শুধু তোষামোদকারী নয় এবার নিন্দুকের কথাও শুনুন
পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সেই কবেই বলে গেছেন, মানুষকে তৈলের ন্যায় ঠান্ডা করিতে আর কিসে পারে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কথা শতভাগ সত্য। তেল মানুষের মাথা যেমন ঠান্ডা করে, এরচাইতে বেশি ঠান্ডা করে মন। মোঘলাই থেকে ভর্তা, ভাজি, মুড়িমাখা কোনো খাবারই তেল ছাড়া খাওয়া কঠিন। তবে সব রান্নাতেই তেলের একটা মাপ আছে। মাত্রাতিরিক্ত তেল ব্যবহার করলে, সেগুলো আর সুখাদ্য ও স্বাস্থ্যকর খাবার থাকেনা। বরং হয়ে যায় অখাদ্য কারণ অতিরিক্ত তেলে বদহজম হয়, স্বাস্থ্যহানি ঘটে। অন্যদিকে তেল ছাড়া কলকব্জা চলে না, গাড়ির চাকা ঘোরে না, চুল চকচকে হয় না। কিন্তু সবখানেই তেল ব্যবহারের মাপ আছে। স্বাস্থ্য, কর্মক্ষেত্র কিংবা সরকার চালনাসহ কোথাও বাড়তি তেল মোটেই ভালো না।
কেন হঠাৎ তেল প্রসঙ্গ এলো, সেটা বলার আগে নির্বাচন নিয়ে দু’একটি লাইন বলতে চাইছি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ কেমন করে দেশ চালাবে, কতটা ক্ষমতা প্রদর্শন করবে, অর্থনীতির অবস্থা কেমন হবে, দলের নেতা-কর্মী বাহিনী, মন্ত্রী মহোদয় ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা কী হবে, দুর্নীতিবাজরা আরো কতটা শক্তিশালী হবে, মুদ্রাস্ফীতি বা প্রবৃদ্ধির হার কী হবে, এইসব আলোচনা এখন চলতেই থাকবে। আমি শুধু ভাবছি সেইসব মোসাহেবদের কথা, যারা এতগুলো বছর তেলের হাঁড়ি নিয়ে ঘুরেছেন, আবার ঘুরবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যাদের হাত কচলাতে কচলাতে চামড়া প্রায় উঠেই গেছে গত তিন মেয়াদে। চতুর্থবারে সেই তেলবাজদের কী হবে?
এই মোসাহেব শব্দটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে মনে হলো হজো ব্যাটার কথা। আমার দাদা একজন আইনজীবী ছিলেন। কাজ থেকে অবসর নেয়ার পর নিজ গ্রামে এসে বাস করা শুরু করেছিলেন। দাদা নিজ হাতেই বাড়ির বাগান, গাছগাছালি, গোয়াল ঘর ইত্যাদির দেখাশোনা করতেন। তবে এইসব কাজ করার সময় তাঁর সাথে থাকতো হজো নামের একজন ব্যক্তি। দাদা তাকে রংপুরের ভাষায় ডাকতেন হজো ব্যাটা। হজো ব্যাটার কাজ ছিল দাদাকে সঙ্গ দেয়া এবং দাদা যে কাজ করবেন, তাতে সায় দেয়া।
হজো ব্যাটা আর দাদার কথোপকথনের দৃশ্যটা ছিল এরকম যে, দাদা বাড়ির বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর হজো ব্যাটা তাঁর পেছনে পেছনে নতজানু ভঙ্গিতে হাঁটছেন। যেতে যেতে হঠাৎ দাদা বললেন, “হজো এইবছর গাছে আম কিন্তু ভালই হইছে।” হজো সাথে সাথে বললেন, ”জি জি জ্যাঠো এক্কেবারে ঠিক কছেন। আম ভালই ফইলছে।” কিছুদূর এগিয়ে দাদা আবার বললেন, “নারে হজো আম কিন্তু সেইমতন ভালো হয় নাই, তুই কি কছিত“? দাদার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই হজো ব্যাটা বলে উঠলেন, “সেইত্তো জ্যাঠো, সেইত্তো। গাছোত আমতো ভাল না হয়।” অন্য কোনো সময় দাদা গাছের নিচে বসে বললেন, হজো এইবছর বেশ গরম পইচ্ছে। তুই কেমন বুঝিসিত?” হজোর তাৎক্ষণিক জবাব “হয় জ্যাঠো ভালই গরম পইচ্ছে।” দাদা আবার বললেন, “নারে হজো এখনো সেইরকম গরম পড়ে নাই।”হজো ব্যাটা উত্তর দিলেন, “সেইত্তো দেইখবার পাছো জ্যাঠো, এখনও সেইমতন গরম পড়ে নাই।”
প্রায় ১২০/২৫ বছর আগে এই ছিল আমাদের বাড়ির হজো ব্যাটা, যার পেশাই ছিল দাদার কথায় সায় দেয়া। মানে “সেইত্তো জ্যাঠো, সেইত্তো জ্যাঠো” বলে দাদার পিছে থাকা। যদিও হজো ব্যাটার উত্তরের কোনো প্রভাব দাদার কাজের উপর পড়তো না। এজন্য অবশ্য হজো ব্যাটার জন্য ভাতা, জমি, থাকার জায়গাসহ বেশ কিছু সুবিধাদিও বরাদ্দ ছিল।
হজো ব্যাটার কথা প্রায়ই মনে হয় আজকালকার নবীন-প্রবীণ, শিক্ষিত, ধনী, সংস্কৃতিমনা দুঁদে পেশাজীবী লোকদের হজোপনা দেখে। চারিদিকে অগণিত হজো ব্যাটার ভীড়। এরা সবাই বিভিন্ন পেশায় সংযুক্ত হলেও মূল কাজ ক্ষমতার পেছনে থাকা আর বাড়তি সুবিধা আদায়ের জন্য অপরিমিত হাততালি দেয়া। এরা প্রতিনিয়ত তেলের ভান্ড নিয়ে ঘুরছেন এবং অকাতরে তেল ঢালছেন। তেল দিতে গিয়ে এরা ন্যায়-অন্যায়, সাদা-কালো ও ভালো-মন্দের প্রভেদ করেন না। ক্ষমতার কাছে থাকার জন্য যতোটা তেল ঢালা সম্ভব, তারা ততোটাই ঢালেন। আওয়ামী লীগ সরকার চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা গ্রহণে সবচেয়ে খুশি হয়েছে এই তোষামোদি মানুষগুলো।
এদের কারণেই মূল সমস্যাগুলো সবসময় অদৃশ্য থেকে যায়। সব ঠিক হচ্ছে, সব ভালো হচ্ছে, সবাই সুখে আছে, বস আপনিই ঠিক কাজ করছেন- এরকম তথ্য ভুল বার্তা দেয় ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিকে। সরকারের ভেতরে, রাজনীতিতে, অন্যান্য পেশায়, বেসরকারি সংস্থায় যে যার মতো করে তেল দিয়েই যাচ্ছেন। উদ্দেশ্য নিজে বাড়তি সুবিধা নেয়া, অন্যকে পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা এবং মিথ্যা বা সাজানো তথ্য দিয়ে নেতা বা বসের মন ভরিয়ে তোলা।
এই তেলবাজিটা মাঝেমাঝে এতটাই নগ্ন হয়ে যায় যে সাধারণ মানুষ বিব্রতবোধ করেন, হাসাহাসি করেন কিন্তু তেলবাজ ব্যক্তি বুঝতে পারেন না অথবা বুঝেও ফায়দা হাসিলের জন্য কাজ চালিয়ে যান। তেলবাজি সবক্ষেত্রে আছে। এতে করে ব্যাক্তির ও দলের লাভ হলেও ক্ষতিটা হয় প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, দল ও দেশের। রাজনীতি ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তেলবাজিটা সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়, এর ফল ভোগ করতে জনগণকে।
রাজা রাজ্য শাসন করেন। তার কাজের ভালোমন্দ, ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। এইসব ধরিয়ে দেয়ার জন্যই রাজার অনেক মন্ত্রী, উজিড়-নাজির থাকেন। তাদের দায়িত্ব রাজার বা দেশে পরিচালনাকারীর কাজের ভালো মন্দ বিচার করা, ভালো কাজকে গতিশীল করা, প্রজা সাধারণের দুঃখ-দুর্গতির কথা রাষ্ট্রনায়কের সামনে তুলে ধরা।
সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের কাজে লাগছে, অথবা কোনটা লাগছে না, তা উপস্থাপন করা। আর তা যদি না হয়, তাহলে বুঝতে হবে রাজা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন দিয়ে কতগুলো তোষামোদি অকাল কুষ্মান্ড পালছেন। এরা রাজার বন্ধু নয়, বরং শত্রু। রাজা যখন বিপদে পড়বেন, এরা তখন পালাতে এক মুহূর্তও দেরি করবেন না। রাজার কোনো মন্দ কাজের সমালোচনা করলে এই তেলবাজরা রুখে দাঁড়ায়, বলে নিন্দুকেরা দেশটাকে ডোবাচ্ছে। এদের কথাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,“রাজা যতো বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।”
সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ কেমন করে দেশ চালাবে, কতটা ক্ষমতা প্রদর্শন করবে, অর্থনীতির অবস্থা কেমন হবে, দলের নেতা-কর্মী বাহিনী, মন্ত্রী মহোদয় ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা কী হবে, দুর্নীতিবাজরা আরো কতটা শক্তিশালী হবে, মুদ্রাস্ফীতি বা প্রবৃদ্ধির হার কী হবে, এইসব আলোচনা এখন চলতেই থাকবে। আমি শুধু ভাবছি সেইসব মোসাহেবদের কথা, যারা এতগুলো বছর তেলের হাঁড়ি নিয়ে ঘুরেছেন, আবার ঘুরবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
খনা বচন দিয়ে গেছেন, “তেলা মাথায় ঢালো তেল, শুকনো মাথায় ভাঙ্গো বেল।” খনার বচনকে অব্যর্থ করতে আমরা তেলা মাথায় তেল দিয়েই যাচ্ছি। আর যে অসহায়, তার মাথায় বেল ভাঙার চেষ্টা করছি। দেশের জ্ঞানীগুণী মানুষ যখন কলুর বলদ হয়ে পড়েন, তখন আর কী প্রত্যাশা করতে পারেন সাধারণ মানুষ?
তেল প্রসঙ্গেই পত্রিকায় পড়া একটি গল্প মনে পড়লো। বৈবাহিক সূত্রে একটু দূর সম্পর্কের আত্মীয় যশোরের ক্ষিতীশ বাবু সেই যে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে এলেন কিন্তু তার আর যাবার নাম নেই। এখানে তিনি কাজ পেয়ে গেছেন। মূল কাজ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পায়ে তেল মালিশ করা ও বাড়িতে ফুট-ফরমাশ খাটা। “তেলেই লক্ষ্মী”এটা বুঝতে পেরে তিনি দেশীয় ভেষজ দিয়ে সুগন্ধি চুলের তেল বানাতে শুরু করলেন। বোতলে ভরে তাতে চুল খোলা নারীর লেবেল এঁটে ঝাকাভর্তি করে মাথায় নিয়ে ফেরি করতে বের হতেন। ক্রমে তিনি বুঝতে পারলেন তেলের বাজারে প্রচারেই প্রসার। তিনি এসে অবন ঠাকুরকে ধরলেন এই তেল সম্পর্কে সার্টিফিকেট লিখে দিতে হবে। অবন ঠাকুর বললেন আগে রবি কাকার সার্টিফিকেট আনো, তারপর।
ক্ষিতীশ বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে হাজির হলেন এবং তার তেলের নামধাম ও গুণাগুণ তাকে শুনিয়ে বাণিজ্যিক কারণে সার্টিফিকেট চাইলেন। ব্যবসায়িক পণ্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ আগেও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন। তিনি অমনি লিখে দিলেন 'অলকানন্দা তৈল সামান্য মাখিলেই চুল ওঠে, শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।' খুশিতে আটখানা হয়ে ক্ষিতীশ ছুটলেন অবন ঠাকুরের কাছে। এমনই রসবোধ রবি কাকার যে তার কথার ভালো মানেও করা যায়, একটু মাখলেই চুল গজায়, আবার উল্টো মানেও তো করা যায়।
