যারা বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠান তারা কি ভুল করে জানলে অবাক হবেন
আপনারা যারা বিদেশের মাটিতে থেকে অনেক কষ্ট করে আয় উপার্জন করে দেশে আত্মীয় স্বজনকে টাকা পাঠান এই প্রত্যাশায় যে পরিবারের সবাই সুন্দরভাবে দিন যাপন করবেন তাদের জন্য আজকে আমার এই লেখা। যারা আমার ইউটিউব চ্যানেল finfacts এর ভিডিও শুনে আমাকে অনুরোধ করেছেন কিছু বলতে ও লিখতে তাদের জন্য কিছু পরামর্শ আমি দিব যেটা যারা বিদেশ থেকে টাকা পাঠান তারা মেনে চললে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখতে পারবেন।
আমরা জানি অনেকেই অনেক বছর বিদেশে থাকার পরে যখন এয়ারপোর্টে এসে নামছেন, তখন পরিবারের কোনো সদস্য তার সাথে দেখা করতে আসছেন না বা তাকে রিসিভ করতে আসছে্ন না। আবার বাড়িতে যাওয়ার পরে পরিবারের অনেক সদস্যই তাঁর প্রতি অপরিচিতের মতো আচরণ করছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে ছেলেটা ফিরেছে ওই বাড়িতে, কিন্তু খুব আপন আত্মীয় স্বজনরাই তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। কি দুঃখজনক।
পত্রিকাতে এমন অনেক খবর বেরিয়েছে। এমনও দেখা গেছে যে, ছেলে যে টাকা পাঠিয়েছে সে টাকার কোনো হিসেব নেই এবং সেই টাকায় কেনা সম্পত্তিতে তার নিজের কোনো অংশ নেই। আমি বলছি না যে, এটা সবার ক্ষেত্রে ঘটেছে বা ঘটবে। অবশ্য বেশিরভাগ ছেলেই বাড়িতে সমাদৃত হয়েছেন, আপন মানুষের কোলে ঠাঁই পেয়েছেন। আজ আমার পরামর্শ সবার জন্য।
পাঁচ বছর, দশ বছর বাইরে কাজ করেছেন এক টাকাও নিজে সঞ্চয় করেননি। সমস্ত টাকা দেশে পাঠিয়েছেন কিন্তু দেশে ফিরে আসার পরে দেখেন যে আপনার টাকাও নাই, স্ত্রীও নাই। আবার ভাই, বাবা, মা সবাই আছে কিন্তু আপনি নিঃস্ব। আপনার পাঠানো টাকা দিয়ে অন্যদের নামে সম্পত্তি কেনা হয়েছে, আপনার নামে কিছু নেই। যে নিঃস্ব অবস্থায় আপনি গিয়েছিলেন আসার পরে সেই একই অবস্থা।
যারা নিজের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বা দেশ থেকে বাড়িতে আপনজনদের কাছে পাঠান, আত্মীয় স্বজনকে পাঠান তাদের জন্য আমার আজকে কয়েকটি সতর্কবার্তা। আপনারা যদি এই প্রসেসগুলো ফলো করেন তাহলে অনেক অনাকাঙ্খিত বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন এবং আপনার অর্থের অপচয় হওয়া রোধ করতে পারবেন।
আমার প্রথম পরামর্শ হচ্ছে, আপনি যে টাকা আয় করছেন তার অন্তত ২০ শতাংশ টাকা আপনি সঞ্চয় করুন নিজের নামে। যদি আপনি ১০০ টাকা আয় করেন তাহলে ২০ টাকা আপনি নিজের নামে সঞ্চয় করুন, বাবার নামে নয়, ভাইয়ের নামে নয়, বউয়ের নামে নয়, ছেলের নামে নয়। এখন বিদেশ থেকে বাংলাদেশের একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করা খুব সহজ। একটা মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র।
সুতরাং, বিদেশ যাবার আগে আপনি এসব বন্দোবস্ত করে যাবেন এবং আগেই বলেছি আপনি যে টাকা আয় করবেন তার অন্তত ২০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশী টাকা নিজের একাউন্টে পাঠাবেন, যে টাকা আপনি ছাড়া আর কেউ উঠাতে পারবেন না। আমি বলতে চাই অন্য কারো কাছে আপনি এই অ্যাকাউন্টের চেক বই রেখে যাবেন না।
