মাইকেল মধুসূদন দত্ত : জীবন যেন বেদনাদায়ক এক উপাখ্যান

ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম , ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ০৩:৩৮ পিএম, ২৫ জানুয়ারি ২০২৪

বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে।

কী অপূর্ব শব্দ চয়ন! কৈশোরে পড়া কপোতাক্ষ নদ কবিতা পড়ে যে মুগ্ধতা জন্মেছিল, তা আজও অক্ষয় হয়ে আছে স্মৃতিতে। কবির প্রতি ভালোবাসা জমে যায় যখন দেখি বঙ্গভাষা' নামক কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন: 'হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন কিংবা মেঘনাদ বধ কাব্যে সমুদ্রের প্রতি রাবণ কবিতায় লঙ্কাপুরীর বিবরণ দিতে গিয়ে বলছেন-

উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ-শিখরে,
কনক-উদয়াচলে দিনমণি যেন
অংশুমালী। চারিদিকে শোভিল কাঞ্চন-
সৌধ-কিরীটিনী লঙ্কা— মনোহরা পুরী!
হেমহর্ম্য সারি সারি পুষ্পবন মাঝে;
কমল-আলয় সরঃ; উৎস রজঃ-ছটা;
তরুরাজি; ফুলকুল— চক্ষু-বিনোদন,
যুবতীযৌবন যথা; হীরাচূড়াশিরঃ
দেবগৃহ; নানা রাগে রঞ্জিত বিপণি,
বিবিধ রতনপূর্ণ; এ জগৎ যেন
আনিয়া বিবিধ ধন, পূজার বিধানে,
রেখেছে, রে চারুলঙ্কে, তোর পদতলে,
জগত-বাসনা তুই, সুখের সদন।

মাইকেল মধুসূদনের এই রকমের অনেক লেখা এখনো যে কোনো কবিতাপ্রেমিকে বিহ্বল করে। যার প্রতিটি কবিতার পঙক্তি অশেষ। বাংলা কবিতাকে যিনি দিয়েছিলেন আধুনিকতার স্বাদ, সেই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে । তিনি জন্মেছিলেন ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ও তার প্রথমা পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল।

অদ্ভুত এক পাগলামো তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে নিয়ন্ত্রণ করে গেছে নিয়তির মতো। তারপরও মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আজ অমরত্ব লাভ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ থেকে আরো সমৃদ্ধ করে গেছেন। আজ এই মহাকবির দ্বিশত জন্ম বার্ষিকী। আমাদের অজস্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সাগরদাঁড়িতেই মধুসূদনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রামের শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। বিদ্বান ইমামের কাছে তিনি বাংলা, ফারসি ও আরবি পড়েছেন।

তেরো বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় চলে আসেন। উনিশ শতকের এই সময় কলকাতার হিন্দু কলেজে চলছিল পরিবর্তনের হাওয়া। ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট খ্যাত ডিরোজিও এর সঙ্গে আলাপ, হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি. এল. রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র হবার সুবাদে পরিবর্তনের হাওয়া এসে লাগলো মধুসূদনের পালেও। বলা বাহুল্য অধ্যক্ষ রিচার্ডসন মধুসূদনের মনে কাব্যপ্রীতি সঞ্চারিত করেছিলেন। এছাড়া কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ উনিশ শতকের বাংলা নবজাগরণের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

মধুসূদনের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন। অস্থির মন বাসনা তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে কখনো কলকাতা, কখনো মাদ্রাজ এবং পরে ফ্রান্সে। কবির জীবনের চমকপ্রদ ঘটনা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কবির সমগ্র জীবনের আনন্দ দুঃখ বেদনা আবর্তিত হয়।

ঘটনার শুরু ১৮৪৩ সালে। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে এসে কবি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে তিনি তার "মাইকেল" নামকরণ করেন। মধুসূদন পরিচিত হন "মাইকেল মধুসূদন দত্ত" নামে।

কবির এই ধর্মান্তর সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রাজনারায়ণ দত্ত পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। ফলে প্রাথমিকভাবে ধাক্কা খেলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তারপরেও মধুসূদন দত্ত শিবপুরের বিশপস কলেজে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। কিন্তু এক সময় পরিবার থেকে টাকা পাঠানো বন্দ হয়ে যায়। কবি কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ফলে বিশপস কলেজের প্রাক্তন মাদ্রাজি বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) চলে যান মধুসূদন।

মাদ্রাজে এসে কবি সংবাদপত্রে যোগ দেন। শুরু হয় কবির সাংবাদিক জীবন। মাদ্রাজ ক্রনিকল পত্রিকায় ছদ্মনামে তার কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। হিন্দু ক্রনিকল নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই অর্থাভাবে পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে হয়।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত : জীবন যেন বেদনাদায়ক এক উপাখ্যান

