স্বপ্নের ইডেনে স্বপ্নভঙ্গের রাত
কাছের শহর কলকাতার ইডেন গার্ডেনে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দুটি ম্যাচ। বিশ্বকাপের ফিকশ্চার প্রকাশের পর থেকেই এ দুটি ম্যাচ নিয়ে হাইপ তৈরি হয়। বাংলাদেশ সেমিফাইনালে যেতে পারে, এমন একটা প্রত্যাশা সে হাইপ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
প্রত্যাশাটা একেবারে অমূলক ছিল না। তামিম ইকবালের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা 'টিম বাংলাদেশ' বিশ্বকাপে গিয়েছিল তৃতীয় হিসেবে। দুর্ভাগ্য হলো এখন আমাদের লড়তে হচ্ছে অন্তত অষ্টম হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে কোয়ালিফাই করার জন্য। বলছিলাম হাইপের কথা। অনলাইনে ম্যাচের টিকিট পাওয়াটা সহজ ছিল। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন ছিল ভারতের ভিসা পাওয়া। সে লড়াইটা আরও কঠিন করে দেয় বিমানভাড়া, বাড়তে বাড়তে যা ৫০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছিল। ম্যাচ টিকিট পেয়েও ভিসা বা খরচের জন্য অনেকেই যেতে পারেননি।
ইডেনে প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের সাথে হেরে যাওয়ায় উত্তেজনা কিছুটা কমে আসে। আমাদের টিমের দুজন শেষ মুহূর্তে যাত্রা বাতিল করেছেন। তারপরও হাজার হাজার মানুষ খেলা দেখতে কলকাতায় গেছেন। সংখ্যাটা লাখ ছাড়াতে পারে। ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে টের পাই উত্তেজনাটা।
সবার গন্তব্য যেন কলকাতা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে মাত্র তিনটা আসন ফাঁকা ছিল। তার মধ্যে দুটি শেষ মুহূর্তে আমরা বাতিল করেছি। ফ্লাইটের প্রায় সবাই খেলা দেখতেই যাচ্ছেন। বিমানেই পরিচয় হলো সমির নামে এক তরুণের সাথে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষের ছাত্র। সমিরের গল্প পরে করবো।
আমাদের টিম লিডার ছিলেন নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ ডা. মামুন মোর্শেদ। নিখুঁত প্ল্যানার। আটজনের সবার জন্য মাপমতো জার্সি, খেলার বিভিন্ন সময়ের জন্য প্ল্যাকার্ড, ঘড়ি ধরে ধরে সফরসূচি তৈরি, সবার সব সুবিধা-অসুবিধা দেখা- সব করেছেন এক হাতে। আমাদের টিমের প্রাণ ছিল দুই তরুণ আবরার আর মাশরুর। ক্রিকেটের সব আপডেট, পরিসংখ্যান যাদের ঠোঁটের আগায়, বিশ্লেষণ যাদের ক্ষুরধার।
প্রথম দিন খাবারের খোঁজে গভীর রাতে পৌঁছে গেলাম হোটেল আরসানালে। খাবার সন্ধান টিমে যুক্ত হলেন ডা. আল-আমিন সেতু, ডা. মতি ও পঙ্কজও। সেখানে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকদের একটা দলের সাথে দেখা হলো। দেখা হলো বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা আতহার আলী খানের সাথেও। গভীর রাত পর্যন্ত কলকাতাকে জাগিয়ে রাখলো বাংলাদেশ।
পরদিন মানে ৩১ অক্টোবর সকাল থেকেই সাজ সাজ রব, মাঠে যাওয়ার প্রস্তুতি। পিঙ্ক টেস্টের সময়ও আমি ইডেনে ছিলাম। তবে আমাদের টিমের বাকিদের জন্য ইডেন গার্ডেন নতুন। ক্রিকেটপাগল মামুন মোর্শেদ ডা. রুহি যাকারিয়াকে নিয়ে হানিমুনে এসে ইডেনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলেন। ২৫ বছর পর আবার এসেছেন। এবার ইডেনের ভেতরে ছবি তুলবেন। দারুণ উত্তেজনা।
২৫ বছরে অনেক কিছু বদলেছে, এমনকি বদলে গেছে ইডেনও। কিন্তু বদলায়নি মামুন-রুহি দম্পতি। এখনও প্রাণবন্ত, চাঞ্চল্যে ভরপুর; বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচেই তারা পূর্তি করতে চাইলেন হানিমুনের রজতজয়ন্তি। মামুন-রুহি দম্পতি যেভাবে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ালেন, কে বলবেন, তাদের মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় হয়ে গেছে।
খেলার সকালে আমরা একটু ভাগ হয়ে গেলাম। আমাদের টিমের সিনিয়র মোস্ট ও আমার রুমমেট ডা. উত্তম বড়ুয়ার সাথে আমার আগের কলকাতা সফরের গল্প বলছিলেন। শুনে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ), বেকার হোস্টেল যেতে চাইলেন। তাই আমরা একটু বেরিয়ে গেলাম। বেরিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম, এটা কলকাতা না ঢাকা। পথে পথে বাংলাদেশের জার্সি পরা মানুষের ঢল। ক্ষণে ক্ষণে জয়বাংলা স্লোগান।
ইসলামিয়া কলেজ, বেকার হোস্টেল, থিয়েটার রোডে (বর্তমানে শেক্সপিয়ার সরণি) একাত্তরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের অফিস ঘুরে আমি আর উত্তমদা ইডেনে যেতে যেতে বাংলাদেশের দুই উইকেট নেই। ইডেনে গিয়ে দেখা হলো আরও অনেকের সাথে। পীযুষদা ও বৌদি যুক্ত হলেন আমাদের টিমে। দর্শক দেখে বোঝা মুশকিল এটা ইডেন না মিরপুর। আগের ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের সাথে বাংলাদেশ জিতলে অবস্থাটা কী হতো ভাবুন একবার।
কিন্তু দর্শকদের সব উত্তেজনা, ভালোবাসায় জল ঢেলে দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। সাকিব কী বুঝে টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন জানি না। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সাফল্যের সাথে ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখলেন। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা রান করলেই চিৎকারে কেঁপে ওঠে ইডেন, চার/ছক্কায় তো সাইক্লোন বয়ে যায়। মামুন মোর্শেদ যেভাবে চিৎকার করছিলেন, আমি তার গলা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ি। ভাগ্যিস বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা বেশি চার/ছক্কা মারেনি, নইলে দেশে ফিরে মামুন মোর্শেদকে নাক, কান গলার ডাক্তারের কাছে যেতে হতো।
এবারের বিশ্বকাপে যেখানে ৩০০ রানই নিরাপদ নয়, ৪০০+ রান করেও হারতে হয়, সেখানে ২০৪ রান করে পাকিস্তানকে আটকে রাখার আশা করা বোকামি। তবুও আশায় বসতি। আমি মনে মনে ৫ ওভার দেখার টার্গেট ঠিক করি। বাংলাদেশের পেসাররা যদি আউটস্ট্যান্ডিং কিছু করে, তাহলে দুর্বল পাকিস্তানকে ধরাশায়ী করা যেতেও পারে। হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। বরং পাকিস্তান ফর্মে ফেরার জন্য বেছে নিলো বাংলাদেশকেই। মাত্র ৩২.৩ ওভারে জিতে রানরেটটাও বাড়িয়ে রাখে তারা।
পাকিস্তানের ইনিংস যত এগোচ্ছিল, বাংলাদেশের দর্শকরা ততই মাঠ ছাড়ছিল। আর মাঠে বাড়ছিল পাকিস্তানের সমর্থক। ৫ ওভার পরেই আমার খেলা দেখা শেষ। আমাদের দলের প্রাণ শিল্পী ভাবির মেয়ে আগেই হোটেলে ফিরে গেছে। মামুন মোর্শেদকে টেনে বের করতে ১৭ ওভার লাগলো। মন সবারই খারাপ হয়েছে, তবে আবরার আর মাশরুরের মন খারাপ দেখে কষ্টই লাগলো। স্বপ্নের ইডেনে অপমৃত্যু হলো বাংলাদেশের কোটি মানুষর স্বপ্ন। আলো ঝলমলে ইডেনও বড্ড ম্লান লাগছিল।
একজন দর্শক কত কষ্ট করে মাঠে যান, কতটা আবেগ-ভালোবাসা নিয়ে তারা মাঠে যান; আমাদের ক্রিকেটাররা কি তা বোঝেন না। পেশাদার ক্রিকেটাররা হারের গ্লানি ভুলে যান সহজেই। কিন্তু অনেক দর্শক সেটা ভুলতে পারেন না।
অনেকদিন ধরেই এবার বাংলাদেশের সেমিফাইনালের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনাটা একদম অমূলক নয়। তিন নাম্বার হয়ে বিশ্বকাপে যাওয়া দল চারজনের মধ্যে থাকতে চাইতে পারে। সপ্তম বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া দলটির কাছে প্রত্যাশা আরও বেশি হতে পারতো। কিন্তু বিশ্বকাপের আগে আগে যেভাবে অধিনায়ক বদলানো হলো, ফাঁদে ফেলে তামিমকে বাদ দেওয়া হলো, ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো; তাতে আমি মনে মনে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারিনি।
ক্রিকেট যতটা না শারীরিক সক্ষমতার খেলা, তারচেয়ে অনেক বেশি দরকার মানসিক দৃঢ়তা। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ দলটিকে দেখলে মনে হয় মাঝিবিহীন নৌকা, কোনো লক্ষ্য নেই। যার প্রভাব পড়লো ফর্মে। গোটা টিম একসাথে ফর্ম হারিয়ে ফেললো। আগের বিশ্বকাপে সাকিব অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করেছিলেন। এবার তিনি নেতৃত্বে। কিন্তু সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরের কথা ব্যাটিং-বোলিং যেন ভুলেই গেলেন।
বিশ্বকাপে ফ্লাই করার আগে সাকিব দেশের একটি টিভির সাথে যে সাক্ষাৎকার দিয়ে গেছেন, তা কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বকাপের মাঝে দল ফেলে অধিনায়কের দেশে ঘুরে যাওয়া ক্রিকেট ইতিহাসেই নজিরবিহীন। বাংলাদেশের সেরা ১৫ জনই ভারতে গেছেন, সেরা ১১ জনই মাঠে নামেন। তারা হয়তো চেষ্টাও করেন। খেলায় হারজিত থাকেই। আমরাও বলি জিতলেও আছি, হারলেও আছি। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যা করেছে, তাতে আমাদের মন ভেঙে যায়। টানা ৬টি একতরফা পরাজয়। এখন তো প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়কে এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় আপসেট মনে করা হচ্ছে।
একজন দর্শক কত কষ্ট করে মাঠে যান, কতটা আবেগ-ভালোবাসা নিয়ে তারা মাঠে যান; আমাদের ক্রিকেটাররা কি তা বোঝেন না। পেশাদার ক্রিকেটাররা হারের গ্লানি ভুলে যান সহজেই। কিন্তু অনেক দর্শক সেটা ভুলতে পারেন না। শুরুতে বলছিলাম ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্র সমীরের কথা। এই ছেলেটি প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছে, তাও একা একা। জীবনে প্রথম স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখতে যাওয়ার উত্তেজনা তার চোখে মুখে।
উত্তেজনার চোটে কোনো হোটেলও বুক করেননি। রাতে এয়ারপোর্ট থেকে নিউমার্কেট পৌঁছে হোটেল ঠিক করার আশা তার। সমীর হোটেল পেয়েছিলেন কি না জানি না। কিন্তু তার অ্যাডভেঞ্চার দেখে আমারই বয়স কমে গিয়েছিল। খেলার দিন আর দেখা হয়নি। কিন্তু জীবনে প্রথম মাঠে বসে বাংলাদেশের এমন পরাজয় দেখাটা সমীরকে কতটা কষ্ট দিয়েছে, ভাবতেই খারাপ লাগছিল।
আহারে বেচারা কত কষ্ট করে এসেছে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে ইডেনেই। তবে এখনও দুটি ম্যাচ বাকি। আজ মাঠে নামবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, ১১ নভেম্বর শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। এ দুটি ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে তবু মুখরক্ষা হয়। কাজটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত আশায় বসতি।
লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম