সম্প্রীতির আবহে বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে পালিত দুর্গাপূজা
নির্বাচনের আগের বছর। এরই মধ্যে সমাবেশ ও কর্মসূচি ঘোষণা করে যাচ্ছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে রয়েছে জামায়াত। সেই সঙ্গে মানুষের মনে আছে ২০১৩-১৫ সালে জ্বালাও পোড়াও স্মৃতি। এমনই এক সময় দুর্গাপূজা। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে দেশজুড়ে আয়োজিত শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজনকে এভাবেই দেখেছেন দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু নেতাদের পাশাপাশি হামলার শঙ্কা জানিয়েছিল বিদেশি অনেক গণমাধ্যম। কিন্তু তাদের সবাইকে ভুল প্রমাণ করে শেষ পর্যন্ত আরও একবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রমাণ করে দেখালো ১৭ কোটি জনগণ।
প্রতিবারের মতো এবারের দুর্গাপূজার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বেঁধে দিয়েছেন উৎসবের সুর। তার মতে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। সেটাই ধরা পড়ল এবারের দুর্গাপূজায়। গোটা বাংলাদেশ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উৎসবে মেতে উঠলেন। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর নেই। অথচ অশান্তি বাধানোর ষড়যন্ত্র কম হয়নি। সামনেই সাধারণ নির্বাচন। তাই সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঘিরে অশান্তির আগুন লাগানোর লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু সবার সব ষড়যন্ত্রের মুখ ভোঁতা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশবাসীকে উপহার দিলেন নির্বিঘ্নে দুর্গাপূজা। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর নেই।
বাংলাদেশে প্রতি বছরই দুর্গাপূজার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এবারে সরকারি হিসাবে মোট ৩২ হাজার ৪০৮ মণ্ডপে আয়োজিত হয়েছে দুর্গাপূজা। গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ৩২ হাজার ১৬৮টি। অর্থাৎ ৩৪০টি পূজা এবার বেশি হয়েছে বাংলাদেশে। পূজা বেড়েছে ঢাকা মহানগরীতেও। গতবারের ২৪২টি থেকে বেড়ে এবার হয়েছে ২৪৫টি দুর্গাপূজা। কোভিড পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে গোটা বাংলাদেশই এবার মেতে উঠেছিল শারদ উৎসবে। আনন্দের এই উৎসবে হিন্দু বা মুসলিমের বিভেদ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। বহু জায়গায়ই হিন্দুদের এই উৎসবে মুসলিমদেরও সক্রিয় সহযোগিতা করতে দেখা গেছে।
সিলেটের এক মন্দিরে ঢুকে দেখি দাঁড়ি ও টুপি পরে একজন ব্যক্তি মন্দির সাজানোতে ব্যস্ত। তার কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, প্রতি বছরই মন্দির সাজিয়ে দেন তিনি। মন্দিরের জন্য প্যান্ডেল, ছাউনি, ছোট ছোট মরিচা বাতি, কাপড়ের ফুল দিয়ে সাজানো, এসব কাজই তিনি করেন। সেই সঙ্গে মন্দিরের ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য লাইন করে দেওয়াসহ আরও বেশ কিছু কাজ নিয়মিত করেন তারা।
দিনাজপুরে দেখা মিললো আরেক বিরল ঘটনার। একই জমিতে মুখোমুখি মসজিদ ও মন্দির। মন্দিরে চলছে সারাদিন দুর্গাপূজার আমেজ। মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। আবার আজান ও নামাজের সময় মুসলিমদের জন্য বন্ধ রাখা হচ্ছে পূজার সাউন্ড সিস্টেম। এ যেন পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধের অমূল্য এক উদাহরণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, শুধু তার সরকারের আমলেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ। আওয়ামী লীগ যতদিন ক্ষমতায় থাকবে দেশের সংখ্যালঘুরাও নিরাপদে থাকবে। এবার দুর্গাপূজায় তার কথায় ও কাজে অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সংখ্যালঘুরা প্রাণ খুলে মেতে ওঠেন তাদের প্রাণের উৎসবে। নিরাপত্তার চাদরে মোড়া ছিল গোটা দেশের পূজা মণ্ডপগুলো। ফলে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর নেই। অশান্তির না থাকায় রাতভর মানুষ মেতে উঠেছিলেন উৎসবের আনন্দে। ঢাকা মহানগরীর পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, যশোর, খুলনা, নোয়াখালী ওপাবনার মানুষ মেতে ওঠেন শরতের এই উৎসবে।
ঢাকায় মূল আকর্ষণ ছিল ঢাকেশ্বরী মন্দির। জাতীয় মন্দিরটিতে দুর্গাপূজা উপলক্ষে এবারও আয়োজন করা হয়েছিল মেলার। সেই মেলা হয়ে উঠেছিল হিন্দু-মুসলিমদের মিলনমেলায়। ভিড় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। ঢাকেশ্বরী মন্দির ছাড়াও ঢাকার জগন্নাথ হলের প্রতিমা, বরিশালের পিরোজপুর সর্বজনীন, সাভারের কাউন্দিয়া সর্বজনীন, ঢাকার খামারবাড়ি সর্বজনীন পূজা আলাদা আকর্ষণ ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকের বিশ্বাস রাজশাহীর তাহেরপুরে প্রথম শুরু হয় এ শরতের দুর্গাপূজা। তাই সেখানকার পূজা ভক্তরা ভিড় করেছিলেন একটু বেশিই।
নির্বিঘ্নে দুর্গাপূজা সম্পন্ন করতে প্রস্তুতির কোনো কমতি রাখেনি সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আগেই সবইকে সতর্ক করে বলেছিলেন, কেউ দুর্গোৎসবে সাইবার গুজব ছড়ালে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী নজরদারি চালাচ্ছে। তিনি জানান, বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ইউনিট অত্যন্ত সক্রিয়। কেউ গুজব ছড়ালেই দ্রুততার সঙ্গে শনাক্ত করা হবে। বাস্তবেও নিরাপত্তা বাহিনী যথেষ্ট তৎপর ছিল। ফলে কেউ কোনো গুজব রটিয়ে অশান্তি বাধাতে পারেনি। বিক্ষিপ্ত দু-একটি ঘটনা ঘটলেও পুলিশের সার্বিক ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
দুর্গাপূজার আগেই পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছিলেন, ‘দুর্গাপূজা কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো আশঙ্কা অনুভব করছি না। তবুও সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে সারাদেশে নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’ বাস্তবেও গোটা দেশে ছিল পুলিশে পুলিশে সয়লাব। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, 'দুষ্কৃতকারীরা কোনো সুযোগ নিতে না পারে সেই জন্য দুর্গাপূজার সময়টাতে আমরা খুবই সতর্ক ছিলাম। ধর্মীয় অনুভূতি পুঁজি করে রাজনৈতিক, সামাজিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা হয়। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে।’
সার্বিক বন্দোবস্তে খুশি বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার। তিনি জানান, সংখ্যালঘুরা নির্বিঘ্নেই মেতে উঠতে পেরেছিলেন শারদ উৎসবে। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। সংখ্যালঘুরা খুশি। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতারা সংখ্যালঘুদের এই উৎসবে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন।
জাতীয় সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের মতে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যই বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি আজও বেঁচে রয়েছে। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। আগামী দিনে সেই চেতনাকেই ধরে রাখতে নৌকার ওপর ভরসা রাখার ডাক দেন তিনি।
কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। জামায়াতে ইসলাম ও বিএনপি তাদের অফিসিয়াল পেজ থেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য শঙ্কা জানিয়ে পোস্ট করেন, যাকে সাধুবাদ না জানিয়ে ‘কুমিরের কান্না’ হিসেবে অভিহিত করেছেন অনেকেই। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের ভাষ্যমতে, এটা রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি ছাড়া আর কিছু না। আর এর ভিকটিম আমরা। তিনি বলেন, তারা যদি অতীতে তাদের সময়ে হওয়া হামলাগুলোর জন্য আগে ক্ষমতা চাইতো, তাহলে আমরা মেনে নিতাম অবশেষে তাদের বোধোদয় হয়েছে। ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা করতে চাচ্ছে তারা। কিন্তু নিজেদের অপকর্ম নিয়ে কোন দুঃখ প্রকাশ না করে বর্তমান সরকারের সময়ে সংখ্যালঘুদের অত্যাচার নিয়ে মানবাধিকারের কথা বলে স্রেফ রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি ছাড়া আর কিছু নয়।
রানা দাশগুপ্তের মতই অসংখ্য সংখ্যালঘু নেতা মনে করেন, আওয়ামী লীগের সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর যেই অত্যাচার হয়েছে তা রাষ্ট্রের স্পন্সরশিপে হয়নি। বরং এখন সংখ্যালঘুরা চাইলেই মামলার করতে পারছেন এবং বিচারও হচ্ছে। কিন্তু এক সময় তো সংখ্যালঘুরা তাদের ওপর হওয়া অত্যাচারের মামলা করতেই ভয় পেতো।
পূজায় সিলেটের এক মন্দির কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারির সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। তারা বললেন কিভাবে জামায়াত-বিএনপির সময় তাদের মন্দিরের অধিকাংশ জমি বেদখল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে আশার বাণী হিসেবে জানালেন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত বেদখল হয়ে যাওয়া জমির প্রায় ৮৫ শতাংশ পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন তারা। বাকিটাও পারবেন। হাইকোর্টে মামলা চলছে।
এটাই হলো শেখ হাসিনার সম্প্রীতির বাংলাদেশ। এটাই হলো আইনের শাসন। যেখানে দুর্বল আইনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হবেন না, বরং ন্যায় বিচার লাভ করবেন। যেখানে অন্য ধর্মের উৎসবে হামলা করবে না, বরং সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে।
বাংলাদেশের বুকে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে যার যার ইচ্ছে অনুসারে ধর্ম পালনের। আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বার দায়িত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যতদিন তার হাতে আছে দেশ, আমরা নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পারি। কেননা ধর্ম নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতি করেন না। এদেশের মানুষও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি পছন্দ করে না। আর এ কারণেই দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ় প্রত্যয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস