ফিলিস্তিন নিরাপদ না হলে ইসরায়েলও অনিরাপদ

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশিত: ০৯:৪১ এএম, ০৫ নভেম্বর ২০২৩

এখনকার যুগে যুদ্ধের কৌশল ও গতি-প্রকৃতি বদলে গেছে। যোদ্ধা ও যুদ্ধাস্ত্র বিষয়টি সম্পর্কেও নবতর ধারণার সংযোজন ঘটেছে। রক্তমাংসের যোদ্ধা বা সৈনিকের পরিবর্তে রোবটচালিত স্বয়ংক্রিয় যোদ্ধার প্রচলন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সফট্ওয়্যার নিয়ন্ত্রিত আধুনিক যন্ত্রসৈনিক মোতায়েন করে অনেকে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে অহমিকা নিয়ে দিনক্ষেপণ করে চলেছেন। তবে এসব কিছুতে নিরাপত্তা ও শান্তি মনে করে ক্ষান্ত দিয়ে অবকাশ দেওয়ার ফুরসত কোথাও নেই। কারণ প্রযুক্তি নিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রযুক্তির পরিবর্তনের এ প্রবণতা এত বেশি দ্রুততার সাথে সংঘটিত হচ্ছে তা অনেক আধুনিক যুদ্ধবেত্তাদের কাছেও বোধগম্য নয়। তার প্রমাণ দেখা গেছে ইসরায়েলের আয়রন ডোমের অসাড়তার বেলায়।

হামাসের স্বল্পপাল্লার রকেটে প্রতি সেকেন্ডে ক্ষেপণগতি ও ক্ষেপণসংখ্যা কিছুটা বাড়ানোর ফলেই কুপোকাত হয়ে গেছে আয়রন ডোম। এতদিনের নির্ভরশীল মনে করা আয়রন ডোম চতুর্মুখী রকেট আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে বাঁক ঘুরতে না ঘুরতেই সেই ফাঁকে শত শত রকেট সামনে এগিয়ে গেছে। সজোরে আঘাত হেনেছে লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে।

ইরাক যুদ্ধের সময় আমেরিকার অ্যাপাচি হেলিকপ্টার ও স্কাড খুব ভয়ংকর অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কারণ সেটা প্রতিহত করার মতো ইরাকের কোনো নিরাপত্তা বলয় ছিল না। এখন ঘাড়ের মধ্যে বহনযোগ্য রকেট ছুড়েই অ্যাপাচি হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান ঘায়েল করা হচ্ছে। এসব অস্ত্র পুরোনো বিবেচনা করে পশ্চিমা যুদ্ধবাজ দেশগুলো সেগুলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বিনামূল্যে সরবরাহ করে যাচ্ছেন।

বলা হচ্ছে, সেগুলোর কিছু অংশ হামাস ও হিজবুল্লাহর হস্তগত হয়ে সম্প্রতি ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো দিয়ে শত্রুপক্ষ ছাড়া হামলাকারীরাও হতাহত হয়ে থাকেন। তাই এসব এখন সেকেলে অস্ত্র। মানুষ এখন বিলাসী হয়েছে। বিশেষ করে সৈনিকদের আয়েশি জীবন-যাপন করার ব্যবস্থা প্রতিটি দেশেই স্বীকৃত। তারা একটু র‌্যাংক পেলেই শুধু অধঃস্তনদের নির্দেশ দিয়ে যুদ্ধ করতে পছন্দ করেন।

এছাড়া নিজেরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে নিজেরা বেঁচে থেকে যুদ্ধে জয়লাভ করে আরও বেশিদিন পৃথিবীকে উপভোগ করতে চান। এজন্য আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত মারণাস্ত্র তৈরির বাজেট বাড়ানো হয়েছে। তাই দেশে দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিনির্ভর আরও অত্যাধুনিক অস্ত্র বানানোর জোর প্রচেষ্টা চলছে। অনেক বৃহৎ শক্তিধর দেশ এ ব্যাপারে সফলতার দাবি করে চলেছে। তাহলে আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে যেসব পারমাণবিক ওয়্যারহেড তৈরি করে নিজেকে মহাশক্তিধর হিসেবে জাহির করে আস্ফালন চলছে সেগুলো কি গতির নিকট দুর্বল হয়ে ঘুমিয়ে আছে? নাকি হামাসের হাতে নিক্ষেপ করা রকেটের গতির কাছে পরাজিত হয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগে আকাশেই গুঁড়িয়ে দেওয়া সহজ? কারণ তৈরি করা সেসব পারমাণবিক অস্ত্র কেউ ব্যবহার অথবা ধ্বংস করেছেন বলে শোনা যায়নি। বিপজ্জনক এসব পারমাণবিক অস্ত্রের ভাগ্যে তাহলে কি ঘটবে?

নাকি বর্তমানে সেগুলো ব্যবহারের জন্য কেউ কেউ নিশপিশ করছেন? ইতোমধ্যে গাজা উপত্যকা থেকে সাড়ে এগার লক্ষ্য ফিলিস্তিনিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্যত্র সরে যাওয়ার কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে ঘৃণ্য বহুমুখী আক্রমণ চালাচ্ছে ইসরায়েল! যুদ্ধ শুরুর ২৫তম দিনে হামাসের পাল্টা স্থল আক্রমণে ৯ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হয়েছে। নভেম্বর ০১, ২০২৩ পর্যন্ত গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে সাড়ে আট হাজার এবং আহতের সংখ্যা অগণিত সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে।

পশিচমারা ইসরায়েলের ব্যাপারে একপ্রকার অন্ধ মায়া দেখায়। তারা ইসরায়েলের অন্যায় দখলদারিত্ব কোনো অন্যায়-অবিচার মনে করে না। সেখানে মানবতাবিরোধী ভূমিকা নিয়ে নৌবহর পাঠিয়ে হুমকি দিচ্ছে গণহত্যা সাধনের।

অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে দূত বা টিম পাঠিয়ে মানবতা রক্ষার জন্য মিটিং করে চলেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর তাদের এ বৈপরিত্য ও অবিচার কেয়ামত পর্যন্ত চলবে বলে অনেকে মনে করছেন।

ইসরায়েলিরা ভুলে গেছে যে তারা কয়েক দশক আগেও পৃথিবীতে নিজ ভূমিহারা হয়ে যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল একটি বড় পাপের ফলে। তারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী ও গোঁয়ার্তুমির জন্য বেপরোয়া ঘৃণিত জাতি হিসেবে বিবেচিত। পবিত্র কোরআনে তাদের ওপর মহান আল্লাহ বলেন, তাদের চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, আল্লাহর আয়াতের সাথে কুফরি এবং অন্যায়ভাবে নবিদের হত্যা করার কারণে আল্লাহ তাদের অন্তরে গোমরাহির সিল মেরে দিয়েছেন। (সূরা নিসা : ১৫৫)। উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর প্রিয় নবিদের হত্যা করার জঘন্য তৎপরতা চালিয়ে তারা প্রমাণ করেছে, তাদের স্বার্থের পরিপন্থি যে কোনো লোককে হত্যা করা তাদের দ্বারা সম্ভব।

নিষ্ঠুরতা ইহুদিদের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি। তারা দুজন নবিকে হত্যা করেছে এবং আরেকজনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়। হজরত যাকারিয়া (আ.) এবং হজরত ইয়াহ ইয়া (আ.) - কে হত্যা করেছে। তাদের এই পৈশাচিক মনোভাব এখনও বিদ্যমান। তারা হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-কে হত্যা করে তার ছিন্ন মস্তক তাদের বাদশাহর রক্ষিতাকে উপহার দেয়। স্বয়ং মুসা (আ.)-এর ওপর তারা ভীষণ নির্যাতন চালিয়েছে। হজরত ঈসা (আ.)-কে তারা ক্রশে বিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে। নাম না জানা আরও অনেক নবিকে তারা হত্যা করেছে।’

যুগে যুগে ইহুদিরা পৃথিবীর দেশে দেশে অশান্তি ও গোলযোগ সৃষ্টি করে। মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ঢুকে কুমন্ত্রণা দিয়ে তাদের বিভিন্ন সমস্যায় নিক্ষেপ করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চালায়। এ ব্যাপারে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, যখনই তারা যুদ্ধের আগুন জ্বালায়, আল্লাহ তা নিভিয়ে দেন এবং তারা জমিনে ফিতনা ফাসাদ ও গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। আল্লাহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না।’(সূরা মায়েদা : ৬৪)।

ইহুদিরা শেষ নবি এবং রাসুল হজরত মুহাম্মাদ (সা.) কে একাধিকবার হত্যা চেষ্টা করেছিল। একবার আলোচনার জন্য বসিয়ে রেখে পাথর ছুড়ে হত্যা করার চেষ্টা, আরেকবার মেহমানদারির মধ্যে বিষ যুক্ত খাবার পরিবেশন, আবার জাদু করা (এই প্রেক্ষিতে সুরা ফালাক ও সুরা নাস নাজিল হয়)। অত্যন্ত অপরাধপ্রবণ এ জাতি। পুরো আল কোরআনে একবারের জন্যও হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ শব্দটি আসেনি। কিন্তু অনেকবার বনী ইসরায়েল ও ইহুদি এসেছে। বনী ইসরায়েল হজরত মুসা (আ.) কেও অনেক কষ্ট দিয়েছে।’

