পোশাক খাত : সংকট উত্তরণ ও সরকারের সাফল্য

অমিত দত্ত
অমিত দত্ত অমিত দত্ত , লেখক: প্রভাষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত: ০৯:৫২ এএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩

তৈরি পোশাক শিল্প খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। এ খাতটি শুধু জাতীয় অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করেনি, একইসাথে নিশ্চিত করেছে অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান। বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এবং পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস যা জিডিপিতে ১১ শতাংশ অবদান রাখছে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে সামনের সারিতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৩০টি অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশকে ধরা হয়। বদলে যাওয়া এই অর্জনের পেছনে সহায়ক হিসেবে রয়েছে পোশাক শিল্প।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে যে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে রফতানি ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে এ শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে এরইমধ্যে সরকারের সহায়তায় পণ্য বহুমুখীকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ, ফাইবার বহুমুখীকরণ এবং দক্ষতা উন্নয়ন, ইনোভেশন ও টেকনোলজি আপগ্রেডেশন এবং কস্ট-কম্পিটিটিভ হওয়ার মাধ্যমে ভ্যালু চেইনে এগিয়ে থাকার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা এসব নিয়ে কাজও করছেন।

ক্রেতারা ক্রমাগতভাবে আগের তুলনায় কম মূল্য প্রস্তাব করছে, যা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে ক্রেতারা কম মূল্য দিচ্ছে। ফলে স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। সুতরাং এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত সব মহলের দায়িত্বশীল হতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক খাতে কাজ করছেন ৩২ লাখ শ্রমিক। পোশাক খাতে মোট শ্রমিকের প্রায় ৫৮ শতাংশ নারী ও ৪২ শতাংশ পুরুষ। তৈরি পোশাক শিল্পে এ বিপুলসংখ্যক নারীর অবদান এ খাতকে এক অন্যান্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ২০২১ সালে বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। বৈশ্বিক রপ্তানিতে অংশ ছিল ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ।

পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে দেশটি দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। গত সোমবার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৪৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে।

এ শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে এরইমধ্যে সরকারের সহায়তায় পণ্য বহুমুখীকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ, ফাইবার বহুমুখীকরণ এবং দক্ষতা উন্নয়ন, ইনোভেশন ও টেকনোলজি আপগ্রেডেশন এবং কস্ট-কম্পিটিটিভ হওয়ার মাধ্যমে ভ্যালু চেইনে এগিয়ে থাকার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা এসব নিয়ে কাজও করছেন।

চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জুলাই মাসে যুক্তরাজ্য এবং কানাডায় পোশাক রফতানি যথাক্রমে ৪৭৫ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন এবং ১২৮ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং ১৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

একই সময়ে অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রফতানি ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। টাকার অঙ্কে এটি ৬৭৪ দশমিক ৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। প্রধান অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় রফতানি যথাক্রমে ৪৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ৫৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ, ২ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়েছে।

বিভিন্ন তথ্যসূত্র জানাচ্ছে যে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মডেল অনুসরণ করা হয়েছে। বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ পোশাক শিল্পের টেকসই কৌশলগত রূপকল্প ২০৩০ প্রণয়ন করেছে।

এ রূপকল্পের অভীষ্ট হচ্ছে— মানুষ ও পরিবেশ, অর্থাৎ এ সবুজ গ্রহকে বিপন্ন না করে শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করা, যা ইএসজির (এনভায়রনমেন্টাল সোশ্যাল গভর্ন্যান্স) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বাংলাদেশের ২০০টি গ্রিন পোশাক কারখানার মধ্যে ৭৩টি প্লাটিনাম ক্যাটাগরিতে, ১১৩টি গোল্ড ক্যাটাগরিতে এবং ১০টি সিলভার ক্যাটাগরিতে, আর চারটি ‘লিড সার্টিফায়েড হিসেবে প্রত্যয়িত হয়েছে। আরও প্রায় ৫০০টি বাংলাদেশি কারখানা লিড সনদ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

যদিও এই খাত বাংলাদেশের রপ্তানী আয়ের সিংহভাগ অর্জন করে। তবে নানা সময় পোশাক মালিকদের অবহেলা ও সরকারের সাথে প্রতিশ্রুত অনেক শর্ত না মানার কারণে নানাবিধ জটিলতা বেশ নৈমিত্তিক ঘটনা। তবে বর্তমান সরকার এই সকল সমস্যা মাথায় নিয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ ও গ্রহণ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাভোসের কংগ্রেস সেন্টারে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের ৪৭তম বার্ষিক সভার “শেপিং এ নিউ ওয়াটার ইকোনমি’ শীর্ষক এক কর্মশালায় বলেন যে, তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে তাঁর সরকার দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র শিল্পের অবদান বিশাল।

