গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ই হবে বিজয় দিবস পালনের সার্থকতা
পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে ৯ মাস বীরবিক্রমে লড়াইয়ের পর আসে বিজয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণ বাঙালি জাতির কাছে বিজয় দিবস। জেনোসাইড বা গণহত্যা চালিয়ে বাংলার মাটিকে রক্তাক্ত করে তুলেছিল পাকিস্তানি হানদাররা। বাঙালি জাতিকেই তারা ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। দেশীয় রাজাকার ও আলবদররা তাদের মদদ জুগিয়েছিল। ৩০ লক্ষ শহীদ ও মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়কে ধরে রাখাই প্রতিটি বাঙালির কর্তব্য। সেইসঙ্গে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করার লড়াইও চালিয়ে যেতে হবে।
১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় দিবস। ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে জাতীয় ছুটি হিসাবেও সরকারিভাবে ঘোষনা করা হয়। গোটা দেশ দিনটিকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করে। বড় গর্বের দিন এটি। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা লাভের দিন। ঢাকায় সাবেক রেসকোর্স ময়দান, বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯১ হাজার ৬৩৪ সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। লেঃ জেনারেল আমির আববুল্লাহ খান নিয়াজী যৌথবাহিনীর প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল খোন্দকারও উপস্থিত ছিলেন। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শেষ হয় পাকিস্তানি হানাদারদের ও দেশীয় রাজাকার- আলবদরদের যৌথ সন্ত্রাস এবং মানবতাবিরোধী সহিংসতা।
১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক গৌরবময় দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে বাঙলি জাতির একটি স্বাধীন ভূখণ্ড আত্মপ্রকাশেরও দিন ১৬ ডিসেম্বর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল বাঙালির সংগ্রাম। এরপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯'র গণঅভ্যুত্থান, ৭১'র ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
বিজয় এমনি এমনি আসেনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভয়ঙ্কর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে অর্জিত হয়েছে বিজয়। মহান মুক্তিযোদ্ধাদের সমানে মদদ জুগিয়েছে ভারত। চীন ও আমেরিকা পাকিস্তানি বর্বরতাকেই সহায়তা দিলেও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সর্বোতভাবে সাহায্য করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধকে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং ভারতের জনগণ সর্বোতভাবে পাশে ছিল আমাদের। ভারতের আন্তরিক সাহায্য, বহু প্রাণ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিজয়ের লাল সূর্য অর্জিত হয়।বাঙালি জাতির ওপর পাশবিক অত্যাচার চালানোর পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদিন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাদের এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ দুই যুগের পাকিস্তানি শোষণ আর বঞ্চনার। কিন্তু আজও মেলেনি গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করলেও আজও সরকারিভাবে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি ইসলামাবাদ। আমেরিকা ও চীন সেদিন পাকিস্তানি হানাদারদের মদদ জোগালেও আজ সেকথা ভুলে বন্ধুত্বের বার্তা দিতে চাইছে।
তবে যুদ্ধাপরাধীদের অনেকের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা শাস্তিও পাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গোটা জাতি আজ পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় পুরো জাতি স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী লাখো শহীদদের। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেটির উদয় ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তাই দিনটি সত্যিই ঐতিহাসিক এবং গর্বের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' খ্যাত কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণ ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃত ঘটনা প্রবাহের মধ্য স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন- সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালির উপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতি। সেই যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয় ঘটে।
লাখো শহীদের রক্তে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ষরযন্ত্র বন্ধ হয়নি। ষড়যন্ত্রকারীরা জাতিরপিতাকেই নৃশংসভাবে হত্যা করে অর্জিত স্বাধীনতাকেই লুট করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সেই ষড়যন্ত্র বারবার রুখে দিয়ে বাংলাদেশের সফল অগ্রযাত্রার পথকে প্রশস্ত করেছে। তাই হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়িই আজ গোটা দুনিয়ার চোখে অর্থনৈতিক বিশ্ময়।বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে শুধুমাত্র স্থিতিশীল গণতন্ত্রই উপহার দেননি, তার সুযোগ্য নেতৃত্বে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আজ বাস্তবতা। যুদ্ধাপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাচ্ছেন তাদের যোগ্য সম্মান। তবু রাজাকার ও আলবদরদের উত্তরসূরিরা বিভিন্ন নামে ও পরিচয়ে বিজয়ের গড়িমাকে আজও লুণ্ঠন করার চেষ্টায় মত্ত। তাদের মদদ জোগাচ্ছে সাবেক সামরিক শাসক, প্রয়াত জিয়াউর রহমানের হাতে তৈরি দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভোট লুটেরাদের দল বিএনপি এবং তাদের দোসর, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যেমন বিদেশি শক্তি সক্রিয় ছিল, এখনও তেমনি বিএনপি-জামায়াতদের বিদেশি মদদের অভাব নেই। তাই এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়াটাই হবে বিজয় দিবস পালনের সার্থকতা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর