‘সঞ্চয় নাকি বিনিয়োগ’ কোনটা আগে করবেন?

সাইফুল হোসেন
সাইফুল হোসেন সাইফুল হোসেন
প্রকাশিত: ০৯:০৮ এএম, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আমাদের মনে প্রায়শই প্রশ্ন জাগে যে, আমাদের কাছে কিছু টাকা আছে- আমরা কি বিনিয়োগ করব, নাকি আরো সঞ্চয় করব? আমাদের উচিত এ বিষয়ে প্রথমে জেনে নেয়া যে সঞ্চয় আগে করা ভালো, নাকি প্রথমে বিনিয়োগ করা আমাদের জন্য শ্রেয়।

আমরা যে যেখানে যেভাবেই থাকি না কেন প্রতিনিয়ত আমাদের খরচ হতেই থাকে। আমরা আয় না করলেও আমাদের কোনো না কোনোভাবে খরচ হয়। আমাদের আয় না থাকলেও হয়তো আমাদের বাবা-মা বা ভাই-বোন যে টাকা আয় করছেন আমরা সেখান থেকে খরচ করছি, অথবা সঞ্চয় থেকে খরচ করছি।

আমরা যারা আয় করছি আমাদের উচিত তার পুরোটা খরচ না করে ১০% অথবা ২০% থেকে ৩০% সঞ্চয় করে রাখা। এধরনের বিষয়কে বলা হয় নিজেকে নিজে পেমেন্ট করা। আমাদের মনে রাখতে হবে, “Pay Yourself First” should be the moto of our life. আমরা যদি ১ লক্ষ টাকা আয় করি, সেখান থেকে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা সঞ্চয় করতে হবে। প্রতি মাসে যদি আমরা ২০ হাজার করে সঞ্চয় করি তাহলে দেখা যাবে ৫ মাস পরে আমাদের ১ লক্ষ টাকা সঞ্চয় হয়ে গেছে।

প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা সঞ্চয়টা কোথায় করবো? খুব সহজেই আমরা এখন ব্যাংকের মাধ্যমে সঞ্চয় করতে পারি। ব্যাংকে যদি সঞ্চয় হিসাবে আমরা টাকাটা রেখে দেই তাহলে ঐ ব্যাংক যদি ২% বা ২.৫% সুদ দেয় তবে আমরা সেটি পাবো। কিন্তু, আমাদের বুঝতে হবে যে ৯% বা তার বেশি যে ইনফ্লেশন রেট তা আমাদের সঞ্চয়ের সুদটুকু নষ্ট করে দিচ্ছে। ১ লক্ষ টাকার পারচেইজিং পাওয়ার ৯১ হাজার টাকা হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের উচিত সেভিংস একাউন্টে টাকাটা না রেখে ১ মাস/৬ মাস/১ বছর ভিত্তিক এফডিআর এ রাখা।

বিনিয়োগের সাথে ঝুঁকি জড়িত। তাই, যেখানে ঝুঁকি নেই সেটা মূলত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি না সেটা বিতর্কের বিষয়। আমরা মূলত সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকে বিনিয়োগ করে থাকি যাতে করে ইনফ্লেশনটা কাভার হয়ে যায়। এখানে বড় কোনো লাভের সম্ভাবনা নেই। এটি পূর্বনির্ধারিত একটি বিষয়। আগে থেকেই এখানে ঠিক করা আমরা কত শতাংশ রিটার্ন পাবো।

আমরা যদি শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করি সেখানে লাভ বা লস হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে যেখানে রিস্ক যত বেশি সেখানে রিটার্নের সম্ভাবনাও তত বেশি। বিনিয়োগ শুরু করার আগে আমাদের উচিত ৩ মাস, ৬ মাস, অথবা ১ বছরের জন্য একটি ফান্ড তৈরি করে রাখা, যাতে আমাদের আপদকালীন সময়ে কোন অসুবিধা না হয়। আমাদের এমনভাবে টাকা রাখতে হবে যাতে করে জরুরি বা প্রয়োজনের সময় খুব দ্রুত সেটিকে একাউন্ট থেকে তোলা যায়। এটিকে বলা হয় ইমার্জেন্সি ফান্ড।

আমরা যে চাকরি করছি, বা কাজ করছি সেটা যদি হঠাৎ করে চলে যায়, যদি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ি বা আমাদের যদি মৃত্যু হয়, তাহলে আয় বন্ধজনিত কারণে আমাদের পরিবার অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে। এই অনিশ্চিত অবস্থা নিরসনের জন্য ইমার্জেন্সি ফান্ড গঠন করতে হয়। আমি মনে করি এটা আমাদের সবার জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। ইমারজেন্সি ফান্ড আমাদের কখনই বিনিয়োগ করা উচিত নয়। কোনো কারণে যদি আমাদের ইমারজেন্সি ফান্ডে হাত দেয়ার প্রয়োজন হয় তবে আমাদের সঞ্চয় তহবিল থেকে তা আবার রিফিল্ড করে নিতে হবে।