মাদ্রাজের শুরু থেকেই কবি নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করতে থাকেন। মাদ্রাজেই তিনি দাম্পত্যজীবন শুরু করেন । স্ত্রী রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতী। রেবেকার সঙ্গে কবির দাম্পত্যজীবন আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। এই সময় রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়।

রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে মধুসূদন এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। হেনরিয়েটা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন। এরই মধ্যে মাইকেল রচনা করেন দ্য ক্যাপটিভ লেডি। এই বই পড়েই কলকাতার বন্ধুরা কবিকে কলকাতায় ফিরে আসতে অনুরোধ করেন। ১৮৫৬ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাদ্রাজের পাঠ চুকিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।

১৮৬০ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য। এই কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের সফল প্রয়োগ করেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দান করেছে। ভাষায়, ভাবে, ছন্দে, শিল্পরীতিতে গ্রন্থটি এখন ইতিহাস। ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ প্রকাশের পর কার্যত পুরনো রীতির বা যুগের অবসান ঘটে; আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। ভাষারীতিতে বিপ্লব করেই মূলত বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূচনা হয় এবং তা মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরেই। কবি মধুসূদন দত্ত মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে সম্মান জানিয়ে তার নামেই ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন।

মধুসূদন দত্ত যেমন বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি, তেমনি প্রথম সার্থক নাট্যকার। মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। ১৮৫৯ সালে তিনি রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক; একটি পৌরাণিক নাটক। পাশ্চাত্য শৈলীতে রচিত এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। মধুসূদন পরে ‘শর্মিষ্ঠা’র ইংরেজি অনুবাদ করেন।

১৮৬০ সালে রচনা করেন দুটি প্রহসন: ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং পূর্ণাঙ্গ পদ্মাবতী নাটক। ‘পদ্মাবতী’ নাটকে তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন।

১৮৬১ সালে ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য (১৮৬১) নামের মহাকাব্য। কবি ইংল্যান্ডে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানের আবহাওয়া এবং বর্ণবাদিতার কারণে বেশি দিন ইংল্যান্ডে থাকেন নি। তারপর তিনি ১৮৬০ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে চলে যান। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ। হিসাব করে টাকা খরচ করতেন না কোনোদিনই। পকেটের টাকা তাঁর বাসি হত না। অথচ তাঁকেই দিনের পর দিন শুধু জল খেয়ে কাটাতে হয়েছে। সামান্য টাকার জন্য হয়েছেন চরম অপমানিত। একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর জন্য তিনি তার আইন বিষয়ে পড়া শেষ করে ভারতে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মহাকবির পুরো জীবন যেন বেদনাদায়ক এক উপাখ্যান। তার জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে যাত্রা পালা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সেই যাত্রাপালাতে দেখানো হয় মধুসূদন দত্ত ধর্মান্তরিত হয়ে সাগরদাড়িতে ফিরছেন। কিন্তু পিতার সম্মতি নেই গৃহপ্রবেশের। বাবা মুন্সি রাজনারায়ণ দত্তকে বলা সংলাপটি ছিল অনেকটা এরকম:

'ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। তবে যাবার আগে কিছু কথা বলে যাচ্ছি শুনুন। যে ধর্ম ও জাতিভেদ প্রথার জন্য আজ আপনার অহংকারের শেষ নেই, সেই জাতিভেদ প্রথা ভবিষ্যতে থাকবে না। খ্রিস্টান হয়ে আমি যে অসাধারণ শুধু সেটাই প্রমাণ করেছি। একদিন মুন্সি রাজনারায়ণ দত্ত নামে কাউকে চেনা যাবে না, সেদিন আপনি হবেন শুধু মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাবা।

একদিন চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আপনি সবাইকে বলবেন, ওগো তোমরা শোনো, আমি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাবা, আমি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাবা, আমি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাবা। সেদিন মুন্সি রাজনারায়ণ দত্ত মুছে গিয়ে আপনি হবেন শুধুই মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাবা। এই অভিশাপ আমি আপনাকে দিয়ে গেলাম।'

কলকাতায় মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায়ে তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। তাছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন (অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে কলকাতার সার্কুলার রোডে সমাধি দেওয়া হয়। মহাকবি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি তার সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায়। তার সমাধিস্থলে নিচের কবিতাটি লেখা রয়েছে :

'দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী'

অদ্ভুত এক পাগলামো তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে নিয়ন্ত্রণ করে গেছে নিয়তির মতো। তারপরও মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আজ অমরত্ব লাভ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ থেকে আরো সমৃদ্ধ করে গেছেন। আজ এই মহাকবির দ্বিশত জন্ম বার্ষিকী। আমাদের অজস্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।