মোসাহেব ও নিন্দুক প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতা-কাহিনী’ও খুব প্রাসঙ্গিক বলে এই কাহিনীর সংক্ষিপ্ত রুপ দিয়েই শেষ করছি।
এক-যে ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ। সে গান গাহিত, শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত, জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে। রাজা বলিলেন, 'এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়।' মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, 'পাখিটাকে শিক্ষা দাও।'
রাজার ভাগিনাদের উপর ভার পড়িল পাখিটাকে শিক্ষা দিবার। পন্ডিতেরা বসিয়া অনেক বিচার করিলেন। প্রশ্নটা এই, উক্ত জীবের অবিদ্যার কারণ কী। সিদ্ধান্ত হইল, সামান্য খড়কুটা দিয়া পাখি যে বাসা বাঁধে সে বাসায় বিদ্যা বেশি ধরে না। তাই সকলের আগে দরকার, ভালো করিয়া খাঁচা বানাইয়া দেওয়া।
স্যাকরা বসিল সোনার খাঁচা বানাইতে। খাঁচাটা হইল এমন আশ্চর্য যে, দেখিবার জন্য দেশবিদেশের লোক ঝুঁকিয়া পড়িল। কেহ বলে, 'শিক্ষার একেবারে হদ্দমুদ্দ।' পন্ডিত বসিলেন পাখিকে বিদ্যা শিখাইতে। নস্য লইয়া বলিলেন, 'অল্প পুঁথির কর্ম নয়।' ভাগিনা তখন পুঁথিলিখকদের তলব করিলেন। তারা পুঁথির নকল করিয়া এবং নকলের নকল করিয়া পর্বতপ্রমাণ করিয়া তুলিল। অনেক দামের খাঁচাটার জন্য ভাগিনাদের খবরদারির সীমা নাই। মেরামত তো লাগিয়াই আছে। তার পরে ঝাড়া মোছা পালিশ-করা ঘটা দেখিয়া সকলেই বলিল, 'উন্নতি হইতেছে।'
সংসারে অন্য অভাব অনেক আছে, কেবল নিন্দুক আছে যথেষ্ট। তারা বলিল, 'খাঁচাটার উন্নতি হইতেছে, কিন্তু পাখিটার খবর কেহ রাখে না।' কথাটা রাজার কানে গেল। তিনি ভাগিনাকে ডাকিয়া বলিলেন, 'ভাগিনা, এ কী কথা শুনি।' ভাগিনা বলিল, 'মহারাজ, সত্য কথা যদি শুনিবেন তবে ডাকুন স্যাকরাদের, পন্ডিতদের, লিপিকরদের, ডাকুন যারা মেরামত করে এবং মেরামত তদারক করিয়া বেড়ায়। নিন্দুকগুলো খাইতে পায় না বলিয়াই মন্দ কথা বলে।' জবাব শুনিয়া রাজা অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝিলেন, আর তখনি ভাগিনার গলায় সোনার হার চড়িল।
শিক্ষা যে কী ভয়ংকর তেজে চলিতেছে, রাজার ইচ্ছা হইল স্বয়ং দেখিবেন। একদিন তাই পাত্র মিত্র অমাত্য লইয়া শিক্ষাশালায় তিনি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত। দেউড়ির কাছে অমনি বাজিল শাঁখ ঘণ্টা ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়া তুরী ভেরি দামামা কাঁসি বাঁশি কাঁসর খোল করতাল মৃদঙ্গ জগঝম্প। পন্ডিতেরা গলা ছাড়িয়া, টিকি নাড়িয়া, মন্ত্রপাঠে লাগিলেন। মিস্ত্রি মজুর স্যাকরা লিপিকর তদারকনবিশ আর মামাতো পিসতুতো খুড়তুতো এবং মাসতুতো ভাই জয়ধ্বনি তুলিল। রাজা খুশি হইয়া দেউড়ি পার হইয়া যেই হাতিতে উঠিবেন এমন সময়, নিন্দুক ছিল ঝোপের মধ্যে গা ঢাকা দিয়া, সে বলিয়া উঠিল, 'মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি।'
