খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ধাপগুলো
বাংলাদেশ আয়তনে ছোট এবং অধিক ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী ৫২ বছরে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ও ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। জাতির সংকটকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি উন্নয়নে যে রূপ রেখা দিয়েছিলেন পরবর্তীকালে তার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা তা বাস্তবে রূপান্তর করে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে প্রকট খাদ্য সমস্যা দেখা দেয় এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেই সংকট অবশ্য প্রথম বছরেই কাটিয়ে ওঠে বাংলাদেশ। তারপর বিভিন্ন সময় পাকিস্তানি ভাবধারার বেশ কয়েকটি সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় বাংলাদেশ আবারও পথ হারায়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর খাদ্য সংকট নিরসনে কাজ শুরু করে। অতঃপর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য শেখ হাসিনার সরকার দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় আবারও প্রাণ ফিরে পায় দেশের কৃষিতে এবং শুরু হয় খাদ্য উৎপাদনে সবুজ বিপ্লব। ফলে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। এজন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক মর্যাদাপূর্ণ সেরেস পদকও পান। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের শাসনামলে সেই স্বপ্নগুলো আবারও ধাক্কা খায়।
পুনরায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ২৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতিসহ সরকার পরিচালনা শুরু করে। ২০১৩ সালে এসে আবারও দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। সে বছর খাদ্য উদ্বৃত্তও হয়। এর পরের বছর থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত চাল বিদেশেও রফতানি শুরু হয়। শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্যের ধারাবাহিকতা কৃষিতে কৃতিত্ব এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরিসংখ্যানেই পরিলক্ষিত হয়।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষিতে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। একদিকে কৃষিজমি কমেছে, অন্যদিকে কয়েকগুণ বেড়েছে জনসংখ্যা। তবুও খাদ্যের কোনো অভাব নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের খাদ্য সংকটের বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য এক নজরে সরকারের অবদানগুলো:
১.খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দশম। এক ও দুই ফসলি জমিগুলো অঞ্চল বিশেষে প্রায় চার ফসলি জমিতে পরিণত করা হয়েছে এবং দেশে বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা ১৯৪ শতাংশ।
২.২০১৮ সালে সার খাতে ৫৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।
৩.২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে কৃষি প্রণোদনা/পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে ৮২৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৩ জন কৃষক উপকৃত হয়েছে।
৪.প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
৫.২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ জন কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান করেছে।
৬.১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেওয়ায় ১ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৮টি ব্যাংক হিসাব খোলা সম্ভব হয়েছে।
৭.ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। লবণাক্ততা, খরা, জলমগ্নতা সহনশীল ও জিংকসমৃদ্ধ, ধানসহ এ পর্যন্ত ধানের ১০৮টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
৮. নিবিড় সবজি চাষের মাধ্যমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
৯.আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম। দেশে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২.৮৮ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়েছে।
১০.কৃষি পণ্য রফতানি থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৭৩ দশমিক ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। এজন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক মর্যাদাপূর্ণ সেরেস পদকও পান। পুনরায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ২৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতিসহ সরকার পরিচালনা শুরু করেন। ২০১৩ সালে এসে আবারও দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।
১১.২০০৮-০৯ অর্থবছরে ধান, গম, পাট, ভূট্টা, আলু, সবজি, তৈল ও মসলাসহ বিভিন্ন ফসলের গুণগত মানসম্মত বীজ সরবরাহের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭৪ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৯২২ মেট্রিক টনে।
১২.২৮ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ১২টি আলুবীজ হিমাগার নির্মাণ এবং ৪টি টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে।
১৩.২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ১৪ হাজার ৫২০ দশমিক ৪২ কোটি টাকার কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
১৪.বর্তমানে ৬.৪০ লাখ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার আধুনিক খাদ্য গুদাম/সাইলো নির্মাণের লক্ষ্যে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন।
১৫.দেশের উত্তরাঞ্চলে ১.১০ লাখ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন খাদ্যগুদাম নির্মাণ করা হয়েছে।
১৬.সারাদেশে ১০০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষম ৭০টি গুদাম এবং ৫০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষম ১৩০টি গুদাম নির্মাণ।
১৭.মংলা বন্দরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন কনক্রিট গ্রেইন সাইলো নির্মাণ।
১৮.ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর ইত্যাদি খাতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮.৩৭ মেট্রিক টন পরিমাণ খাদ্যশস্য সরবরাহ।
১৯.২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন চাল রপ্তানি।
২০.২০১৬ সালে নেপালে ২০ হাজার মেট্রিক টন চাল সাহায্য হিসেবে প্রেরণ।
২১. ২০১৬ সাল থেকে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে ১০ টাকা কেজিতে বিতরণের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চলমান।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম