আনন্দে লেখাপড়া শুরু হচ্ছে শিশুদের

ড. বিপ্লব মল্লিক
ড. বিপ্লব মল্লিক ড. বিপ্লব মল্লিক , চেয়ারম্যান, শিক্ষাবিভাগ ও ডিন, শিক্ষা বিজ্ঞান অনুষদ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) শিক্ষক সমিতি ২০২৩।
প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ৩০ অক্টোবর ২০২৩

শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ শিশুর মৌলিক অধিকার। এটা শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ করে। এজন্য শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে তার ভিত্তি। কাজেই সব শিশুর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার রয়েছে।

ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত এদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা খুবই অবহেলিত ছিল। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার শত প্রতিকুলতা সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে ৩৬,১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭২৪ জনবলসহ জাতীয়করণ করেন। শিক্ষার ইতিহাসে এ ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া একটি দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন।

শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়ন এবং যুগোপযোগী কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শুধু তাই নয়, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সরকারের পর তারই যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনার সরকার ২০১৩ সালে ২৬ হাজার বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জনবলসহ একযোগে জাতীয়করণ করেন।

শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি বিদ্যালয়ে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালুকরণ, আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ, বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, লেখাপড়ার মাঝে খেলা ও ছবি আঁকার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে পাঠদান করানো শিক্ষার্থীদের পাঠে অংশগ্রহণ যেমন বেড়েছে তেমনি ঝরে পড়ার হারও কমেছে।

প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা। মৌলিক পাঠদানও শুরু হয় প্রাথমিক থেকে। যে কারণে প্রতিটি শিশুর বিদ্যালয়ে উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষায় সব শিশুর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষায় সব শিশুর শতভাগ উপস্থিতি এবং ঝরে পড়ার হার হ্রাস করার জন্য ১৯৯০ সালে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস করা হয়।

অন্যদিকে ২০১০ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘শিক্ষাকে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রধান হাতিয়ার’ বিবেচনায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে প্রথম একটি পরিপূর্ণ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার জন্য পাঠ্যবইয়ে আনা হয়েছে নানান পরিবর্তন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখা এবং যুগোপযোগী পাঠদান কার্যকর করার লক্ষ্যে বিদ্যালয়গুলোতে আইসিটি উপকরণ বিতরণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের প্রচলন, শিক্ষকদের আইসিটির ওপর প্রশিক্ষণ, বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ প্রচেষ্টা গ্রহণ করায় শিক্ষার গুণগত মান যেমন বেড়েছে তেমনি শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও বেড়েছে।

এত সব উদ্যোগের ফলে বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির শতকরা হার ৯৭ দশমিক ৫৬ যদিও তা ২০০৫ সালে ছিল ৮৭ দশমিক ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ইউনিসেফের ২০০৪ সালের হিসাবে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ছিল প্রায় ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষদের সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ।

২০২২ সালের হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ এর মধ্যে পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং নারীদের সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০০৪ সালের তুলনায় সাক্ষরতার হার বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। বিশেষ করে নারীদের সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে।

শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং ঝরে পড়ার হার রোধ করতে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে রঙিন বই তুলে দেওয়া, উপবৃত্তি কার্যক্রম ও স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি বিদ্যালয়ে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালুকরণ, আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ, বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, লেখাপড়ার মাঝে খেলা ও ছবি আঁকার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে পাঠদান করানো শিক্ষার্থীদের পাঠে অংশগ্রহণ যেমন বেড়েছে তেমনি ঝরে পড়ার হারও কমেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে স্থানীয় জনসমাজের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির ফলে বিদ্যালয়ে শতভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি করানো ও তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। ব্যানবেইসের তথ্যমতে ২০০৫ সালে যেখানে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৭.২ শতাংশ সেখানে ২০২২ সালে ১৩.৯৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পুনরায় বিদ্যালয়মুখী করার জন্য সরকারের একটি অন্যতম উদ্যোগ ছিল রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) নামক একটি প্রকল্প, যা ‘আনন্দ স্কুল’ নামে পরিচিত। এ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিশুরা দ্বিতীয় বারের মতো প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পায়। প্রথমে যদিও এ বিদ্যালয়গুলোর যাত্রা শুরু হয় গ্রামে তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কারণে এসডিজির মূল স্লোগান Leave no one Behind সামনে রেখে আনন্দ স্কুল সম্প্রসারিত হয় শহরের বস্তি এলাকায়। ফলে বস্তির সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বিদ্যালয়ে অবস্থান নিশ্চিত করতে অ্যাসিস্টিভ ডিভাইস বিতরণসহ সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন ২০১২ প্রণয়ন করা হয়।

করোনা পরিস্থিতিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত থেকে হতদরিদ্রের কাতারে দাঁড়ানো পরিবারের শিক্ষার্থীদের খাতা-কলমসহ সব ধরনের শিক্ষা উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা যথাসময়ে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি স্কুল ক্যাচমেন্ট এলাকাভিত্তিক জরিপের মাধ্যমে প্রতিটি শিশুর ভর্তি নিশ্চিত করা, নিয়মিত মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং ঝরে পড়ার হার কমেছে। ঝরে পড়া রোধে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘মিড ডে মিল’ প্রকল্প দারুণ ভূমিকা রেখেছে। শিক্ষার্থীদের পুষ্টি নিরাপত্তায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের মতো বেসরকারি সংস্থা, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

লেখক: চেয়ারম্যান, শিক্ষাবিভাগ ও ডিন, শিক্ষা বিজ্ঞান অনুষদ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) শিক্ষক সমিতি ২০২৩।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।