এই শিল্পে শ্রমিক অধিকার, কর্মস্থলের নিরাপত্তা ও পরিবেশগত মানসহ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমরা দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বেতন কাঠামো, কর্মস্থলের নিরাপত্তা, রীতিনীতি এবং শিল্পখাতে সহনশীল সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প উচ্চতর মান অর্জন করেছে। এই খাতের সংকট নিরসনের জন্য বর্তমানে বাংলাদেশের ৩৮টি কারখানার এলইইডি সনদপত্র প্রদান করেছে। বিশ্বের ১০টি শীর্ষ স্থানীয় পরিবেশবান্ধব কারখানার মধ্যে ৭টি বাংলাদেশে রয়েছে।’

তৈরি পোশাক খাতে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দূষিত পানি শতভাগ শোধন এবং পানি ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার ‘২০৩০ ওয়াটার রিসোর্স গ্রুপ’ (ডব্লিউআরজি)- এর সাথে কাজ করছে। আগামী, ‘২০৩০ ডব্লিউআরজি’র সাথে আমাদের কাজের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে- দূষিত পানি পরিশোধনে বড় অঙ্কের অর্থের ব্যবস্থা করা, দূষিত পানি পরিশোধনে আর্থিক ও অর্থ-বর্হিভূত প্রণোদনা দেয়া, সমগ্র বাংলাদেশে পানির ব্যবহারের লক্ষ্যে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নত করা, এবং পানি শাসনের জন্য বেসরকারি খাত ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।”

তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশের ফলে বাংলাদেশে ঘরের বাইরে নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। ফলে নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বেড়েছে। বর্তমানে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের একটি সাধারণ দৃশ্য হলো হাজার হাজার নারী পোশাক কারখানায় যাচ্ছেন, যা তিন দশক আগেও কল্পনা করা যেত না। অর্থাৎ তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশ বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিয়েছে।

অতীতে এই খাত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছে। ১৯৯০–এর দশকের মাঝামাঝি শিশুশ্রমের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। সরকার এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরা এগিয়ে আসেন, তারা শিশুশ্রম বন্ধ করেন।

আন্তর্জাতিক ক্রেতারা কর্মপরিবেশ উন্নতির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ড অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করে এবং নিয়মিত অডিটের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করে। ২০০৬ সালে এই খাতে শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ছিল ১ হাজার ৬৬২ টাকা যা বর্তমানে সরকারের প্রচেষ্টাই ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ৮ হাজার টাকা।

বর্তমানে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন ১২ হাজার ৫০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা বেতন নির্ধারণ করে ন্যূনতম মজুরির খসড়া সুপারিশ প্রকাশ করেছে সরকার; যেখানে পাঁচটি গ্রেড রাখা হয়েছে। অপরদিকে পোশাক কারখানার কর্মচারীদের চারটি গ্রেডে বেতন দেওয়ার সুপারিশ করেছে নিম্নতম মজুরি বোর্ড; যেখানে তারা সর্বনিম্ন ১২ হাজার ৮০০ এবং সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৮০০ টাকা বেতন পাবেন।

এর পাশাপাশি অন্য উল্লেখযোগ্য সংস্কারগুলো হলো বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ সংশোধন, পেশাগত ও স্বার্থ নিরাপত্তা নীতি ২০১৩ এবং শ্রমিকনীতি ২০১৫। এর সঙ্গে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ২০১৯ সালের মে মাসের প্রথম ২৯ দিনের তুলনায় ২০২০ সালের মে মাসের প্রথম ২৯ দিনে ৬২ শতাংশ কমে যায়। করোনাকালের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাবের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য ৫৯০ মিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা ঘোষণা করে। এই প্রণোদনার মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের বেতন–ভাতা প্রদান করা। আশার কথা হলো, মহামারির দুই বছর পর আবারও তৈরি পোশাকশিল্প কারখানাগুলো কর্মমুখর হয়ে ওঠে।

এই শিল্প বাংলাদেশের স্বপ্ন ও গর্ব। কারণ, বিশ্বের সর্বোচ্চসংখ্যক পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা এখন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তহবিল গঠন এর একটি।

প্রধান ক্রেতাদের সহযোগিতায় কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ক্রেতারা ক্রমাগতভাবে আগের তুলনায় কম মূল্য প্রস্তাব করছে, যা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে ক্রেতারা কম মূল্য দিচ্ছে। ফলে স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। সুতরাং এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত সব মহলের দায়িত্বশীল হতে হবে।

তবে এ প্রক্রিয়ায় শ্রমিকের কল্যাণকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। তাহলেই এই শিল্পের উন্নয়ন সামগ্রিকভাবে এগিয়ে যাবে যা এ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকে আরো বেশি সহজতর করবে।

লেখক: প্রভাষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।