অ্যাকশনের রিঅ্যাকশন আছে ভুলে গেছে সরকার!

ড. মাহবুব হাসান
ড. মাহবুব হাসান ড. মাহবুব হাসান , কবি, সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ১২ নভেম্বর ২০২৩

জোসেফ ক্য্যাম্পবেলের বই ‘দ্য হিরো উইথ এ থাউজেন্টস ফেসেস’। এক নেতার/বীরের হাজার মুখ- এরকম বাংলা করলে কি আমরা ধরতে পারবো না ক্যাম্পবেলের হিরোর চেহারা? তার এ হিরো যে গড, সেটা মিথিক পারম্পর থেকে উদ্ধার করা যায়। মিথিলজিক্যাল পরিপ্রেক্ষিতকে আমরা নানা ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি।

আমাদের সাংস্কৃতিক বীক্ষা হচ্ছে আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। এবং অন্যান্য প্রধান ধর্মের ঈশ্বরও একক। কেবল হিন্দুইজমে ঈশ্বর বহু, বহু চেহারার, বহু রূপের। তাদের আবার রয়েছে দেবতার সঙ্গে দেবীও, আদ্যাশক্তির অধিকারী।

‘এ্যান ওপেন লাইফ’ এর বাংলা রূপান্তর করেছেন আমার বন্ধু আমিনূল ইসলাম ভূইয়া। মাইকেল টমসের সঙ্গে আলাপচারিতার সংকলন এই বই। এই বইয়ের সাক্ষাৎকারে ক্যাম্পবেল বলেছেন ‘মিথ হচ্ছে উপমা। মিথলজির চিত্রকল্প আমাদের ভেতরকার আধ্যাতিক শক্তির প্রতীক। তার মানে হচ্ছে মিথ উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক। মিথ আসে জীবন-পদ্ধতি থেকে।

জোসেফ ক্যাম্পবেলকে যদি মিথলজি ব্যাখ্যার গুরু মানি তাহলে তার এই ব্যাখ্যাগুলো আমাদের ভেতরের সত্য ও সম্পদ আবিষ্কার করতে সাহায্য করতে পারবো।

২.
সত্য কী অ্যাবসুলিট কোনো বিষয়? শাদা চোখে সেটাই মনে হয়। কিন্তু সত্য বলে কোনো কাঠামো নেই। কেবল তা উপলব্ধি করা যায়। আমরা চিন্তা করলেই সত্যের নানা প্রতীকী ভাষ্য, রূপক ও রূপকায়িত সত্য কল্পনা করতে পারি। আবার ওই কল্পিত সত্যই চিত্রকল্প।

সেটা কী ভাবে? এইবার রাজনীতি থেকে উদাহরণ দেয়া যাক।

অ্যাকশনের যে রিঅ্যাকশন আছে তা কি ভুলে গেছেন সরকার ও সরকারি দল? জনগণের টাকায় যাদের বেতন-ভাতা হয়, সেই পুলিশকেই সরকার প্রতিবাদী, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মিছিল মিটিং পণ্ড করতে কিংবা হত্যার জন্য গুলি করার আদেশ দেন।

আমাদের মহানগর ঢাকায় বেশ কিছু ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। গীত হচ্ছে যে ঢাকায় আর যানবাহনের জট থাকবে না। আমরা সেটা বিশ্বাস করছি। কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মিত হয়েছে। ইতিহাস নির্মাণকারী টানেল। আমাদের সরকার ও সরকার প্রধান যেমন মহাখুশি তেমনি তার রাজনৈতিক অনুসরণকারীগণও বিশ্বাস করেন যে দেশের উন্নয়ন ঘটেছে যা পঞ্চাশ বছরের মধ্যে প্রথম। এই স্বপ্ন জনগণের মনের ভেতরে গেঁথে দেবার পর, ধান-উৎপাদক কৃষকেরা স্বপ্ন দেখতে থাকেন যে আমরাও স্বপ্নময় জীবনের অংশ হয়ে গেছি। তাই আমরা যে জিডিপির ৮০% জোগান দিই তা সরকার ও রাজনীতিকগণ ভুলে বসে আছেন। কারণ খাদ্য-শস্য উৎপাদন এতোটাই প্রাকৃতিক যে তার পেছনে যে নানানরকম পরিকল্পিত সহযোগ দিতে হয, তা বলতে গেলে বোঝেই না সরকার। আবার বুঝলেও তাদের জন্য কিছু ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম নেবেন, সেটাও তাদের রাজনৈতিক চিন্তায় তেমন বল পায় না। এর কারণ তারা মনে করেন কৃষক ধান পাট উৎপাদন না করে যাবে কোথায়?

কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে সরকারের লেজুড়গণ বলবেন সরকারই তো করছে। অর্থাৎ সরকারই তো ধান উৎপাদন করছে। কৃষক কেবল কামলা হিসেবে কাজ করছে। যেমনটা করে থাকেন সরকারের আমলাগণ। আমলাদের কাজ তো আরো জটিল ও ব্যাপক তার আকার। ফলে তারা সরকারের ডানহাত। এই যেমন আমলা ছাড়া আমরা প্রশাসন কল্পনাই করতে পারি না। আবার তারাই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ামক শক্তি। এই যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হয়েছে, তার প্রধান একজন আমলা। সচিবও আমলা। অতীতেও ওই আমলারাই ঘিরে ছিলেন ইসি। নির্বাচনে, ভোট দেবার দিন তারাই, মানে জেলা প্রশাসক, পুলিশের এসপি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার পুলিশ পরিচালনা করেন সব কিছু। সহযোগ দেয় নানারকম।

অর্থাৎ গোটা ব্যবস্থাই আমলানির্ভর। সেখানে উৎপাদক কামলাদের উপস্থিতির কি প্রয়োজন? আবার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ভোট-রেষারেষির ফলে তাদের নিজস্ব অস্ত্রে জান যায় মানুষের। এদেরকে রাজনীতিকরা তেমন একটা গণ্য করেন না। এদের কথা বলতে বলতে মুখের কষায় ফেনা তুলে ফেলেন তারা কিন্তু তাদের খোঁজ রখেন না ভোট নেবার পর। ভোটের আগে প্রার্থীরা ভোটারের পিছে পিছে ঘুরতেন, আর ভোটের পর নেতার পো ধরার জন্য তাদের পেছনে ছোটেন ভোটারগণ।

ভোটার এবং প্রার্থী রাজনৈতিক পাতি নেতা- কে যে কাহার, তা বোঝার উপায় নেই। এগুলোই হচ্ছে মিথের চিত্রকল্প। কে না জানে, মিথলজি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই বলেন মিথ হচ্ছে মিথ্যা গল্প। হাজার হাজার বছর আগের গল্পই আজকের প্রচলিত ধারায় এসে এমন এক সাংস্কৃতিক বীক্ষায় রূপ নিয়েছে যে, তা আমাদের জীবনচক্রের ভেতর মহলে একধরনের আধ্যাত্মিক চেতনার জন্ম দেয়। শেখ হাসিনা সরকারের এই সব উন্নয়ন মিথগুলো ভবিষ্যতে আমাদের নয়া প্রজন্মের কাছে অনন্যসাধারণ অর্জন হিসেবে চিত্রিত ও গণ্য হবে। অথচ আজকের জনগণের অধিকাংশই জানে এই সত্যের পেছনেও আছে অনেক বড় বড় সত্যের থিমেটিক স্বপ্ন-থাম। তিনি যে বারো হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতু নির্মাণ করেছেন বত্রিশ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে, সেই সত্য ডুবে যাবে।

৪.
আমি আগেও লিখে জানিয়েছি যে কবিরা মিথ রচনাকারী এবং সাহিত্যের অন্য শাখার সৃষ্টিশীলেরাও এই কাজে সিদ্ধহস্ত। সেই কল্পিত কাজই একদিন সত্য হিসেবে বরিত হয়, হবে।এবং স্বপ্নও একশ্রেণির মিথ্যা, যা বাস্তবে নেই। তাকে বাস্তব করে তোলাই রাজনীতিকদের কাজ। সেটা রাজনীতিকরা সম্যক বোঝেন বলে মনে হয় না। না হলে তারা ক্ষমতায় থাকবার জন্য এতোটা রিজিডিটি দেখাতো না। ক্ষমতার মধু কেবল ডেভেলপমেন্টের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসে আছে, এটা ভাবলে হবে না। আরো বহু ক্ষেত্রে মধু জমে আছে। সেই মধু আহরণ করতে হলে তো নিজস্ব ভাবনার জাল বিছাতে হবে। শেখ হাসিনার সরকার সেটাই করে চলেছেন। আর বিএনপি সেই মধুর সন্ধান জানে। মধু সংগ্রহকারী শ্রমিকগণ, কৃষি ও শিল্প সেক্টর থেকে সংগ্রহ করতে থাকেন। একদিন ভোটের নামে নিজেদের দলকে বিজয়ী ঘোষণা করে ক্ষমতার সিংহাসনে বসে সেই মধু শুষে নিতে থাকেন। এখন চলছে সেই নতুন মিথ তৈরির উপাদান উপকরণ নিয়ে তালগোল পাকানো রাজনৈতিক খেলা। পুলিশ নিয়ে সরকার বরাবরই অগ্রগামী। পুলিশি অ্যাকশনে প্রায় ধরাশায়ী বিরোধী দল। তাদের মিটিং মিছিল আর বক্তব্য দাবিকে ধসিয়ে দিয়ে সরকারের ওই পুলিশি অ্যাকশন মিথিক্যাল শেলে পরিণত হচ্ছে।

