বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছিল যেদিন!

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
ড. প্রণব কুমার পান্ডে ড. প্রণব কুমার পান্ডে
প্রকাশিত: ০৯:৪৪ এএম, ১০ জানুয়ারি ২০২৪

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন কারণ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার পর লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে দেশের পবিত্র মাটিতে ফিরে আসেন এই দিনে। বিশ্বের মানচিত্রে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের মূল্যায়ন করা আমাদের জন্য একটি কঠিন কাজ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা বঙ্গবন্ধুর চোখে সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

তাঁর বিচক্ষণ, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং রূপান্তরকারী নেতৃত্বের গুণের কারণে, তিনি এই পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। এই ভাবে তিনি দেশের নাগরিকদের পাকিস্তানি জান্তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

যুদ্ধে হেরে যাবার ভয়ে, পাকিস্তানি জান্তা বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য একটি প্রতারণামূলক মামলা পরিচালনা করে। তবে, বিশ্বনেতাদের বিরোধিতা ও চাপের কারণে তারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পাকিস্তান সরকারের ধারণা ছিল যে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিলে তারা হয়তো যুদ্ধে জয়ী হতে পারতো। তবে তারা তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ করার সাহস শেষ পর্যন্ত দেখায় নি।

শেখ মুজিব ছিলেন একজন শান্তিকামী, স্বাধীনতাকামী এবং বৈশ্বিক একজন মানুষ। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু (বাংলাদেশের বন্ধু) নন, তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে (বিশ্ববন্ধু)। ফলে, যতদিন বাংলাদেশ বিশ্বে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে অবস্থান করবে, বঙ্গবন্ধু ততদিন তাঁর অবদান, আদর্শ এবং মূল্যবোধের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।

এরপর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের খবর শুনে, ১৯৭১ সালের মার্চের পরে প্রথমবারের মতো ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির শীতের সন্ধ্যায় রেডকোর্স ময়দানে প্রায় ৫ লাখের বেশি মানুষ তাদের বীরের কণ্ঠ শোনার জন্য মিলিত হয়েছিল। তিনি এতটায় আবেগে আপ্লুত ছিলেন যে তিনি যখন দেশবাসীর সামনে কথা বলতে শুরু করেন তখন তার চোখ কয়েক মিনিটের জন্য অশ্রুতে ভরে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনের ব্যাপকতা অসাধারণ, কারণ স্বাধীনতা উত্তর প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ তাঁর অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হতে পারত। সে দিন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি যে কতটা প্রয়োজন ছিল, তা বর্তমান সময়ে বসে অনুভব করা যাবে না। তখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেকেই মনে করছিলেন, ‘আমরা সবাই রাজা’। কেউ কাউকে মানছিল না। তরুণ নেতারা অস্থায়ী সরকারের কোনো কথা শুনছিল না। একটি নৈরাজ্যের মতো অবস্থা ছিল প্রথম ২৫টি দিন।

তিনি না এলে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিতেন কি না, সন্দেহ। তাই, অনেকেই আশংকা করেছিলেন যে তাঁর অনুপস্থিতিকে পুঁজি করে রাজনৈতিকভাবে উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিরা দেশকে আরও সমস্যায় ঠেলে দিতে পারতো। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত অনুসারীদের-(তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম, যারা তাঁর দর্শনকে সমুন্নত রেখে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছিলেন)- কারণে এই দলগুলো তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কিন্তু, একইসঙ্গে, নির্মম বাস্তবতা হলো, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে না ফিরলে এই নেতারা হয়তো দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারতেন না।

বঙ্গবন্ধু খুব কৌশলে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাধীনতার তিন মাসের মধ্যে মিত্র বাহিনীর সদস্যদের ভারতে ফিরিয়ে নিতে রাজি করাতে পেরেছিলেন। একটিও ছিল নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের প্রেক্ষাপটে একটি বিরল ঘটনা। তিনি যদি সে দিন ফিরে না আসতেন, তবে এটা নিশ্চিত করা যেতে পারে যে ভারতীয় সেনাবাহিনী হয়তো এখনও বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা হত না। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বা পরবর্তীতে বিভিন্ন যুদ্ধে মিত্রবাহিনী সৈন্যদের অবস্থানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে, এই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরতে না পারলে মাত্র তিন বছরের মধ্যে জাতিসংঘের সদস্যপদ, বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি এবং উল্লেখযোগ্য প্রভাবশালী বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদও অর্জন করা কঠিন হতে পারতো। এতো অল্প সময়ের মধ্যে দেশকে একটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব নাও হয়ে পারতো।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেছিলেন জন্যই স্বাধীনতার ১ বছরের মধ্যে অত্যন্ত চমৎকার একটি সংবিধান পেয়েছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র। পৃথিবীর কম দেশই আছে যারা স্বাধীনতার পরে এতো অল্প সময়ে সংবিধান প্রণয়ন করতে পেরেছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলেও পাকিস্থানের প্রথম সংধিবান প্রণীত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রায় ৯ বছর পরে।

সংবিধানের চারটি স্তম্ভের একটি হিসাবে "ধর্মনিরপেক্ষতা"কে স্বীকৃতি দিয়ে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু যেটি ছিল তাঁর পক্ষে একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার গভীরতা ফুটে উঠেছিল।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে সাড়ে তিন বছর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পদে আসীন ছিলেন। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন, আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন এবং দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দিকে মনোযোগ দেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন নেতা। কূটনীতির প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর সূক্ষ্ম বোধগম্যতা এবং বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও মঙ্গল রক্ষায় তাঁর অটুট নিষ্ঠার মাধ্যমে। তাঁর কূটনীতিকে বাস্তববাদ, দৃঢ়তা এবং ন্যায়বিচার এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের নীতির প্রতি গভীর অঙ্গীকারের সংমিশ্রণ দ্বারা চিহ্নিত করা যায়।

তিনি দক্ষতার সাথে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক সম্পর্কের জটিলতাগুলিকে সমাধান করেছিলেন, এবং বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সাথে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার সাথে সাথে তাঁর জাতির অধিকার এবং স্বার্থের পক্ষে কাজ করেছিলেন। তাঁর নিপুণ কূটনীতির মাধ্যমে, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য শুধু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিই অর্জন করেন নি, বরং বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে বাংলাদেশের সক্রিয় ও অর্থপূর্ণ সম্পৃক্ততার ভিত্তিও স্থাপন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর পরিপক্ক কূটনীতির যার প্রধান ভিত্তি ছিল "সকলের সাথে বন্ধুত্ব"- এর কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং আরও কয়েকটি দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও বিশ্বের ১৪০টি দেশ খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাজনীতির একজন জ্বলন্ত নক্ষত্র। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান কয়েকটি পৃষ্ঠায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এটি বর্ণনা করতে কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর প্রয়োজন হবে। ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বিশালতার কথা বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নেতা বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ব নেতা হিসেবে অভিহিত করেছেন।

ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিলের ভূতপূর্ব সেক্রেটারি জেনারেল রমেশ চন্দ্র এক সময় বলেছিলেন “Sheikh Mujib is a man of peace, a man of independence and a man of the world. He is not just the Bangabandhu (Friend of Bangladesh), He is also the Viswabandhu (Friend of the World) (শেখ মুজিব ছিলেন একজন শান্তিকামী, স্বাধীনতাকামী এবং বৈশ্বিক একজন মানুষ। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু (বাংলাদেশের বন্ধু) নন, তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে (বিশ্ববন্ধু)। ফলে, যতদিন বাংলাদেশ বিশ্বে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে অবস্থান করবে, বঙ্গবন্ধু ততদিন তাঁর অবদান, আদর্শ এবং মূল্যবোধের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।