শেষ পর্যন্ত হেঁটেই ঘরে ফিরতে হবে
একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি।
গ্রামের এক লোকের একটি শখের ঘোড়া ছিল। মাঝেমধ্যে ঘোড়া নিয়ে এখানে সেখানে যেতেন তিনি। একবার একটু দূরের গ্রামে ঘোড়াটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে চায়ের স্টলে আরাম করে চা খেলেন। চা-খোরদের বললেন নিজের কথা, ঘোড়ার কথা। চা-পান শেষে বাইরে এসে দেখেন, ঘোড়াটি নেই। চুরি হয়ে গেছে। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দোকানে ফিরে এসে হুঙ্কার দেন- তিন গুণব, এর মধ্যে ঘোড়া ফেরত না পেলে আগের বার ঘোড়া চুরির পর যা করেছি, এবারও তাই করব। উপস্থিত সবাই ভয় পেল। এদিক ওদিক সন্ধান করে ঘোড়ার হদিস মিলল। মালিক শান্ত হয়ে ঘোড়ায় উঠতে যাবেন, এমন সময় একটি লোক সাহস করে জানতে চাইল- ভাই, আগের বার ঘোড়া হারানোর পর কী করেছিলেন? উত্তর এলো- কী আর করব- ১০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলাম।
এমন উত্তর শুনে তো প্রশ্নকারী লা জবাব- খামাখাই ঘোড়াটি ফেরত দিলাম!
বিএনপি এবং তাদের জোট সঙ্গীদের শেখ হাসিনার সরকার পতনের হাকডাক-হুঙ্কার শুনে এ কৌতুকটি মনে পড়ল। তারা যখন সরকার ফেলে দিতে চায়, প্রধানমন্ত্রী তখন ব্রাসেলস-এ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে বেঠক করছেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ইস্যু নিয়ে। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি তিনি চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে, টানা ১৫ দিনের জন্য। তখনও ‘শেখ হাসিনাকে হটাতে এক দফা’ দাবি নিয়ে হুমকি চলছিল সমানে। গত বছরের অক্টোবরে বলা হয়েছিল- ১০ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। জনগণ এমনটি চায়নি। তাই এমন কিছু ঘটেনি।
সতের বছর আগের ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তারিখটি শেখ হাসিনার ‘লগি-বৈঠা’ আন্দোলনের জন্য আলোচনায় রয়েছে। সে দিন ছিল খালেদা জিয়ার সরকারের মেয়াদের শেষ দিন। দিনটি যেন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর জোট সরকারের জন্য কণ্টকপূর্ণ হয়ে থাকে, সে জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোট’ ঢাকার রাজপথ দখলের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল।
অন্যদিকে, খালেদা জিয়া চেয়েছিলেন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে যেন সদ্য-সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান দায়িত্ব পালন করেন, যিনি সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে থাকাকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন। সে সময় রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদ, যিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পালন করেছেন বহু বছর। সেই ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। অষ্টম জাতীয় সংসদে এ দলের আসন ছিল ৬০টিরও কম। কিন্তু তিনি রাজপথে জয়ী হয়েছিলেন। বিচারপতি কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া হয়নি। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেন। সেই থেকে ১৭ বছর তিনি ক্ষমতার বাইরে।
এর ঠিক দশ বছর আগে, ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসেও শেখ হাসিনা রাজপথে জয়ী হয়েছিলেন। সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী বা সংসদে বিরোধীদলের নেতৃত্ব পদে ছিলেন না। এমনকি সংসদ সদস্য পদেও ছিলেন না। অথচ তাঁর ডাকে সচিব থেকে পিওন-দারোয়ানসহ সচিবালয়ের শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজপথে নেমে তোপখানা রোডের সমাবেশে একযোগে দাবি তোলে- খালেদা জিয়াকে পদত্যাগ করতে হবে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল বাতিল করতে হবে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের কাজও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর ডাকে। এ নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগসহ অনেক দল অংশ নেয়নি। কিন্তু রাজপথের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর হাতে। তিনি খালেদা জিয়াকে সংবিধান সংশোধন করাতে বাধ্য করেছিলেন।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষ অসহযোগ আন্দোলনে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সে সময় বঙ্গবন্ধুর নৈতিক শক্তি ও আইনী ভিত্তি ছিল- তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। জনগণ তাকে স্বাধীনতা ঘোষণার ম্যান্ডেট দিয়েছিল। তিনি সেটা করেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। জনগণ তাঁর ডাকে সাড়া দেয়। কিন্তু এর ২৫ বছর পর শেখ হাসিনা যখন এমনকি জাতীয় সংসদ সদস্যও নন- তাঁর ডাকে কেন জনগণ, প্রশাসনসহ অনেক অনেক মানুষ সাড়া দিল? এ নিয়ে কিন্তু বড় ধরনের গবেষণা হতেই পারে।
শুকনো গলায় হুঙ্কার দিয়ে কি সরকারের পতন ঘটানো যায়? বিএনপি এবং তাদের সঙ্গীরাও এটা জানে। এটাও জানে, শেষ পর্যন্ত হেঁটেই ঘরে ফিরতে হবে। যে লক্ষ্য অর্জিত হবে না, যে কর্মসূচিতে জনগণের সামান্যতম সাড়াও মিলবে না- তেমন পথে কেন চলছে বিএনপি?
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর কি খালেদা জিয়ার দল বিএনপি এবং তাদের উগ্রপন্থি ডান-বাম জোট সঙ্গীরা লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে? ১৭ বছর আগে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী জোট যা পারেনি, এখন কি তা পারবে? তারা সরকার উৎখাতের ডাক দিয়েছে। এ জন্য রাজপথে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগের সংকল্প ব্যক্ত হয়েছে বার বার। তারা বলছে- আওয়ামী লীগ পুলিশ-র্যাব না নিয়ে কেবল দলীয় শক্তির জোরে মুখোমুখি মোকাবিলায় আসুক। কিন্তু ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী জোটের হাতে এ ক্ষমতা ছিল এবং তারা এর ব্যবহারও করেছে।
শুধু তাই নয়, এইচ এম এরশাদের সময়ের মতো বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর ব্যবহার করেছে। এমনকি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদ যখন ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের পরের দিনগুলোতে রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে অধিষ্ঠিত, তখনও তিনি শেখ হাসিনার আন্দোলন মোকাবিলায় সেনাবাহিনী নামিয়েছিলেন। কিন্তু এ কৌশল সফল হয়নি। কেন সফল হতে পারল না বিএনপি ও তাদের জোট সঙ্গীরা?
বিএনপি ঢাকায় গোলযোগ পাকানোর চেষ্টা যখন করছে, শেখ হাসিনার তখন কর্মসূচি- কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন। বাংলাদেশের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে লন্ডনের টেমস নদীর তলদেশ দিয়ে চলে যাওয়া সুড়ঙ্গ পথের বৃত্তান্ত পড়ানো হতো। এখন বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের মিথ্যাচার মোকাবিলা করে নিজের অর্থে পদ্মা সেতু বানিয়েছে। ঢাকায় চলছে মেট্রোরেল। ভারতের সঙ্গে সীমানা বিরোধের শান্তিপর্ণ উপায়ে নিষ্পত্তি করে দেশের আয়তন বড় করেছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নিয়ে বিরোধের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় সমান সমুদ্র-অঞ্চলের মালিকানা পেয়েছে। খাদ্যশস্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। সবজি, ফল, মাছসহ অনেক ধরনের পণ্যের উৎপাদন বাড়ছে। ঘরে ঘরে ও শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ মিলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগ ছাড়িয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্য এখন আর অধরা মনে হয় না।
বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসের অর্ধেকের বেশি সময় এমন অপশক্তি ক্ষমতায় ছিল, যারা এ সব বড় বড় অর্জনের কথা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, স্বপ্নেও ভাবেনি। তাদের ডাকে কেন জনগণ সাড়া দেবে? সুখে থাকতে ভূতের কিল কেন তারা খেতে যাবে?
বিএনপি নেতারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছে- ২৮ অক্টোবর তারা এক থেকে সোয়া লাখ লোক জমায়েত করতে চায় ঢাকার বিজয়নগর-কাকরাইল মোড় থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত এলাকায়। আশির দশকে এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ দল একাধিক সমাবেশ করেছে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের প্রশস্ত চত্বরে। অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোটের সমাবেশ হয়েছে গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার এলাকায়।
বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে চায় না। তারা জানে এ বিশাল প্রান্তরের এক কোণাও তারা ভরতে পারবে না। তারচেয়েও বড় ভয়- এ উদ্যান যে স্বাধীনতার কথা বলে। এ উদ্যান যে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের জন্য জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের কথা বলে। এসব ইতিহাস তাদের গলা শুকিয়ে দেয়। কিন্তু শুকনো গলায় হুঙ্কার দিয়ে কি সরকারের পতন ঘটানো যায়? বিএনপি এবং তাদের সঙ্গীরাও এটা জানে। এটাও জানে, শেষ পর্যন্ত হেঁটেই ঘরে ফিরতে হবে। যে লক্ষ্য অর্জিত হবে না, যে কর্মসূচিতে জনগণের সামান্যতম সাড়াও মিলবে না- তেমন পথে কেন চলছে বিএনপি?
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম