বললে এখন মানুষ বর্তমান সময়ের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরে বিব্রতকর সব কথা বলতে ছাড়েন না। মানুষের হাতে এখন নানা উপায়ে তথ্য হাজির হচ্ছে। সত্য ঘটনার সঙ্গে মিশেল হচ্ছে গুজবের।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না, কিছু সংখ্যক মানুষের হাতে দেশের সব সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে, সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক লক্ষ মানুষ এখন সব সুখভোগের অধিকারী। সৎ ও ছোট ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা ব্যাংকে গিয়ে দুচারদশ কোটি টাকা লোন পেতে ব্যাপক হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, বিদেশে টাকা পাচার করে বিলাসী জীবন যাপন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-মন্ত্রীর অর্থবিত্তের বিবরণ শুনলে হা হয়ে থাকতে হয়। নির্বাচনের আগে হলফনামায় এমপি, মন্ত্রীরা সম্পদ বৃদ্ধির যে বিবরণ দিয়েছেন, তা তো আর বিরোধীদের বানানো গল্প নয়। কীভাবে এত সম্পদ হলো? সম্পদ গোপন করা যায় না। সম্পদের একটা আলাদা গরম আছে, জৌলুশ আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাম্প্রতিক প্রায় সব বক্তৃতায় অবৈধ সম্পদ উপার্জনের বিরুদ্ধে বলছেন। কিন্তু যারা অসৎ পথে হাঁটা শুরু করেছে, যারা টাকা কামানোর সহজ পথের সন্ধান পেয়েছে, সুপরামর্শে তারা সেপথ ছাড়বে না। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতে হয়। শেখ হাসিনাকে এখন আঙ্গুল বাঁকাতেই হবে। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে।
দীর্ঘসময় পর কয়েকজন ব্যবসায়ীর উদ্যোগে কমতে শুরু করেছিল গরুর মাংসের দাম। দাম কমে ৫৯০ টাকায় নেমে আসা পণ্যটির দাম মাঝে ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করতে বাধ্য হয় মাংস বিক্রেতারা। কিন্তু প্রভাবশালী চক্রের দাপটে এ দাম বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এক মাসের মধ্যেই তা বেড়ে আবারও ৭৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। মাংসের বাজারে সিন্ডিকেট এতটাই সক্রিয় যে, কম দামে বিক্রয়কারীদের হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।
সরকারি হিসাবনিকাশ থেকে পেঁয়াজের সংকট হওয়ার কোনো চিত্র পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে পেঁয়াজের যে চাহিদা তার বেশির ভাগ অংশই আমাদের দেশেই উৎপাদন হয় বলে কৃষি দফতরের তথ্য থেকে জানা যায়। বাকি পেঁয়াজ বাইরে থেকে আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। পেঁয়াজ আমাদের দেশে আমদানি করা হয় মূলত ভারত থেকে। ভারত পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ। কোনো কারণে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসায় সমস্যা হলে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম হু হু করে বাড়িয়ে দিতে থাকেন। কারণ বাজারে পেঁয়াজের অভাব ছিল না। তার মানে এই পেঁয়াজগুলো ছিল কম দামে কেনা। কেনা দাম থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা ভোক্তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের এই পকেটকাটা এখনও অব্যাহত আছে।
পেঁয়াজ নিয়ে সফল হয়ে মুনাফালোভীরা অন্য নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম নিয়েও কারসাজি শুরু হয়েছে। চাল ডাল তেলসহ আরো কিছু জিনিসের দাম কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ছে। বাধা আয়ের এবং নিন্ম আয়ের মানুষদের কিন্তু নাভিশ্বাস উঠে গেছে।
কৃষক যে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। কৃষক উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করছেন অথচ চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। শীতকালীন সবজির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কৃষক বিক্রি করছেন নামমাত্র দামে আর ভোক্তারা কিনছেন চড়া দামে। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তার ভাঙা ঘরে কখনই চাঁদের আলো নামে না। সাধারণ ভোক্তারাও বেশি দামে জিনিস কিনে হিমশিম খাচ্ছেন। তার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে না। অথচ বাড়ছে ব্যয়ের পরিধি। কৃষক এবং ভোক্তাদের চিড়েচ্যাপ্টা করে মাঝখান থেকে মোটাতাজা হয়ে উঠছেন মধ্যস্বত্বভোগী, ফড়িয়া এবং মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চক্র। সরকার এবং রাজনীতির অবস্থান এখন পর্যন্ত ওদের অনুকূলেই। ফলে অসাধু চক্রের হাতে জিম্মি দেশের সাধারণ মানুষ। মানুষকে এই জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে না পারলে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা দেখা দিতে বাধ্য।
একই সঙ্গে দুর্নীতির প্রসঙ্গটিও না তুললেই নয়। দুর্নীতির ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি যেন কথার কথা না হয়ে থাকে। এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টির উল্লেখ আছে। পাঁচ বছর আগের ইশতেহারেও এমনটিই ছিল। কিন্তু দুর্নীতি কি একটুও কমছে? বরং বিষয়টি এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
কোনো কন্ট্রাক্ট বা চুক্তি সই বা প্রজেক্ট করতে চাইলে প্রথমেই তাদের ২০-৩০ শতাংশ দিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া কাজ পাবার উপায় নেই। গত কয়েক বছরের সব অর্জন-উন্নয়নকে নিরর্থক করে দিচ্ছে দুর্নীতির রাহুগ্রাস।
প্রচলিত দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক দিয়ে দুর্নীতি থামানো যাবে বলে মনে হয় না। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, দুর্নীতিবাজ দানবদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্ভব না হলেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে রুখে দাঁড়াবেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর তো আর হারাবার কিছু নেই। দুর্নীতি দমনের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যাকে নিজ হাতে হাল ধরতে হবে এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। তবে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ার পথ অনেক লম্বা, কঠিন ও কষ্টসাধ্য। শুরু করার জন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে:
১. তথ্য প্রবাহের এই যুগে কোনো কিছুই অজানা নয়।
২. দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৩ থেকে ৫ জনের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে।
৩. এই টাস্কফোর্স চাইলেই বহু তথ্য ও ঘটনা হাতের কাছে পেয়ে যাবেন।
৪. তাদের কাছে আসা তথ্য গোপন থাকবে এবং তথ্যদাতার পরিচয় গোপন থাকবে, তা নিশ্চিত করা দরকার।
৫. দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা দৃষ্টান্তমূলক কিছু পদক্ষেপ নেবেন এবং জনসমক্ষে প্রচার করবেন।
৬. এ ভাবে একটা যুদ্ধ শুরু হলেও কাজটা শেষ পর্যন্ত দূদকের হাতেই তুলে দিতে হবে। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পেলে এটা স্থায়ী হবে না। তবে দুদককে নখদন্তহীন বাঘ বানিয়ে রাখা চলবে না।
শোনা যায়, মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ মাত্র ১৭টি প্রজেক্ট যথাযথ ভাবে মনিটরিং করে প্রকল্পে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন।
আমাদের এখানেও কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত, দৃষ্টান্তমূলক কিছু পদক্ষেপ এবং এর অনুসরণ বদলে দিতে পারে পুরো পরিস্থিতি বা চিত্র।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।
এইচআর/জেআইএম