আল্লাহ ইহুদিদের ওপর স্থায়ীভাবে লাঞ্ছনা, অপমান ও নির্যাতন নির্ধারিত করে দিয়েছেন। যুগে যুগে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে তাদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেছেন। মিশরের ফেরাউন শাইশাক জেরুজালেম দখল করে এবং ইহুদিদের তাড়িয়ে দেয়। তারপর ব্যাবিলনের রাজা বখতে নসর জেরুজালেম দখল করে ইহুদিদের বন্দি করে নিয়ে আসে এবং তাদের দাস বানিয়ে রাখে। পরে পারস্য সম্রাট ইহুদি দাসদের সেখানে ফেরত পাঠান সত্য, কিন্তু তখন পারস্য সম্রাটেরই অধীন ছিল।

৬৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট তাইতুস জেরুজালেম দখল করে এবং ইহুদিদের ব্যাপক হারে হত্যা করে। উপরন্তু ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান বাহিনী হাজার হাজার ইহুদিকে বন্দি করে নিয়ে যায় এবং তাদের দাস বানায়। এডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইহুদিদের হত্যা করেছিলেন। হিটলারের ইহুদিদের প্রতি ঘৃণার কারণ হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের জন্য ইহুদিদের দায়ী করার কথা বলা হয়।’

তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে গজবপ্রাপ্ত জাতি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী তাদের ধ্বংস অনিবার্য। নবি করিম (সা.) বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না যতক্ষণ না মুসলিমদের সঙ্গে ইহুদিদের যুদ্ধ হবে। মুসলিমরা ইহুদিদের হত্যা করতে থাকবে। তখন তারা (ইহুদিরা) পাথর ও গাছের পেছনে লুকিয়ে আশ্রয় নেবে। তখন পাথর ও গাছ বলবে, হে মুসলিম, হে আল্লাহর বান্দা, এই তো ইহুদি আমার পেছনে লুকিয়ে আছে। এসো, তাকে হত্যা করো।’(সহিহ মুসলিম)।

যা তারা জেনেও না জানার ভান করে আস্ফালন করে থাকে। ১৯৪৮ সাল থেকে অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি দখল করে হাজার হাজার নিষ্পাপ ফিলিস্তিনি নারী-শিশুদের অন্যায়ভাবে হত্যা করে তারা ক্রমাগত পাপাচারে লিপ্ত হয়েছে। তারা হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, শরণার্থী শিবির মসজিদ ইত্যাদির ওপর নিষিদ্ধ বোমাবর্ষণ করে তিন হাজার হত্যা ও সাড়ে চার লাখ ফিলিস্তিনিকে ইতোমধ্যে উদ্বাস্তু করেছে। পানি, ওষুধ, খাদ্য প্রবেশের মূল রাস্তা বন্ধ। এগুলো কি চরম মানবিক অধিকার হরণ নয়?

ন্যাটো একতরফা ইসরায়েলিদের পক্ষ নিয়েছে। জাতিসংঘ চেষ্টা করছে যুদ্ধ থামাতে কিন্তু পশ্চিমাদের কারণে পেরে উঠছে না। রাশিয়া ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলছে। অক্টোবর ৩১, ২০২৩ তারিখে ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথি ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের ইলাত শহরে ড্রোন হামলা করেছে এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ রকেট ছুড়েছে। ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্ব ইসরায়েলিদের এ হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে জোরালো প্রতিবাদ শুরু করেছে।

ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধ না করলে অথবা ন্যাটো দ্বিচারিতা বন্ধ না করলে ফিলিস্তিনিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে যে কোনো পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাহলে অচিরেই সারাবিশ্বে মহাগোলযোগ শুরু হতে পারে। বিশ্বযুদ্ধের পাকানো সলতের মধ্যে কেউ আগুন ধরিয়ে দিলে গর্জে উঠবে চারদিক। যে যুদ্ধে কেউ জয়লাভ করবে না। যুদ্ধবাজরা বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করার সময় পাবে না।

ফিলিস্তিন যতদিন নিরাপদ হবে না ততদিন ইসরায়েল অনিরাপদ থেকেই যাবে। কেউ বিজয় উল্লাসে ফেটে ওঠার আগেই মানবতার চরম পরাজয় সাধিত হয়ে সবকিছু নিথর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস

ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধ না করলে অথবা ন্যাটো দ্বিচারিতা বন্ধ না করলে ফিলিস্তিনিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে যে কোনো পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাহলে অচিরেই সারাবিশ্বে মহাগোলযোগ শুরু হতে পারে। বিশ্বযুদ্ধের পাকানো সলতের মধ্যে কেউ আগুন ধরিয়ে দিলে গর্জে উঠবে চারদিক। যে যুদ্ধে কেউ জয়লাভ করবে না। যুদ্ধবাজরা বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করার সময় পাবে না। ফিলিস্তিন যতদিন নিরাপদ হবে না ততদিন ইসরায়েল অনিরাপদ থেকেই যাবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।