ছাত্ররা কীভাবে টাকার ব্যবস্থাপনা করবে
অর্থ, সম্পদ, টাকা-পয়সা মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব মানুষের টাকা লাগে। এমনকি মারা যাওয়ার পরও আপনার জন্য টাকা খরচ হয়। একটা শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সে কোনো টাকা আয় করে না কিন্তু তার পেছনে টাকা খরচ হয়। তাই টাকার গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
টাকা আমাদের জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু টাকার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো বিষয় আমাদের স্কুল, কলেজ, এমনকি ইউনিভার্সিটির কোনো সিলেবাসে পড়ানো হয় না। কোথাও লেখা নেই কীভাবে আপনি আপনার টাকা খরচ করবেন বা ব্যবস্থাপনা করবেন। আমরা আমাদের Finfacts চ্যানেলে পার্সোনাল ফাইন্যান্স সংক্রান্ত অনেক আলোচনা করেছি। সেইসব ভিডিও দেখে আমাকে অনেকেই অনুরোধ করেছেন, স্টুডেন্ট লাইফের আর্থিক ব্যবস্থাপনাটা কেমন হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে। আমি আজ একজন ছাত্র বা ছাত্রী তার হাতে যে টাকা-পয়সা আসে সেটাকে সে কীভাবে ম্যানেজ করবে তার ওপর আলোকপাত করছি।
অর্থ হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং লোভনীয় একটি সম্পদ। অর্থ সম্পদের সঠিক ব্যবহার আপনার জীবনকে সুন্দর ও সুখী করতে পারে। স্টুডেন্ট বয়স থেকে এই আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞান দরকার। তাহলে জীবন শুরু থেকেই সুন্দর হতে শুরু করবে। তারা মূলত কি করবে?
তুমি অভ্যাস গড়ে তোল সঞ্চয়ের। তুমি ভালো ভালো বই কেন, সেগুলো পড়। আয় বা সঞ্চয় তোমার মূল উদ্দেশ্য নয়। তবে সঞ্চয়ের একটা অভ্যাস গড়ে তোল। কিন্তু তোমার পড়াশোনা, নিজের দক্ষতা উন্নয়ন- এগুলোই হবে তোমার প্রধান উদ্দেশ্য। সব সময় অপ্রয়োজনীয় যে খরচগুলো আছে, সেগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে।
প্রথমত, স্টুডেন্টদের ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি থাকতে হবে। যেহেতু ইউনিভার্সিটি, স্কুল বা কলেজ কোথাও এই ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি শেখাচ্ছে না, তাই এ সম্পর্কিত যে জ্ঞান সেটি তার নিজের আগ্রহে শিখতে হবে, নিজের প্রয়োজনে শিখতে হবে। যে স্টুডেন্ট টাকা আয় করছে না, সেই স্টুডেন্ট কিন্তু টাকা খরচ করছে। সে তার প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়ে কিছু আয় করছে না, কিন্তু তার হাতে টাকা আসছে। তার বাবা, মা, ভাই, বোন তাকে টাকা দিচ্ছেন অথবা সে স্কলারশিপ পাচ্ছে। যে কোনো উৎস থেকেই তার কাছে টাকা আসছে, সেই টাকা সে খরচ করছে। আর যেসব ছাত্রছাত্রী টাকা আয় করছে তারা কীভাবে মূলত করছে? তারা হয়তো টিউশনি করছে বা কেউ পার্টটাইম জব করছে। কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছে।
এখানে একটি কথা ভুললে চলবে না, যারা স্টুডেন্ট তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে পড়াশোনা করা। তাদের কিন্তু প্রচুর টাকা ইনকাম করার কোনো দরকার নেই। কারণ, যখন কোনো ছাত্র প্রচুর টাকা আয়ের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে তখন তার পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ কমে যাবে এবং ফলে রেজাল্ট খারাপ হতে বাধ্য। তাই স্টুডেন্ট লাইফে যে টাকা তার কাছে আসছে, সেটা যথাযথ ব্যবহার করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে এটা কীভাবে ব্যবহার করবে?
টাকাকে প্রথমত সে দুই ভাগে ভাগ করবে। যে টাকাটা তার কাছে আসছে, সেই টাকার ১০-২০ শতাংশ সঞ্চয় করবে। যদি তার কাছে ৫০০ টাকা আসে, তাহলে সে ৫০-১০০ টাকা সঞ্চয় করবে। বাকি যে টাকাটা তার কাছে থাকে, সেটা সে খরচ করবে। ছাত্রছাত্রীদের বলছি তুমি খরচে বেশি উৎসাহী হবে না, বরং সঞ্চয়ে একটু বেশি উৎসাহী হওয়ার চেষ্টা কর। ধীরে ধীরে তোমার হাতে কিছু টাকা জমতে থাকবে। তোমার কোনো বিশেষ প্রয়োজনে, তুমি তোমার সেই জমা টাকার একটা অংশ ব্যবহার করতে পারবে।
আমার কথা হচ্ছে, তুমি অভ্যাস গড়ো সঞ্চয়ের। তুমি ভালো ভালো বই কেন, সেগুলো পড়। আয় বা সঞ্চয় তোমার মূল উদ্দেশ্য নয়। তবে সঞ্চয়ের একটা অভ্যাস গড়ে তোল। কিন্তু তোমার পড়াশোনা, নিজের দক্ষতা উন্নয়ন- এগুলোই হবে তোমার প্রধান উদ্দেশ্য। সব সময় অপ্রয়োজনীয় যে খরচগুলো আছে, সেগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে।
এই টাকাটা তুমি কোথায় রাখবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তোমার খুব বেশি জটিলতার মধ্যে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি যেটা কর সেটা হচ্ছে তোমার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে দেখ ব্যাংকের শাখা আছে এবং ওইসব ব্যাংকে স্টুডেন্টদের জন্য আলাদা অ্যাকাউন্টসেরও ব্যবস্থা আছে অল্প চার্জে। সেই ব্যাংকে টাকা জমা রাখো। খুব অল্প টাকা হলে তুমি সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখো। একটু বেশি হলে তুমি এফডিআর কর।
চেষ্টা কর ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড না ব্যবহার করতে। কারণ ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, এটা তোমার খরচকে উৎসাহিত করে। তুমি দেখবে তোমার প্রয়োজন কেমন। তুমি প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে তোমার কাজ করবে। তুমি চিন্তা করবে তোমার সামর্থ্য নিয়ে। সেই সামর্থ্য থেকে কিছু অংশ সঞ্চয় করার পরে তুমি খরচ কর।
কেউ কেউ স্টুডেন্ট বয়সে ইনভেস্টমেন্ট কীভাবে করা যায় সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে। যে ব্যাংকে তুমি সঞ্চয় করছ, যদি তোমার সেখানে পঞ্চাশ হাজার বা এক লাখ টাকা হয় তাহলে তখন তুমি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করতে পার। তুমি সরকারি সঞ্চয়পত্র কিনে রাখতে পার। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে টাকাটা তুমি সঞ্চয় করছ, ওই টাকাটা খরচ করবা না যদি বেশি বিপদে না পড়।
দেখবে তোমার স্টুডেন্ট বয়স যখন শেষ হবে, তখন হাতে ভালো একটা টাকা জমেছে। স্টুডেন্ট বয়সে আরেকটা কাজ করতে পার, সেটা হচ্ছে তুমি একটা বাজেটিং করে নিতে পার। বাজেটিং মূলত, আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব ঠিক করে নেওয়া। আয়ের উৎসগুলো এবং কত টাকা আয় হচ্ছে সেটা লিখে ফেল। এই টাকাকে তুমি একমাসে কীভাবে খরচ করবে, কত টাকা সঞ্চয় করবে, কোন খাতে কত খরচ করবে এগুলো লিখে ফেল।
বাজেটিং, তোমার অযাচিত খরচ নিয়ন্ত্রণ করে। এবং যখন তুমি কোনো কিছু লিখে ফেল, তখন সামনে একটা পরিষ্কার চিত্র তৈরি হয়ে যায়। তাই বাজেটিং করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আরও একটি বিষয়, তুমি চেষ্টা করবে ঋণ না করতে। স্টুডেন্ট লোন হোক বা পার্সোনাল লোন হোক, লোন না করে চলার একটা অভ্যাস করা যায় কি না সেই চেষ্টা করতে হবে। ঋণ করাও একটা অভ্যাসের ব্যাপার। এ অভ্যাস ছোটবেলা থেকে গড়ে না তোলা ভালো। ঋণের মধ্যে খারাপ ঋণ আছে, ভালো ঋণ আছে।
স্টুডেন্ট বয়সে তোমার শুধু জেনে রাখলেই হবে। খারাপ ঋণ হচ্ছে, সেই ঋণ যে ঋণ শুধু তোমার টাকা পকেট থেকে বের করে নেয়। আর ভালো ঋণ হচ্ছে তোমার পকেটে কিছু টাকা ঢুকিয়ে দেয়, যা হোক আমি বারবার বলবো, স্টুডেন্ট বয়সে আয়ের ওপরে খুব ফোকাস করতে হবে না কিন্তু স্টুডেন্ট বয়সে আয় করা দরকার তাদের যাদের চলতে কষ্ট হয়, যারা বাড়ি থেকে সাপোর্ট ঠিকমতো পায় না।
যারা বাড়ি থেকে সাপোর্ট পায় তাদের আয়ের দিকে বেশি ফোকাস করার কোনো দরকার নেই। তারা বরং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, তাদের রেজাল্ট ভালো করা, সফট স্কিলগুলো ডেভেলপ করা, প্রচুর বই পড়া এগুলো করবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রেনিং করে নিজেদের দক্ষতার উন্নয়ন করবে। টাকা খরচ করার দক্ষতা, টাকা সঞ্চয় করার অভ্যাস, টাকা আয় করার যে অভ্যাস, এটা যত ছোটবেলায় শুরু হয় তত মানুষের উন্নয়নের জন্য মঙ্গল।
অনেকেই খুব ভালো টাকা আয় করেন কিন্তু খরচের যে অভ্যাস সেটা ভালো না হওয়ার কারণে তার হাতে কিছুই থাকে না। তুমি যদি টাকা আয় কর এক হাজার, তোমার আটশো টাকার মধ্যে চলতে শিখতে হবে। নিডস আর ওয়ান্টসের ব্যাপারে একটু জানতে হবে, বুঝতে হবে তোমার কোনটা আসলে দরকার।
কোনো জিনিস কেনার আগে প্রথমে প্রশ্ন করতে হবে যে, এটা কি আসলেই আমার লাগবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, এটা কি আমি কিনতে পারি? তৃতীয় প্রশ্ন, যদি আমি না কিনি তাহলে কি আমার চলবে নাকি চলবে না? আর যদি এমন হয় যে, না কিনলে আমার অল্টারনেটিভ দিয়ে আমি চলতে পারি, তাহলে আমি কেন কিনবো? টাকা যদি তোমার হাতে থাকে, তুমি ভবিষ্যতে খরচ করতে পারবে। টাকা খরচের ব্যাপারে আমাদের মুন্সিয়ানা থাকতে হবে, আমাদের বিচার বিবেচনা বোধ থাকতে হবে। পরিশেষে আর একটা বিষয় যোগ করা দরকার। তুমি যদি পার ৬ মাস চলার মতো একটা ইমারজেন্সি ফান্ড গঠন করার চেষ্টা কর।
পরিশেষে বলি যে, স্টুডেন্ট বয়স হওয়া দরকার একটা শিক্ষার সময় সব দিক থেকে। লেখাপড়া শেখার পাশাপাশি ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি ধীরে ধীরে আয়ত্ত করা শেখ। পরে যখন তুমি কর্মজীবনে ঢুকবে, আয় শুরু করবে, চাকরি বা ব্যবসা শুরু করবে, তখন এই জ্ঞান তোমাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে, আর্থিক স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তুমি আর্থিকভাবে স্বাধীন হবে, অয়েলদি হবে।
লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।
এইচআর/ফারুক/এএসএম