আমাদের সেভিংস থেকে খরচ করার প্রবণতা কমাতে হবে। আয়ের মধ্যে চলতে হবে। যেন আয় কোনোভাবে বন্ধ হয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাছাড়া, আয়ের একটা পথ যদি বন্ধ হয়ে যায় অন্য আরেকটা পথ যাতে খোলা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

আমাদের উচিত ইমারজেন্সি ফান্ড তৈরি করে সঞ্চয় করা চালিয়ে যাওয়া এবং তারপর বিনিয়োগের চিন্তা করা। যদি আমরা চাকরিজীবী হই তাহলে আমাদের একটি রেগুলার বিজনেস করতে পারা সহজ নয়। বিজনেস করতে গেলে আমাদের সারাদিনের এটেনশন লাগে। চাকরির পাশাপাশি কোনো পণ্যের ব্যবসা করা বেশ কঠিন যদিও কেউ কেউ অনলাইনে বিজনেস করছে।

চাকরির পাশাপাশি যদি কেউ ব্যবসা করতে পারে তাহলে ভালো। ব্যবসা করতে পারলেও সঞ্চয়ের যে ধারা সেটাকে বজায় রাখতে হবে, দেখতে হবে ব্যাংকের কি কি প্রোগ্রাম আছে যেমন, ডিপিএস, হাউজিং প্রোগ্রাম, ম্যারেজ প্রোগ্রাম, এডুকেশন প্রোগ্রাম এগুলো। এরকম কিছু প্রোগ্রাম আমরা করতে পারি। তাতে করে আমরা যে সেভিংস করছি তখন তা আসলে বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে। তখন আমাদের উপর একটা প্রেশার থাকবে যে প্রতিমাসে আমাদের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা করতে হবে। এগুলো টাকা জমানোর পাশাপাশি যখন আবার কিছু টাকা হাতে আসবে তখন আমাদের অন্যান্য বিনিয়োগের কথা ভাবতে হবে।

আমরা স্টক মার্কেটে ইনভেস্ট করতে পারি একটি বিও একাউন্ট খোলার মাধ্যমে। আমাদের উচিত শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের আগে ভালোভাবে সে সম্পর্কে জেনে নেয়া। কোন কোন কোম্পানি ভাল ডিভিডেন্ট দেয়, কাদের ঋণের পরিমাণ কম ও লিক্যুইডিটি ভাল, কারা ভাল করছে, কাদের ব্যবসায়ে প্রবৃদ্ধি ভাল, কাদের ফান্ডামেন্টাল ভাল তা আমাদের বুঝতে হবে। তারপর, অল্প অল্প করে কিছু শেয়ার কিনে রাখা ভাল।

তাছাড়া আমরা জমিতে ইনভেস্ট করতে পারি। আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো কোম্পানি আছে যারা সাধারণ মানুষকে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তির মাধ্যমে জমি কিনতে উৎসাহিত করে। কোম্পানিটি যদি ভালো হয় তবে তাদের ওখানে আমরা জমিতে বিনিয়োগ করতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে, যদি কোম্পানিটি খারাপ হয় তবে আমাদের খুব অসুবিধার মধ্যে পড়ে যেতে হবে, বা খারাপ কোনো লোকের পাল্লাতেও আমরা পড়ে যেতে পারি, সমাজে তাদের সংখ্যাও অনেক বেশি।

আমরা আগে বিনিয়োগ করব না সঞ্চয় করব সেটি মুখ্য বিষয় না, দুটো বিষয় সমানভাবেই চলতে পারে। সঞ্চয় ও বিনিয়োগের প্রোগ্রামগুলো যখন চালু হয়ে গেল তখন কিন্তু আমাদের নিজেদের উপর একধরনের প্রেশার তৈরি হচ্ছে। নিজেকে আমরা ফোর্স করছি টাকা জমানোর জন্য।

পরিশেষে বলা যায়, আমাদের বিনিয়োগ করতে হলে আগে সেভ করতে হবে, সেভিংস না থাকলে বিনিয়োগ করা সম্ভব না। পাশাপাশি আমাদের ৬ মাস/ ১বছর/ ২ বছর মেয়াদি ইমারজেন্সি ফান্ড গঠন করত হবে, যা কিনা কম সময়ে তারল্যে রূপান্তর করা যাবে। যদি ঐ ইমারজেন্সি ফান্ড থেকে টাকা নেয়া লাগে সেভিংস থেকে পরবর্তীতে আবারও সেটা ভরে ফেলতে হবে।

তারপর, আমরা ইনভেস্টমেন্টের দিকে যাব। আমাদের সেভিংস থেকে খরচ করার প্রবণতা কমাতে হবে। আয়ের মধ্যে চলতে হবে। যেন আয় কোনোভাবে বন্ধ হয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাছাড়া, আয়ের একটা পথ যদি বন্ধ হয়ে যায় অন্য আরেকটা পথ যাতে খোলা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।