বাংলাদেশের ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় একটি অনন্য স্থান দখল করে আছে। এটি এমন এক সম্প্রদায় সমাজে যাদের অবস্থান প্রায়শই প্রান্তিক পর্যায়ে এবং যারা সমাজের অন্যান্য মানুষের দ্বারা ভুল বোঝাবুঝি এবং প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নিয়ম এবং প্রত্যাশার মুখে নানারকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। বাংলাদেশের ট্রান্সজেন্ডার জনসংখ্যা আত্মপরিচয়, গ্রহণযোগ্যতা এবং অন্তর্ভুক্তির জন্য চলমান সংগ্রামের একটি আখ্যান উন্মোচন করে।
অনেক সমাজের মতো বাংলাদেশেও ঐতিহ্যগতভাবে বাইনারি লিঙ্গ নিয়ম-পুরুষ এবং মহিলা মেনে চলে। লৈঙ্গিক এই পরিচয়ের বাইরে যাদের অবস্থান স্থানীয়ভাবে তারা “হিজড়া” নামে পরিচিত। হিজড়ারা বিভিন্ন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে যারা প্রচলিত পুরুষ-মহিলা বিভাজনের বাইরে শনাক্ত হয়। তাদের পরিচয়ের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার নারী, নপুংসক, আন্তঃলিঙ্গ ব্যক্তি, উভলিঙ্গ, তৃতীয় লিঙ্গ এবং যারা ঐতিহ্যগত লিঙ্গ নিয়ম মেনে চলে না তারা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে, হিজড়ারা দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে বহু শতাব্দী ধরে বিদ্যমান, একটি জটিল ইতিহাস যা আধ্যাত্মিকতা, পৌরাণিক কাহিনী এবং সামাজিক গৌণ ভূমিকার সাথে জড়িত। ঐতিহ্যগতভাবে, হিজড়ারা এই অঞ্চলে বিবাহ এবং সন্তান জন্মদানের পর তাদের অনন্য আশীর্বাদের জন্য স্বীকৃত, যদিও তাদের সামাজিক অবস্থান বৈষম্য এবং প্রান্তিকতায় পরিপূর্ণ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) 'জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২'- এর হিসেবে দেশে ১২ হাজার ৬২৯ জন তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি রয়েছে। তবে, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসেবে সারা দেশে তাদের সংখ্যা লাখের উপর হতে পারে। হিজড়ারা ঢাকাসহ দেশের বড় বড় বিভাগীয় শহরগুলোতে অবস্থান করে। তবে, ঢাকাতেই এদের সংখ্যা বেশি।
হিজড়া সম্প্রদায়ের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকার ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে হিজড়া সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র পরিচয় স্বীকার করে ’তৃতীয় লিঙ্গ’ বা ট্রান্সজেন্ডার হিসাবে জাতীয় পরিচয়পত্রে একটি পৃথক লিঙ্গ বিভাগ চালু করে। এই স্বীকৃতি হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তারা ভোট দানের স্বীকৃতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণের স্বীকৃতিও পায়।
যাই হোক, শুধু আইনি স্বীকৃতিই ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের প্রায়ই সম্মুখীন হওয়া গভীর-মূল সামাজিক কলঙ্ক এবং বৈষম্যকে মুছে দেয় না। কর্মসংস্থান বৈষম্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাতে সীমিত প্রবেশাধিকার, এবং সামাজিক বঞ্চিতকরণ এখনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং প্রায়শই তারা পারস্পরিক সমর্থনের জন্য ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায় গঠন করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার অবিরাম সংগ্রামে লিপ্ত।
বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর ব্যাপক চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি হল স্থায়ী সামাজিক কলঙ্ক এবং বৈষম্য। লিঙ্গ সম্পর্কে গভীরভাবে অন্তর্নিহিত সামাজিক নিয়মগুলি প্রায়শই ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের বঞ্চনার দিকে পরিচালিত করে , যা তাদের পক্ষে পরিবার, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে পাওয়া কঠিন করে তোলে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও মৃত্যুর পর সৎকার থেকেও এই জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বঞ্চিত হয়।
বৈষম্য জীবনের প্রথম দিকেই শুরু হয়। অনেক ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি তাদের নিজের পরিবারের মধ্যে প্রত্যাখ্যান এবং উপহাসের সম্মুখীন হয়। এই প্রাথমিক প্রত্যাখ্যান ট্রান্সজেন্ডার শিশু ও যুবাদের মধ্যে গৃহহীনতার উচ্চ হারের দিকে নিয়ে যায়, যা তাদেরকে সম্প্রদায়ের বিকল্প ফর্ম এবং সমর্থন খুঁজতে বাধ্য করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ট্রান্সজেন্ডার ছাত্ররা বর্জনের সম্মুখীন হয়, যা তাদের শিক্ষাগ্রহণের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এক হিসেব অনুযায়ী দেশে মোট ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মাত্র দুই শতাংশ শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। বিভিন্ন লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে বোধগম্যতা এবং সচেতনতার অভাব প্রান্তিকতার একটি চক্রকে স্থায়ী করে যা বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা তাদের টিকে থাকার চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও জটিল করে তোলে। কর্মসংস্থানের সুযোগগুলি প্রায়ই সীমিত হয়। অনেক ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের সম্মুখীন হয়। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা নিজেদেরকে অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে নিয়োজিত করে বা জীবিকা নির্বাহের জন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে আশীর্বাদ এবং গান গাওয়ার মতো ঐতিহ্যবাহী ভূমিকায় জড়িত হয়। তাদের অনেকে আবার অদ্ভূত সাজে সজ্জিত হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজি ও অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।
কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষার অনুপস্থিতি ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে প্রবেশে অক্ষমতা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের মধ্যে দারিদ্র্যের উচ্চ হারে অবদান রাখে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একটি চক্র তৈরি করে যা থেকে বেরিয়ে আসা তাদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের অনেকক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য যৌন আচরণের শিকার হতে হয়। সুস্পষ্ট নিয়ম কানুন না থাকায় এই ধরনের যৌন আচরণের প্রতিকার প্রাপ্তি তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়।
বাংলাদেশের ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মধ্যে বৈষম্য এবং বোঝাপড়ার অভাব প্রায়ই হিজড়া ব্যক্তিদের চিকিৎসা সেবা গ্রহণে বাধা দেয়। ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় হরমোন থেরাপি এবং লিঙ্গ নিশ্চিতকরণ সার্জারিসহ লিঙ্গ-নিশ্চিত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
সামাজিক প্রত্যাখ্যান, বৈষম্য এবং আত্ম-স্বীকৃতির জন্য সংগ্রামের কারণে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মধ্যেও মানসিক স্বাস্থ্যের ভঙ্গুরতা বিরাজ করে। সাংস্কৃতিকভাবে সক্ষম এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব এই চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও জটিল করে তোলে। নিরাপত্তার খোঁজে তারা দলবদ্ধ হয় এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের জন্য আইনি সুরক্ষা এবং নীতি প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শনাক্তকরণ নথিতে তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার বিভাগের সরকারের স্বীকৃতি একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তর হিজড়া তথা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের অধিকারের পক্ষে কথা বলার ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা এবং কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেসরকারি সংগঠনগুলো সচেতনতা তৈরি, সহায়তা পরিষেবা প্রদান এবং ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার জন্য নীতি পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করে।
চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় বাংলাদেশে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্ব রাখে। ঐতিহ্যগতভাবে, বিবাহ এবং সন্তান জন্মের পর আশীর্বাদ প্রদানের জন্য হিজড়াদের ডাকা হয়। সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের মধ্যে নিহিত এই আচার-অনুষ্ঠানগুলো সমাজে হিজড়াদের অনন্য ভূমিকা তুলে ধরে ।
যাই হোক, সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সবসময় সামাজিক স্বীকৃতিকে প্রতিফলিত করে না। যদিও নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠানের সময় অন্তর্ভুক্তির মুহূর্ত থাকতে পারে, বৃহত্তর সামাজিক পরিবেশ দৈনন্দিন জীবনে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের আলিঙ্গন করতে প্রতিবন্ধক হিসাবেই কাজ করে।
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের জন্য তাদের পরিবারের মধ্যে সমর্থন খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জিং হয়। যদিও সামাজিক নিয়মগুলি পারিবারিক প্রত্যাখ্যানে ভূমিকা রাখে, তাসত্ত্বেও কিছু পরিবার নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করে। পরিবারের প্রগতিশীলতা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং তাদের সামগ্রিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
সম্প্রদায়ের সমর্থনও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের গঠন নিজেদের এবং সংহতির অনুভূতি প্রদান করে। এই সম্প্রদায়গুলি এমন জায়গায় পরিণত হয় যেখানে ব্যক্তিরা অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারে, সমর্থন দিতে পারে এবং সম্মিলিতভাবে সাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। তারা সহনশীলতার উৎস হিসাবে কাজ করে, ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের এমন একটি সমাজে বিচরণ করার ক্ষমতা দেয় যেটি প্রায়শই তাদের বুঝতে বা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।
যদিও জাতীয় পরিচয় পত্রে তৃতীয় লিঙ্গের তথা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির আইনি স্বীকৃতি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি তবুও লিঙ্গ স্বীকৃতির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলি অব্যাহত রয়েছে। অফিসিয়াল নথিতে লিঙ্গ চিহ্নিতকারী পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি জটিল এবং আমলাতান্ত্রিক হতে পারে, যা অনেক ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে এটি অনুসরণ করা থেকে বিরত রাখে। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা যাতে অপ্রয়োজনীয় বাধা ছাড়াই তাদের অধিকারগুলি ভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য এই প্রক্রিয়াটিকে সহজীকরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যার মধ্যে রয়েছে সামাজিক মনোভাব পরিবর্তন করা এবং সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করা। শিক্ষা এবং সচেতনতামূলক প্রচারণা ভ্রান্ত ধারণাগুলি দূর করতে এবং বিভিন্ন লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে বোঝার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে স্কুল পাঠ্যক্রমে লিঙ্গ এবং যৌন বৈচিত্র্য সম্পর্কে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা।
সাংস্কৃতিক সংবেদনশীল কর্মসূচি ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় সম্পর্কে মিথ এবং ভুল ধারণা দূর করার জন্য কাজ করতে পারে। হিজড়াদের সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য তুলে ধরে, এই উদ্যোগগুলি ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পুনর্নির্মাণের দাবি রাখে।
ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টাকে অবশ্যই আইনি কাঠামোর মধ্যে প্রসারিত করতে হবে। লিঙ্গ পরিচয় এবং অভিব্যক্তির উপর ভিত্তি করে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুস্পষ্টভাবে লড়াই করে এমন আইনের পক্ষে প্রচার অপরিহার্য। এই আইনগুলির মাধ্যমে তাদের চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং আবাসনের মতো ক্ষেত্রগুলিকে আওতায় আনা উচিত, যা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি ভিত্তি প্রদান করে।
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতে সংস্কার অপরিহার্য। সাংস্কৃতিকভাবে দক্ষ এবং ট্রান্সজেন্ডার-সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া অপরিহার্য। উপরন্তু, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যকে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করে এমন নীতিগুলির অনুশীলন অব্যাহত রাখা যেখানে সমস্ত ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি বৈষম্যের ভয় ছাড়াই মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের একসাথে দলবদ্ধ না হয়ে পরিবারের কাছে পাঠানো উচিত। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের নাম ও ঠিকানা সম্বলিত একটি ডাটাবেজ তৈরির চেষ্টা করতে হবে। সবাই নিজ নিজ পরিবারে থাকবে। তাকে যদি শৈশব থেকে পরিবারে রাখা হয়, সাধারণ স্কুল-কলেজে পড়ানো হয়, তাহলে তার সামগ্রিক গেটআপ স্বাভাবিক এবং অন্য দশজনের মতো হবে।
ট্রান্সজেন্ডারদের ঘৃণা না করে সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করা দরকার। আগে কন্যা সন্তানের জন্ম হলে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, এমনকি আধুনিক যুগেও সতীদাহের রীতিতে স্ত্রীকে জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিতে হতো। আমরা এ থেকে সরে আসতে পেরেছি। ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব থেকেও আমরা বেরিয়ে আসতে পারব।
রেডিও, টিভি ও সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে মানুষের মানসিকতা বদলাতে হবে। সরকারি পর্যায় থেকে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে এবং দেশের সচ্ছল মানুষদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। একটি পরিবারে একটি ট্রান্সজেন্ডার সন্তান থাকা লজ্জিত বা নিরুৎসাহিত হওয়ার কিছু নয়।
একটি পরিবারে যদি একটি প্রতিবন্ধী অসুস্থ শিশু থাকতে পারে, তবে কেন একটি ট্রান্সজেন্ডার শিশু থাকতে পারে না? যেসব পরিবারে ট্রান্সজেন্ডার সন্তান রয়েছে, সেখানে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং তাদের আরও বেশি মনোযোগী করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সম্প্রদায়ের যারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে তাদের যদি তাদের পরিবারের কাছে পাঠানো না যায়, তবে অন্তত দলে নতুনদের অন্তর্ভুক্তি রোধ করা যাবে। তারা অবহেলিত নয়; তারা কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো বোন বা রক্তের আত্মীয়। তাদের জীবনকে মূল্যায়ন করা রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়েরই অন্যতম দায়িত্ব।
উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই সামাজিক বৈষম্য ও কলঙ্ক কমে আসবে। এজন্য সবাইকে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। ট্রান্সজেন্ডারদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার যে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তা সফল করতেও আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে।
বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের ধারায় বিকশিত হতে চলেছে, সেখানে ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কিত ধারণা পুনর্নির্মাণ করার এবং একটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করার সুযোগ রয়েছে যা লিঙ্গ পরিচয়ের বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন করে এবং প্রতিটি ব্যক্তির অন্তর্নিহিত মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয়। ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের সহনশীলতা, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া, মানব চেতনার শক্তি এবং গ্রহণযোগ্যতা ও সমতার অটল সাধনার প্রমাণ হিসাবে কাজ করে।
বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে ও সমাজের মূল ধারায় স্বীকৃতিতে ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং নীতিনির্ধারকদের ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টায় পদক্ষেপ নিতে হবে। আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে যাত্রার জন্য বৈষম্যমূলক অভ্যাসগুলি পরিত্যাগ করা, সহানুভূতি এবং বোঝাপড়ার বিকাশ এবং এমন একটি সমাজ গড়ে তোলার পদক্ষেপ প্রয়োজন যেখানে প্রত্যেকে, তাদের লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে, মর্যাদা, সম্মান এবং স্বাধীনতার সাথে বসবাস করতে পারে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/এমএস