মুরগির ঠ্যাং-মাছের কাঁটা আসে কোত্থেকে?

অজয় দাশগুপ্ত
অজয় দাশগুপ্ত অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশিত: ০২:৪০ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এখন মানুষ মাছের কাঁটা কিনে খাচ্ছে। মুরগির বদলে মুরগির চামড়া ও ঠ্যাং কিনে খাচ্ছে। ১২ ফেব্রুয়ারি এ খবর প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন সংবাদপত্রে। খবরটি ‘ফাঁস’ করেছিলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ড ছিলেন।

নির্বাচন বানচাল-ভণ্ডুলের জন্য ঝটিকা বেগে এসে ২-৪ মিনিট মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে উধাও হয়ে যেতেন। তার দলের দাবি ছিল- গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ- গোয়েন্দারা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। কিন্তু নির্বাচনের পরে দেখা গেল তিনি নয়া পল্টন এলাকায় বিএনপি অফিসে নিজেদেও লাগানো তালা হাতুড়ি পিটিয়ে ভাঙছেন। আশপাশে পুলিশ ছিল, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। গ্রেফতার করারও কোনো চেষ্টা ছিল না। একাধিক সংবাদপত্রে বিএনপির নেতা-কর্মীদের অফিসে ফিরে আসাকে ‘গৃহপ্রবেশ’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। তবে তালা যে ভাঙলেন, তাতে কত লস হলো- সেটা বলা হয়নি।

মাছের কাঁটা কিংবা মুরগির ঠ্যাং মানুষ খায়, কারণ দামে সস্তা। কিংবা বিনামূল্যেও কেউ পায়। প্রশ্ন করাই যায়- মাংসের ঠ্যাং কিংবা মাছের কাঁটা বাজারে আসে কীভাবে? এভাবেই কি উৎপাদন হয়, নাকি মাছ থেকে কাঁটা এবং মুরগি থেকে ঠ্যাং ও চামড়া মেলে? যদি মাছ থেকে কাঁটা এবং মুরগি থেকে ঠ্যাং মেলে, তাহলে সে সব যায় কোথায়? সে সব তো কেউ না কেউ খায়, নাকি? বিএনপি নেতারা আরও বলতে পারতেন মানুষ আলু এবং বিভিন্ন সবজির ছাল-বাকল খায়। ডিমের খোসা খায়, গরু-খাসি-বকরীর চামড়া খায়- এ সব বললেও তাদের কিছু আসে যায় না।

রুহুল কবির রিজভী বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিশেষ করে খাদ্য দ্রব্যের চড়া দামের প্রসঙ্গে মাছের কাঁটা ও মুরগির ঠ্যাংয়ের উদাহরণ দিয়েছেন, এটা ধরে নিতে পারি। তবে তিনি বলেননি, মাছ ও মুরগি কিনে খাওয়ার লোক রয়েছে দেশে। নইলে কাঁটা ও ঠ্যাং আসল কোত্থেকে? বাংলাদেশে অনেক ধরনের খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে, এটাই সত্য। ব্রিটেনের পার্লামেন্টের সদস্যদের জন্য পার্লামেন্ট সচিবালয় থেকেই অনেক ধরনের তথ্য সরবরাহ করা হয়। ১৯ জানুয়ারি হাউস অব কমন্স-এর লাইব্রেরি থেকে সদস্যদের জানানো হয়- আন্তর্জাতিক কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটছে। যুক্তরাজ্য জ্বালানিসহ অনেক ধরনের পণ্য আমদানি করে। বিশ্বে দাম বাড়লে তার প্রভাব পড়ে যুক্তরাজ্যের বাজারে। পার্লামেন্টে আলোচনার সময় সদস্যরা যেন গাল-গল্প জুড়ে না দেন, বরং সঠিক তথ্য ব্যবহার করেন- সেজন্যই এমন আয়োজন।

বাংলাদেশে এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকলে ভাল হয়। ইউরোপের অনেক দেশে গত কয়েক বছরে খাদ্যদ্রব্য কিনতে ভোক্তাদের বেশি অর্থব্যয় করতে হচ্ছে।

জার্মানিতে এক সময়ে খাদ্য কেনার জন্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। ফ্রান্সে এই হার ছিল ১৬ শতাংশ। তবে গত কয়েক মাসে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য কমে আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ধান, মাছ, সবজি ও হাঁস-মুরগি-গবাদিপশুর উৎপাদন যথেষ্ট বেড়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা-ফাও বলছে- বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ছিল ৩ কোটি ২৯ লাখ টন, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৭৮ লাখ টন। এ সময়ে মাছের উৎপাদন ২৯ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৪ লাখ টন। বাংলাদেশ বিশ্বে মাছের উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

দিনে গড়ে প্রোটিন চাহিদা ধরা হয় ১২০ গ্রাম। বাংলাদেশ ২০১৭ সালেই এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে। এ সব তথ্য বিএনপির নেতাদের অজানা থাকার কথা নয়। তাদের এটাও জানার কথা যে ১৯৭১ সালে বলা হতো বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল সব সংবাদপত্রে হাউজহোল্ড ইনকাম জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়- ‘দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে ১৮.৭ শতাংশ মানুষ। আর চরম দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে ৫.৬ শতাংশ মানুষ। ২০১৬ সালে চরম দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ ছিল ১২.৯ শতাংশ।’

বিএনপি কিন্তু সরকারের উৎখাতের চার ধারায় কঠোর কর্মসূচি দিয়ে এখন ‘লিফলেট বিতরণ’ ও মাছের কাঁটা-মুরগির ঠ্যাংয়ে ফিরে এসেছে। তাদের গৃহপ্রবেশ ঘটেছে। সেখানে নিরাপদে থেকে মাছ-মাংস-সবজি-দুধ-ফলে আহারে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

শতাংশের বিচারে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও যেহেতু লোকসংখ্যা বাড়ছে, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এখন অন্তত সাড়ে তিন কোটি নারী-পুরুষ-শিশু দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সবাই মুরগির ঠ্যাং, মাছের কাঁটা ও পচা সবজি কিনে খাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার বার বলতেন- দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সর্বদাই জোর দিচ্ছেন- গরীব মানুষের দুর্দশা লাঘব করতে চাই। সমস্যা রয়েছে এবং সেটা স্বীকার করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণই বিচক্ষণ রাজনীতিকের কাজ। কিন্তু বিএনপি করছে মিথ্যাচার। তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে।

বিএনপি ও তাদের মিত্ররা সরকারের বিরোধিতা করবে, এটা স্বাভাবিক। সরকারের সমালোচনা করার মতো ইস্যু নিশ্চয়ই তাদের কাছে রয়েছে। কিন্তু ভুল তথ্য কেন দেওয়া হবে? বাজারে অনেক পণ্যের দাম বেশি, অনেক ব্যবসায়ী অতি মুনাফালোভের কারণে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে এবং সরকারের হুঁশিয়ারি ও কিছু পদক্ষেপেও তাদের বাগে আনা যাচ্ছে না, এটা এখন কমবেশি সবার জানা। সরকার এবং সরকারি দল এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের কাছে আরও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ দাবি করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। এ দাবি জোরালো করা যেতেই পারে। মিথ্যাচার না করেও সেটা করা যায়। কিন্তু বিএনপি ভুলের আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। পর পর তিনটি সাধারণ নির্বাচন তারা বর্জন-প্রতিহত করার চেষ্টা করে ব্যর্থহয়েছে। তারা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। এ কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছে কি?

বাস্তবে আমরা দেখেছি বিএনপির লোকেরাই দলের নেতাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। কার্যত এ অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে বিএনপির নেতাদের হঠকারিতার বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন। জনগণ সেটাই করেছিল। একইসঙ্গে তারা সহযোগিতা করেছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তিনি যা করতে বলেছিলেন, সেটাই করেছিল জনগণ। বিএনপির ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি।

এ দলটি ভুল থেকে শিক্ষা নিতে জানে না। আওয়ামী লীগ গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা বরাদ্দ করছিল। কিন্তু এতে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। দলের অভ্যন্তরে কোটারি গড়ে উঠছে বলে অভিযোগ ওঠে। এমপি-মন্ত্রীরা ‘নিজের লোককে’ নৌকা পাইয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন- এমন সমালোচনা অমূলক বলা চলে না। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে তারা চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দলের অবস্থানে পরিবর্তন করা যেতেই পারে, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বিএনপি এ শিক্ষা নিতে পারে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের জন্য বিএনপি হরতাল-অবরোধ-অসহযোগ-গণকারফিউ- এই চার ধরনের কঠোরতম কর্মসূচি নিয়েছিল। এখন তাদের ‘গৃহপ্রবেশ’ ঘটেছে। তাই ‘অবৈধ সরকার উৎখাতে’ তাদের নতুন কর্মসূচি ‘লিফলেট বিতরন’। এ ধরনের কর্মসূচিতে কর্মী-সমর্থকরা যারপরনাই হতাশ হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বিএনপি নেতারা তাদের আগুনে ঝাঁপ দিতে বলেছিল। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি। কারণ শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত কিংবা নির্বাচন প্রতিহত করতে জনগণের উৎসাহ ছিল না। এখন বিএনপি যে লিফলেট বিতরণের কর্মসূচি দিয়েছে, সেটাই বরং বাস্তবসম্মত। কিন্তুনেতারা সেটা স্বীকার করছে না।

একটি কৌতুক বলে ঠ্যাং-কাঁটা উপাখ্যান শেষ করি। এক লোক ঘোড়া নিয়ে এখানে সেখানে বেড়াতে যেত। একবার এক বাজারের কাছে ঘোড়া বেঁধে রেখে চা খেতে বসে। কিছুক্ষণ পর বাইরে এসে দেখে ঘোড়া নেই, চুরি হয়ে গেছে। লোকটি দোকানে প্রবেশ করে একটি টেবিলে উঠে বলে- ১০ গুণব, এর মধ্যে ঘোড়া না পেলে আগের বার যা করেছি, টোই করব। লোকটি এক, দুই... গুণতে থাকে। সবাই ভয় পেয়ে যায় তার রুদ্র মূর্তি দেখে- ভাবতে থাকে কী না কী ঘটে যায়। ৭ গোণা শেষ হতেই কয়েকজন ছুটে এসে বলে- স্যার, শান্ত হউন। ঘোড়া পাওয়া গেছে। লোকটি ঘোড়ায় চড়বে, এমন সময় এক লোক সাহস করে জানতে চায়- স্যার ঘোড়া চুরির পর আগের বার কী করেছিলেন? লোকটির উত্তর-
কী আর করব? হেঁটে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।

বিএনপি কিন্তু সরকারের উৎখাতের চার ধারায় কঠোর কর্মসূচি দিয়ে এখন ‘লিফলেট বিতরণ’ ও মাছের কাঁটা-মুরগির ঠ্যাংয়ে ফিরে এসেছে। তাদের গৃহপ্রবেশ ঘটেছে। সেখানে নিরাপদে থেকে মাছ-মাংস-সবজি-দুধ-ফলে আহারে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

বাংলাদেশের নিভৃত গ্রামেও কিন্তু এখন অনেক ফলের দোকান।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।