খবরদার সই করা কোনো চেকের পাতা যেন না থাকে। আপনি অ্যাকাউন্টের নমিনি হিসেবে মা বাবা বা স্ত্রী সন্তান যে কাউকে আপনার পছন্দ ও বিবেচনামত রাখতে পারেন। আর যদি নমিনি না রাখেন, আপনি যদি অনুপস্থিত হন বা মারা যান তখন নিয়ম অনুযায়ী আপনার যারা উত্তরাধিকার তারা সেই টাকা পাবে।
দুই নম্বর পয়েন্ট হচ্ছে, যারা বিদেশে যাওয়ার সময় নিজের আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে অথবা পাড়া প্রতিবেশী বা কোন প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে গেছেন, তাঁরা সেই ঋণ পরিশোধে যত্নবান হবেন। অনেকেই ঋণ পরিশোধ করার জন্য আত্মীয় স্বজনের কাছে টাকা পাঠান। পাঠানোর পরে যার কাছ থেকে ঋণ করা হয়েছিল, আত্মীয় স্বজনরা তাকে টাকাটা পরিশোধ করে দেন। তবে এখানে আপনার একটু সতর্কতা জরুরি। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, আপনি টাকা পাঠাচ্ছেন ঠিকই আপনার আত্মীয় স্বজনের কাছে কিন্তু যে টাকাটা পায় তাকে সেই টাকাটা পরিশোধ করা হচ্ছে না। এজন্য টাকা পাঠিয়ে আপনি নিশ্চিত হবেন যে টাকাটা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে কিনা। খুব ভালো হয়, যদি ঋণ যার কাছ থেকে করেছেন তার নামে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আপনি টাকা পাঠাতে পারেন অথবা যে প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ করেছেন তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠাতে পারেন।
এখানে হয়তো অনেকে বলবেন যে, আপনি কি আপনার আপন আত্মীয়-স্বজনকে বিশ্বাস করবেন না? আমি বলছি অবশ্যই বিশ্বাস করবেন কিন্তু বিশ্বাস করার পাশাপাশি নিজেও নিজের ট্রানজেকশনের ব্যাপারে যত্নবান হবেন।
তিন নম্বর পরামর্শ হচ্ছে, আপনি বাড়িতে যে টাকাটা পাঠাচ্ছেন, অল্প হোক বা বেশি হোক, সেই টাকাটা যে উদ্দেশ্যে পাঠাচ্ছেন যেন সেই উদ্দেশ্যে ব্যয় হয় সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। আপনার জানা দরকার টাকাটা সঠিক কাজে লাগছে কিনা। আমি আবারও বলছি বিশ্বাস করার চাইতে জিনিসটা নিশ্চিত হওয়া আপনার দরকার। কারণ শুধু বিশ্বাস করে অনেকেই ঠকেছেন। আপনি হয়তো ঠকবেন না। তারপরেও চেক করে নিন। ঠকার কোনো সম্ভাবনাই যেন না থাকে।
আমার চার নাম্বার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি যে টাকা পাঠাচ্ছেন, সেই টাকায় যদি আপনার বাবা, মা, ভাই, বোন বা কোনো অন্য কোনো আত্মীয়-স্বজন কোনো জমি জমা কিছু কেনেন, আপনি নিশ্চিত হবেন যে আপনার নাম সেখানে থাকছে কিনা। এমন হতে পারে যে, আপনার বাবার নামে কেনা হচ্ছে। বাবার নামে কিনলেও আপনার শরীক থাকছে।
হতে পারে, আপনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্যের নামে কেনা হচ্ছে যেটা আপনি জানেন না। সমস্যা হচ্ছে সেখানে আপনি জেনে যদি কিছু করেন সেটা নিয়ে কারোর কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু যখন আপনার জানার বাইরে কোনো কিছু হয়ে যাচ্ছে তখনই সমস্যা। এই জন্য যখন কোনো সম্পদ আপনি কিনছেন, আপনার জানার বাইরে কেনা হচ্ছে কিনা সেটা আপনার নিশ্চিত হতে হবে। নচেৎ, আপনি সেই সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন, অনেকেই হয়েছেন।
পাঁচ নাম্বার পরামর্শ হচ্ছে, আপনার পাঠানো টাকা অপচয় হচ্ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। হয়তো আপনি টাকা পাঠাচ্ছেন, আপনার স্ত্রীর কাছে সংসার চালানোর জন্যে আপনার বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য। কিন্তু আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, সেটা সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে কিনা। হয়তো, আপনি আপনার ভাইয়ের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন আপনার সংসার চালানোর জন্যে কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, আপনার ভাই টাকাটা অপচয় করছে, টাকা দিয়ে নেশা করছে বা এমন কিছু করছে যা আপনি চান না।
সুতরাং টাকার প্রশ্ন আসলেই বিশ্বাসের পাশাপাশি আপনি হিসাব রাখার ব্যবস্থা করবেন এবং তদারকি যতদূর করা যায় করবেন। আপনি খেয়াল করবেন যে, আপনার কষ্টার্জিত টাকা যেন কোনোভাবে অপচয় করা না হয়। যদি অপচয় হয় এবং আপনি জানতে পারেন তাহলে পরিবারের সদস্যদেরকে সতর্ক করবেন। অথবা পরবর্তীতে শুধু যে প্রয়োজনীয় টাকাটা বাদে বাকি টাকা আপনি পাঠানো বন্ধ করে দেবেন, যতক্ষণ না তারা অপচয় করা বন্ধ করে।
ছয় নম্বর পরামর্শ হচ্ছে, আপনার খুব সতর্ক থাকতে হবে যখন দেশে ফিরবেন। তখন যেন এসে না দেখেন যে আপনি পুরো নিঃস্ব, আপনার কিছুই নাই। এরকম অনেক অভিযোগ আছে। পাঁচ বছর, দশ বছর বাইরে কাজ করেছেন এক টাকাও নিজে সঞ্চয় করেননি। সমস্ত টাকা দেশে পাঠিয়েছেন কিন্তু দেশে ফিরে আসার পরে দেখেন যে আপনার টাকাও নাই, স্ত্রীও নাই। আবার ভাই, বাবা, মা সবাই আছে কিন্তু আপনি নিঃস্ব। আপনার পাঠানো টাকা দিয়ে অন্যদের নামে সম্পত্তি কেনা হয়েছে, আপনার নামে কিছু নেই। যে নিঃস্ব অবস্থায় আপনি গিয়েছিলেন আসার পরে সেই একই অবস্থা।
মূলত, যে ছয়টা পরামর্শের কথা আমি বললাম, এই ছয়টা পরামর্শ যদি আপনি মেনে চলেন তাহলে দেখবেন যে, আপনি আপন আত্মীয়স্বজন, আপনজনদের কাছ থেকে প্রতারিত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন।
আপনারা হয়তো অনেকেই এই বিষয়টি অপছন্দ করবেন। আমি আবার বলছি আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে আমি উৎসাহিত করছি যেন লেনদেনটা স্বচ্ছ হয়, সুন্দর হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। বিশ্বাসের চাইতে হিসাব নিকাশে লিখিত ব্যাপারটা খুব জরুরি। কেউ যেন প্রতারিত না হয়। কারণ আমাদের সমাজে অনেক মানুষকে দেখা যাচ্ছে, আপন মানুষের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে। প্রত্যেকে যদি সতর্ক থাকেন তাহলে এই প্রতারণার হাত থেকে আমরা সবাই বাঁচতে পারবো। পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধনটাও শুধু টাকার কারণে নষ্ট হবে না।
আমার বিশ্বাস যারা বিদেশে কষ্ট করে টাকা আয় করছেন তারা যদি এই প্রসেসগুলো অনুসরণ করেন তাহলে আপনাদের কষ্টার্জিত টাকা সুরক্ষিত থাকবে। সবার সাথে সম্পর্কটাও অটুট থাকবে। অব্যবস্থাপনা অনেক সময় সবকিছু এলোমেলো করে দেয়।
লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।
এইচআর/এএসএম