কে না চায় এমন কান্না!
কিছু কান্না মানুষ কামনা করে। আবেগের কান্না সেটা-আনন্দের কান্না। সন্তানের সাফল্যই বোধ হয় এর বড় প্রমাণ। এর বাইরেও সুখের কান্না আছে। গুরুত্ব বিবেচনায় এমন কান্নাগুলো অবশ্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে অনাত্মীয় কারো সাফল্য যদি মানুষকে আবেগতাড়িত করে, তখন সেই কান্না হয় নিখাদ। একবারে অন্তর থেকে কাউকে ভালো না বাসতে পারলে সেই কান্না কখনো আসে না।
এমন ভালোবাসা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। সে যদি হয় সরকারি কোনো কর্মকর্তা, তাহলে অবশ্যই এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। কারণ সাধারণ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণাই অধিক। সরকারি কর্মকর্তা বলতেই সাধারণ মানুষ মনে করে দুর্নীতিবাজ, অহংকারী এবং শোষকের প্রতীক। এর মধ্যেও কিছু ঘটনা মানুষকে নাড়া দেয়। শুধু নাড়াই দেয় না, মনে দীর্ঘস্থায়ী আসন করে নিতেও সক্ষম হয়।
১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত জাগো নিউজের এমনি একটি সংবাদ মনে দাগ কাটার মতো। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হায়াত শিবগঞ্জ ছেড়ে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার যোগ দিতে যাওয়ার সময় শিবগঞ্জের মানুষের বিদায় জানানোর দৃশ্য সেটা। রীতিমতো অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা। একজন সরকারি কর্মকর্তার বিদায় তাদের চাকরি বিধান অনুযায়ী রোটিন বিষয়। কারণ তাদের চাকরিই বদলিযোগ্য। ফলে আবুল হায়াত এর বদলির বিষয়টি অস্বাভাবিকত্বের মধ্যে পড়ে না। একাধিক ছবিযুক্ত এই সংবাদ পড়ে যে কারো মনে আশার সঞ্চার হতে পারে।
কিন্তু সংবাদ বর্ণনা পড়ে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, যে আবুল হায়াত আমাদের সমাজের সফল একজন মানুষ এবং প্রজাতন্ত্রের গৌরবজনক চরিত্রও বটে। তাকে বিদায় জানাতে উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ জড়ো হয়েছিলো উপজেলা অফিস চত্বরে। তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ইউএনওকে বিদায় জানাতে গিয়ে।
আবুল হায়াত মানুষকে এভাবে কাঁদাতে পারলেন, মানুষের নিখাদ ভালোবাসা আদায় করতে পারলেন, এই অনুভূতি তাকে বাকি জীবন কাজে অনুপ্রেরণা জোগাবে। আমি নিশ্চিত আবুল হায়াত তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কান্না দেখেছেন, হয়তো সেই আনন্দের বন্যায় তিনিও ভেসেছেন।
জীবনভর তাঁর মনে থাকবে, মানুষের এই ভালোবাসার কথা। অন্যদিকে আবুল হায়াতের মতো কর্মকর্তার সংখ্যা যত বাড়বে মানুষের নেতিবাচক ধারণাও ততটা কমতে থাকবে। আবুল হায়াতের মতো কর্মকর্তারা আছেন বলেই প্রশাসন চালানো সম্ভব হচ্ছে সরকারের পক্ষে। কয়েক হাজার বিসিএস কর্মকর্তা অবশ্যই গর্ব বোধ করতে পারেন একজন আবুল হায়াতকে নিয়ে।
আবুল হায়াতের মতোই আরেকজন ইউএনও’র কথা প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে চাই। তিনি আমার নিজ উপজেলায় কর্মরত ছিলেন। গত সেপ্টেম্বরে তিনি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় ইউএনও হিসেবে শেষ দায়িত্ব পালন করেন। নাম সোহেল রানা। সোহেল রানা এখন অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করার জন্য অবস্থান করছেন।
মেধাবী অফিসারদের জন্য দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপ লাভ করেছেন। ফেলোশিপ পাওয়ার শর্ত ছিলো- ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং এ সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটিতে ভর্তির যোগ্যতা দেখাতে হবে। সোহেল রানা সেই যোগ্যতা অর্জন করে প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপ নিয়ে ১০জন ইউএনও-র মতো অস্ট্রেলিয়া গিয়েছেন।
আবুল হায়াতের মতো দৃশ্য দেখা গেছে ব্রাহ্মণপাড়াতেও। এই বছর মে মাসে তাকে বদলীর আদেশ দিয়েছিলো সরকার। কিন্তু ব্রাহ্মণপাড়ার মানুষ তার বদলীর আদেশ বাতিল করিয়েছে। অসংখ্য মানুষ দরখাস্ত নিয়ে গেছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। আবেদন জানিয়েছে, এমন যোগ্য ইউএনও-কে সরানো যাবে না। ঊধ্র্বতন কর্তৃপক্ষ জনগণের কথা শুনেছে। তার বদলির আদেশ বাতিল হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণপাড়ায় থাকতে পারেননি বেশিদিন। অনিবার্য কারণেই তাকে চলে যেতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে আমারও পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিলো সোহেল রানার সঙ্গে। তিনি দায়িত্ব পালনকালে ওই এলাকার এমন কিছু কাজ করেছেন, যা ছিলো রীতিমতো কল্পনার বাইরে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-সিদলাই গ্রামে শতাধিক বছরের পুরনো বিবাদ মিমাংসা। ওই গ্রামে দুটি গোত্রের মধ্যে এই বিবাদে প্রতি বছর ২/৪জন মানুষ খুন হতো।
চরম অশান্তিপূর্ণ একটি গ্রাম ছিলো এই সিদলাই। তিনি বিবদমান দুটি গোত্রকে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করেন, তাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন তৈরি করতে সক্ষম হন। সোহেল রানার আগে বিভিন্ন সময় ওই গ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কেউ সফল হননি। সোহেল রানা সেখানে দুই গোত্রের দৃঢ় বন্ধন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন।
মাদক নিয়ন্ত্রণে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা বরাবরই উদ্বেগের কারণ ছিলো। তিনি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের দমনের পাশাপাশি কিশোর তরুণদের সুস্থ বিনোদন মাধ্যমে সৃজনশীল করে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেন। উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে তিনি নিয়মিত ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের সুস্থ বিনোদন দেওয়ার উদ্যোগ নেন। প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে সোহেল রানার এসব কাজও ভূমিকা রেখেছে।
শিবগঞ্জের আবুল হায়াতের মতো সোহেল রানার বিদায়েও ব্রাহ্মণপাড়ার মানুষ এভাবেই চোখের পানি ফেলেছেন। বিদায়ের আগে কয়েকদিন পর্যন্ত তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ব্রাহ্মণপাড়ায় নতুন ইউএনও হিসেবে যোগ দিয়েছেন স.ম.আজহারুল ইসলাম। তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাকে গর্বসহ বলেছি সোহেল রানা সম্পর্কে।
অথচ এমন একটা লোক সম্পর্কে গর্ব বোধ করছি যিনি আমার আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধুও নন। কিন্তু তিনি দেখিয়েছেন ইচ্ছা থাকলে মানুষের কল্যাণ করা যায়। স. ম. আজহারুল ইসলামের মতো বাংলাদেশের উপজেলাগুলোতে এখন যারা কাজ করছেন তারা তাদের সহকর্মীদের উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করলে তারাও জীবনকে নতুনভাবে উপভোগ করতে পারবেন। মানুষও উপকৃত হবে।
কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিদায়ে মানুষের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়ার ভিন্ন আরেকটি বিশ্লেষণও হতে পারে। এই কর্মকর্তাগণ তাদের সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। নিয়মিত দায়িত্ব পালনের পরও মানুষের এই উচ্ছ্বাস থেকে প্রমাণ হয়,অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাগণ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না।
নেতিবাচক ভূমিকার মধ্যে কেউ যদি মানুষের কাছাকাছি হতে পারে, মানুষের জন্য কিছু করে তখন স্বাভাবিকভাবেই দুর্বলতা তৈরি হয়। যে কারণে সোহেল রানা কিংবা আবুল হায়াতের প্রতিও মানুষের দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। তাঁরা কেঁদে সেই কৃতজ্ঞতা, সেই ভাবই প্রকাশ করেছেন।
প্রতিটি উপজেলায় এমন আবুল হায়াত ও সোহেল রানা তৈরি হোক, প্রতিটি সরকারি দফতরে তাদের মতো কর্মকর্তা তৈরি হোক, মানুষ তাদের প্রাণভরে ভালোবাসবে,তাদের কল্যাণ কামনা করবে।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এমএস