রাজার চমক লাগিল; বলিলেন, 'ঐ যা! মনে তো ছিল না। পাখিটাকে দেখা হয় নাই।' ফিরিয়া আসিয়া পন্ডিতকে বলিলেন, 'পাখিকে তোমরা কেমন শেখাও তার কায়দাটা দেখা চাই।' দেখা হইল। দেখিয়া বড়ো খুশি। কায়দাটা পাখিটার চেয়ে এত বেশি বড়ো যে, পাখিটাকে দেখাই যায় না; মনে হয়, তাকে না দেখিলেও চলে। রাজা বুঝিলেন, আয়োজনের ত্রুটি নাই। খাঁচায় দানা নাই, পানি নাই; কেবল রাশি রাশি পুঁথি হইতে রাশি রাশি পাতা ছিঁড়িয়া কলমের ডগা দিয়া পাখির মুখের মধ্যে ঠাসা হইতেছে। গান তো বন্ধই, চীৎকার করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা। দেখিলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়। এবারে রাজা হাতিতে চড়িবার সময় কানমলা-সর্দারকে বলিয়া দিলেন, নিন্দুকের যেন আচ্ছা করিয়া কান মলিয়া দেওয়া হয়।
পাখিটা দিনে দিনে ভদ্র দস্তুর-মতো আধমরা হইয়া আসিল। তবু স্বভাবদোষে সকালবেলার আলোর দিকে পাখি চায় আর অন্যায় রকমে পাখা ঝট্পট্ করে। এমন কি, এক-একদিন দেখা যায়, সে তার রোগা ঠোঁট দিয়া খাঁচার শলা কাটিবার চেষ্টায় আছে। কোতোয়াল বলিল, 'এ কী বেয়াদবি।' তখন শিক্ষামহালে হাপর হাতুড়ি আগুন লইয়া কামার আসিয়া হাজির। কী দমাদ্দম পিটানি। লোহার শিকল তৈরি হইল, পাখির ডানাও গেল কাটা। পাখিটা মরিল। কোন্কালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই। নিন্দুক ল²ীছাড়ারা রটাইল, 'পাখি মরিয়াছে।' ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, 'ভাগিনা, এ কী কথা শুনি।' ভাগিনা বলিল, 'মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।' রাজা শুধাইলেন, 'ও কি আর লাফায়।' ভাগিনা বলিল, 'আরে রাম!' 'আর কি ওড়ে।' 'না।' 'আর কি গান গায়।' 'না।' 'দানা না পাইলে আর কি চেঁচায়।' 'না।'
রাজা বলিলেন, 'একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।' পাখি আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজ্গজ্ করিতে লাগিল। বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণহাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করিয়া দিল।
পুনরায় আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর থেকে সেইসব তেলবাজদের কথা মনে হচ্ছে যারা রাজাকে প্রকৃত চিত্রটি দেখতে দিতে চান না। এরা এখন নতুন করে করে কোন ব্র্যান্ডের তেল নিয়ে আসছেন, সেইটা দেখার বিষয়। শুধু অনুরোধ করবো সরকার যেন শুধু মোসাহেব নয়, নিন্দুকদের কথাও একটু শোনে।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম