শিশুহত্যা ও নির্লজ্জতা করে যুদ্ধে জেতা যায় না
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্মম আক্রমণের আটচল্লিশ দিন পর মাত্র সাতদিনের যুদ্ধবিরতি দেওয়া হয়েছিল। সেটার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরদিনই আবারো নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী। হামাসের সদস্য নয় এমন পুরুষ ফিলিস্তিনিদের ধরে অর্ধনগ্ন করে শহরে ঘুরানোর মতো ন্যক্কারজনক কাজ করছে তারা।
ইতোমধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে জিম্মি বিনিময় প্রক্রিয়া শেষ করা হলেও এখন ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি শত শত নারী-শিশু। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলি বাহিনী যুদ্ধের নামে নিষ্ঠুর পন্থায় নারী-শিশু হত্যা, শরণার্থী শিবিরে হত্যা, হাসপাতাল ধ্বংস, লজ্জাহরণ করে নৈতিকতা হারিয়ে অনেক নিচু প্রাণীর কাতারে নেমে যাওয়ায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দিয়েও মানবিকতার পথে ফিরে আসতে পারলো না।
গত অক্টোবরের ৭ তারিখে যুদ্ধ শুরুর দশ দিন পর বলা হয়েছিল, ‘যদি বাঁচতে চান তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজার দক্ষিণে সরে যান।’ ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ গাজাকে নিরাপদ ঘোষণা দিয়ে সাধারণ ফিলিস্তিনি জনগণকে উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ সরে যাওয়ার এরূপ নির্দেশ দিলেও ২১ দিন পর থেকে দক্ষিণের নিরাপদ এলাকায় ট্যাংক ঢুকিয়ে নির্মমতা চালিয়েছে। স্থল অভিযানের সময় একই সাথে বিমান দ্বারা নিষিদ্ধ বোমা ছুড়ে নির্বিচারে বসতবাড়ি, বেসামরিক এলাকা, মসজিদ, গির্জা, শরণার্থী শিবির, হাসপাতাল ধ্বংস করে নিষ্ঠুরতার সীমা অতিক্রম করেছিল।
ইসরায়েলিরা হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে শিশু-নারী হত্যা করে ও হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিয়ে, পুরুষদের অর্ধনগ্ন করে রাস্তায় প্রদর্শন করে যতই নির্লজ্জ কাজ করুক, নিষ্ঠুরতা চালাক না কেন তারা বারবার যুদ্ধ করতে থাকলেও স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে কখনও জয়লাভ করতে পারবে না। বলা যায়, এই নির্মম শিশু হত্যার বদলা থেকেই হয়তো একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের পতাকা উড়তে আর বেশি দেরি নেই।
গোটা গাজায় এসব বর্বরতায় নির্বিচারে মারা গেছে নিরীহ মানুষ। বেশিসংখ্যক মারা গেছে নারী ও শিশু। ডিসেম্বর ০৯, ২০২৩ পর্যন্ত গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে সাড়ে ১৬ হাজারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি অবুঝ শিশু। জাতিসংঘ মহাসচিব আক্ষেপ করে বলেছেন, গাজাভূমি শিশুদের কবরস্থান!
বিশ্বের বড় যুদ্ধবাজ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী ইউরোপীয় ইউনিয়নের উসকানি এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইসরায়েলি সৈন্যরা আরও বেশি আস্কারা পেয়ে গণহত্যায় নেমে পড়েছিল। পেন্টাগণের নির্দেশে মার্কিন স্পেশাল গার্ডের ৯০০ সৈন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মার্কিন শিবির থেকে বেরিয়ে গাজায় যৌথ অভিযানে অংশ নিয়েছিল।
জাতিসংঘের মহাসচিব যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালে ইসরায়েলিরা তার বিরোধিতা করেছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিল চীন ও রাশিয়া। অচিরেই যুদ্ধবিরতি না দিলে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল হামাস।
হামাসের হুমকির পাশাপাশি লেবাননের হিযবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রেহিরা ইসরায়েলে দূরপাল্লার রকেট আক্রমণ চালানো শুরু করার এক সপ্তাহ পার না হতেই চারদিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। এই চারদিন পার হলে কি ঘটতে পারে তা নিয়ে অনেকে শঙ্কিত।
শেষদিকে ইসরায়েলি বাহিনী বেছে বেছে শিশুদের হত্যাভিযানে নেমেছিল। কারণ, ফিলিস্তিনি শিশুদের তাদের বড় ভয়। খালি হাতে অথবা এক টুকরো পাথর নিয়ে বর্বর ইসরায়েলি সৈন্যদের বিরুদ্ধে তেড়ে আসার ভিডিওতে ফিলিস্তিনি শিশুদের মনের তেজ দেখে হয়তো ইসরায়েলি সৈন্যরা তাদের বেশি বেশি টার্গেট করেছিল।
ফিলিস্তিনি কোমলমতি শিশুরা যখন মায়ের কোলে আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে তখন বোমা, গুলি তাদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। শিশুদের বাবা-মায়ের মন দুর্বল করে দেওয়ার জন্য শিশু হত্যার ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করে চলেছে যৌথ অভিযানে অংশ নেওয়া মার্কিনি-ইসরায়েলি সৈন্যরা। এক অধিবেশনে জাতিসংঘ মহাসচিব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযোগ করে বলেন, বড় বড় শক্তিগুলোর নিষ্ঠুরতার কারণে গাজা এখন একটি ‘ডেড সিটি’ বা মৃত নগরী এবং নিষ্পাপ শিশুদের কবরস্থান!
শিশু হত্যা করা মানবতাকে ধ্বংসের শামিল বিবেচনা করা হয়। তাই যুগে যুগে এটাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এটার লঙ্ঘন করা যুদ্ধাপরাধের বড় কারণ হিসেবে ধরা হয়। আমেরিকা-ইউরোপ নিজেরা মানবাধিকারের ধ্বজাধারী হিসেবে নিজেদের মহৎ মনে করে অহমিকা করে বেড়ায়। কিন্তু গাজায় শিশু হত্যার ব্যাপারে তারা ইসরায়েলকে অন্ধ সমর্থন জুগিয়েছে।
আমেরিকা-ইউরোপ নিজেরা মানবাধিকারের কথা বলে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বেশি প্রচার করে ইসরায়েলি হামলায় রসদ জোগান দিচ্ছে। কিন্তু হামাসের জন্ম হয়েছে ১৯৭৯ সালে। আর ইসরায়েল দখলদারত্বের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে শিশু হত্যা শুরু করেছে ১৯৪৮ সাল থেকে। যখন হামাসের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তারা সেসব ইতিহাস ভুলে গিয়ে কপটতার মাধ্যমে একচোখা নীতি অবলম্বন করে চলেছে।
সেজন্যই হয়তো করোনার সময় উন্নত সভ্যতা ও উন্নত চিকিৎসার ধ্বজাধারীদের দেশগুলোতে প্রকৃতি নিজেই প্রতিশোধ নিতে উদ্যত ছিল। দেশে দেশে নির্যাতিত মানুষরা যেখানে ওদের চালবাজি ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে নিরুপায় সেজন্যই হয়তো করোনায় দশ লক্ষাধিক মৃত্যুর ঘটনা এমন কপট ও জালিমদের দেশ ছাড়া আর কোথাও ঘটতে দেখা যায়নি।
নিষ্পাপ শিশু হত্যাকারীদের সবসময় কোনো না কোনোভাবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতেই হয়। আমাদের দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ এমনকি পরে শিশু রাসেল হত্যাকারীদের ইতিহাস ক্ষমা করেনি। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা যে কারণে চালু হয়েছে সেখানেও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। কারণ, মহান আল্লাহ চাননি একটি ফুটফুটে শিশুকে তার স্বপ্নাদেশের নির্দেশে বাবার মাধ্যমে তাকে খুশি করার জন্য ছুরির নিচে প্রাণ দিতে হোক!
এ ঘটনা প্রমাণ করে শিশুরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট কত প্রিয়। তারা এসব জানে ও বোঝে। তারপরও এ ঘৃণ্য কাজ করতে তারা কখনও দ্বিধা করে না। তাদের কোনো আক্ষেপও নেই। কারণ তারা ক্রমাগতভাবে আল্লাহর নাফরমানি বা নির্দেশ অমান্য করে আসা এক অভিশপ্ত, উদ্বাস্তু, বেপরোয়া মানবজাতি।
অথচ ইসরায়েলিরা হামাসকে নির্মূল করার নামে ফিলিস্তিনি নিষ্পাপ শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করে একক ভয়ংকর ঘৃণ্য ও নিষিদ্ধ খেলায় মেতে উঠেছে। পশ্চিমারা জুলুমবাজ ইসরায়েল রক্ষায় ক্রুসেড ঘোষণা করেছে। কিন্তু পাশের বিত্তশালী মুসলিম দেশের নেতারাসহ বিশ্ব বিবেক তাকিয়ে দেখছে। হাজার হাজার শিশুর লাশ কোলে নিয়ে স্বজনদের আহাজারি দেখেও এ ব্যাপারে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা বিশ্ববিবেককে ভাবিয়ে তুলছে।
শুধু কাতার, তুরস্ক, লেবানন ও ইরান প্রতিবাদে বেশি সোচ্চার। রাশিয়া ও চীন ভেটো ক্ষমতা নিয়ে সাড়া দিলেও চীনারা নিজ দেশে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে চান না। রাশিয়া প্রতিবেশী ইউক্রেনে অসংখ্য নারী-শিশুহত্যা করে মানবাধিকারের রশি ধরে রাখার ক্ষমতা ও নৈতিকতা হারিয়েছে।
ইসরায়েলি সৈন্যরা শিশু হত্যাকারী। মার্কিনিরা তাদের দোসর। উভয়ের যোগসাজশে গাজাকে মানবশূন্য করাটাই বড় টার্গেট। জাতিসংঘের মহাসচিব মাঝে মধ্যে এর কিছুটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেও তিনি মার্কিনিদের হাতের পুতুল হয়ে পড়েছেন। তাই অনেকে বলছেন, জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউইয়র্ক থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হোক।
যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। অনৈতিক যুদ্ধ কারও কল্যাণ বয়ে আনে না। মাতৃভূমি রক্ষার জন্য দখলদার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। নিরীহ ফিলিস্তিনিরা তদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার তাগিদে ইসরায়েলি বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাছে আজ বড়ই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি জবরদখল করে তাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা চালিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনিরা নিজেরা প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে এবং তাদের ভবিষ্যৎ বংশধারা প্রিয় শিশুদের অকালে হারিয়ে ফেলছে। শিশু হত্যাকারীদের ক্ষমা নেই, ইতিহাস বলে পৃথিবীতে তাদের কোথাও ঠাঁই নেই।
ইসরায়েলিদের অতি চাতুরি ও মিথ্যাচার- হামাসকে নির্মূল নয়, গোটা ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করাই তাদের উদ্দেশ্য। এজন্য তারা গাজাকে শিশুদের কবরস্থান বানিয়েছে। বিশ্বসন্ত্রাসীরা একজোট হয়ে এই শিশুকবরস্থানে নিজেদের শাসন-নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে।
গাজায় বহুমুখী যৌথ হামলায় নারী-শিশুদের নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে সেটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে কথা হলো- গাজার শিশুকবরস্থানে ওদের সুখের আবাসন পরিকল্পনা সহ্য হবে তো? একদিন যুদ্ধ থেমে গেলেও মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনিদের জিহাদ কখনই শেষ হবে না।
ইরায়েলিরা হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে শিশু-নারী হত্যা করে ও হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিয়ে, পুরুষদের অর্ধনগ্ন করে রাস্তায় প্রদর্শন করে যতই নির্লজ্জ কাজ করুক, নিষ্ঠুরতা চালাক না কেন তারা বারবার যুদ্ধ করতে থাকলেও স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে কখনও জয়লাভ করতে পারবে না। বলা যায়, এই নির্মম শিশুহত্যার বদলা থেকেই হয়তো একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের পতাকা উড়তে আর বেশি দেরি নেই।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]
এইচআর/ফারুক/এএসএম