গাজা যুদ্ধ বদলে দেবে বিশ্ব ভূরাজনীতি
গেল ৭৫ বছরে এমন হামলা দেখেনি ইসরায়েল। ৬ অক্টোবরের ঐ নজিরবিহীন হামলায় হতবম্ব বিশ্ববাসী। মোসাদের মতো শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে এই হামলা বিস্মিত করেছে ইসরায়েলকে। হামলার তীব্রতা দেখে নড়ে চড়ে বসে ইসরায়েলের মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা। স্মরণ কালের এমন হামলা করে বিশ্বকে নতুন বার্তা দিতে পেরেছে হামাস। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী এই সংগঠন তরুণদের মাঝে আশা জাগিয়েছে। আত্মবিশ্বাস বেড়েছে ফিলিস্তিনিদের। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও হামাসকে নিয়ে আশাবাদী হয়েছে।
আমেরিকার দীর্ঘ দিনের বন্ধু দেশ সৌদি আরব। এবারের হামলার পর হঠাৎ দেশটি বদলে ফেলেছে তাদের পররাষ্ট্র নীতি। ইরানের সাথে বৈরী সম্পর্ক কমিয়ে ফেলেছে তারা। মতভেদ ভুলে একজোট হয়েছে। এর মধ্যস্থতা করছে চীন ও রাশিয়া। পেছনে থেকে কাজ করছে এরদোয়ান। বিশ্লেষকেরা আগেই বলেছিলেন, এবারের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত বদলে দেবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি। দিন যত গড়াচ্ছে বিশ্লেষকদের সেই পূর্বাভাস ততই সত্য প্রমাণিত হচ্ছে।
চলমান যুদ্ধে বিশ্বের বেশ কয়েকটি পরাশক্তি ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। চীন-রাশিয়া স্বাধীন ফিলিস্তিনের কথা বলেছে। দেশ দুটি যুদ্ধ বিরতির কথা বারবার বলেছে। ৫ পরমাণু শক্তিধর দেশ- রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান ও ভারত বিবৃতি দিয়েছে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সবার আগে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গাজায় খাদ্য সহায়তাও পাঠিয়েছেন। সব মিলিয়ে বেশ কয়েকটি শক্তিধর দেশকে পাশে পেয়েছে ফিলিস্তিন।
হঠাৎ করে সৌদি আরবের অবস্থান বদলের হিসাব মেলাতে পারছে না অনেকে। দীর্ঘ দিনের বন্ধু দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে কেন না বলে দিলো তারা? এমনকি মার্কিন বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি বদলে ফেলার কাজও শুরু করেছে সৌদি। বোঝা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার ক্ষমতা কমাতে চাইছে সৌদি-ইরানসহ আরব বিশ্ব।
ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা ইরনা বলছে, ইরান ও সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের দুই পরাশক্তি। তাদের মাঝে সম্পর্ক জোড়া লাগাতে কাজ করছে চীন। গাজায় হামলার পর প্রথমবারের মতো ফোনালাপ করেছেন দুই দেশের দুই শীর্ষ নেতা। টানা ৪৫ মিনিট কথা বলেন তারা। তারা ইসলামী শক্তির ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। বলেছেন, গাজায় নিষ্ঠুর হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দায় রয়েছে।
হামাসের হামলার পর বদলে গেছে আরো কিছু দৃশ্যপট। সৌদি-ইসরায়েল এর মাঝে আব্রাহাম চুক্তির সব সম্ভাবনা ভেস্তে গেছে। এ ছাড়া হামাসের হামলার পর নিন্দা জানাতে যুক্তরাষ্ট্র সৌদিকে চাপ দিলেও প্রিন্স সালমান তা করেননি। উল্টো হাত মিলিয়েছে ইরানের সাথে।
সম্প্রতি তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান তাঁর কাতার সফরের সময় জোর দিয়ে বলেছেন, এবার হয় ফিলিস্তিনি সংঘাতের অবসান ঘটবে, না হয় যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়বে। ধারণা করা হচ্ছে স্থল অভিযানের ফলাফল হবে ভয়াবহ। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রভাব পড়বে। এ থেকে বাদ পড়বে না যুক্তরাষ্ট্রও।
লেবাননের হিজবুল্লাহ যদি এই সংঘাতে আরো জড়ায় তবে সিরিয়া ও ইরাকের বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ তাতে যোগ দেবে। মধ্যপ্রাচ্যে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে তখন হামলার মাত্রা বাড়বে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে যাবে এই যুদ্ধে। ব্যাপকতা বাড়বে যুদ্ধের। তখন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আরো উত্তপ্ত হবে। পাল্টে যাবে ভূরাজনীতির হিসাব নিকাশ।
বলা যায়, গাজা যুদ্ধ বিশ্বকে দুই ভাগ করে দিয়েছে। কে বন্ধু, আর কে শত্রু তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কথাই সত্য হতে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যু বদলে দিচ্ছে ভূরাজনীতি। বাইডেন যখন ঘোষণা দিয়ে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। তখন বসে নেই রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনও। চীনসহ বিশ্ব নেতাদের ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বোঝাই যাচ্ছে গতি পথ বদলাচ্ছে বিশ্ব ভূরাজনীতি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
এইচআর/এমএস