৫.
আমরা বেরিয়ে আসি রোদে-বৃষ্টিতে ভেজা শ্রমজীবী মানুষের সারা দিনের চিন্তার কিনারে। সেখানে নিস্তরঙ্গ রাজনৈতিক জীবন। তারা কাজ করেন আগে, তারপর অবসর সময় দেশের রাজনীতি নয়, কথা বলেন পেঁয়াজ-রসুন কাচামরিচের দাম নিয়ে। ডিমের দাম যে কেন আকাশ ছোঁয়া, তা তারা জানেন না। কারণ বছরে ডিমের পুষ্টি তারা পান, এমনটা বিশ্বাস করার মতো নয়। ঢাকা মহানগরের নাগরিকগণ একটা ডিম কেনেন ১৫ টাকা দিয়ে। গ্রামের মানুষ, দুধ বিক্রি করে সংসার চালায়। ক্ষেতের আলুটা, মুলাটা, মি|ষ্টি আলু, মিষ্টি লাউ, কদু বিক্রি করে সংসারের গ্রাসে তা ঢেলে দেয়। এর বাইরে তাদের কোনো রোজগার নেই। তাহলে এই চরম দুর্মূল্যের বাজারে তারা টেকে কোন মন্ত্র বলে?

৬.
আশ্চর্ হয়ে ভাবি, ক্ষমতাসীন সরকার কেন আলু, পটল, পেঁয়াজ, রসুন কাঁচামরিচ, চাল-ডাল তেল ওপুষ্টির অপরাপর উপাদানের দাম গণমানুষের কেনান সামর্থ্যের মধ্যে রাখেন না? ওই সব কাচাপণ্যের দাম যে দিন দিনই বেড়ে চলেছে, এ নিয়ে যেন তারা ভাবিতই নয়। ওই সব পণ্য প্রতিবেশি দেশ থেকে কিনে এনে দেশের মানুষকে সেই দামে কেন বিক্রি করছে না? কেন তা তিনগুন বা দ্বিগুণ দামে বিকোচ্ছে? সরকার কাচা তরিতরকারির বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। সেটা বাণিজ্যমন্ত্রী স্বীকারও করেছেন। তার মানে সরকারের কোনো প্রভাবই নেই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত লোকদের ওপর। তাতে করে আমরা এটাই বুঝি যে সরকারের নৈতিক শক্তি শূন্য কোঠায় নেমে এসেছে। কিন্তু ক্ষমতার প্রশ্নে তারা বিএনপির ওপর চড়াও হয়েছে। বিএনপি ঠেকাও বা নিশ্চিহ্ন করার রাজনৈতিক বক্তব্য আর বিএনপির সব নেতাকে আটক করার মধ্য দিয়ে আবারো আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচন সম্পন্ন করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। আর এটা অপ্রকাশ্য নয়। তারা জোর গলায়ই বলছেন বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। আবার সেই সন্ত্রাসী দলটির নির্বাচনী অধিকার বহাল রেখেই ইসি সিডিউল করতে যাচ্ছেন।

এটা দ্বিচারিতা। আসলে সব কিছু নিয়ে সরকার এতোটাই টালমাটাল যে কি থুয়ে কি করবেন, বুঝতে পারছেন না।

৭.
অ্যাকশনের যে রিঅ্যাকশন আছে তা কি ভুলে গেছেন সরকার ও সরকারি দল? জনগণের টাকায় যাদের বেতন-ভাতা হয়, সেই পুলিশকেই সরকার প্রতিবাদী, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মিছিল মিটিং পন্ড করতে কিংবা হত্যার জন্য গুলি করার আদেশ দেন।
এই নির্মম ট্যাজেডি আর কতোকাল চলবে?
১১/০৩/২৩#

লেখক: কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।