অত্যাচারিত ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা দিন
সমগ্র বিশ্বে আজ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মাঝে হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবাই যেন অজানা এক আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। তরবারির ঝন-ঝনানি, বোমাবাজি আর আত্মঘাতী-হামলার এক ছাপ মানুষের হৃদয়পটে প্রতিনিয়ত ভেসে ওঠে।
ধর্মীয় কারণে হোক বা অন্য কোনো বিষয় হোক কোনো অবস্থায়ই বাড়াবাড়ির শিক্ষা ইসলাম দেয় না। ধর্মে বলপ্রয়োগ না করতে পবিত্র কোরআন সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। পবিত্র কোরআন সুস্পষ্ট করে নির্দেশ দিয়েছে যে, ধর্ম-বিশ্বাসের বিস্তার ঘটাতে তরবারি ধারণ করো না, বরং ধর্ম-বিশ্বাসের অনুপম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সুন্দর-শিক্ষা প্রত্যেকেরই উপস্থাপন করা উচিত, যাতে তার অনুকরণীয় উত্তম-আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে অন্যরাও তা গ্রহণ করে নেয়।
কোনোক্রমেই এ ধারণার উদ্রেক করা ঠিক হবে না যে, ইসলাম প্রচারে তরবারি প্রয়োগের নির্দেশ রয়েছে। ধর্ম বিশ্বাসের বিস্তার ঘটাতে নিশ্চিত ভাবেই তরবারি ব্যবহৃত হয়নি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়েছিল, এটাই সত্য ঈমানের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে অবশ্যই এটি অর্থাৎ তরবারি কখনও ব্যবহৃত হয়নি। কারণ, ঈমানী বিষয়গুলো তো মানব হৃদয়ের সাথে সম্পর্কিত। ধর্মের টানে নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়। মক্কার প্রথম তের বছর মুসলমানদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এমনকি, মদিনায় হিজরত করার পরও শত্রুরা তাদের ওপর চড়াও হলে সম্পূর্ণ অসজ্জিত অবস্থায় থেকেও তাদের ফিরতি-যুদ্ধ করতে হয়েছে।
চাপপ্রয়োগে মুসলমান হলে কেউ কী এমন কোরবানি করতে পারে? বরং হওয়া তো উচিত ছিল এমন- যে ব্যক্তি চাপে পড়ে মুসলমান হয়েছে, ইসলাম আক্রান্ত হলে সে মহা-আনন্দিত হবে, সে ভাববে, ভালোই হয়েছে, তাকে উদ্ধারের জন্য কেউ না কেউ এসে গেছে। যেহেতু তাদের কোরবানিসমূহ সাক্ষ্য দিচ্ছে- যে-কেউই মুসলমান হচ্ছে, সে সর্বান্তকরণেই ইসলাম গ্রহণ করছে। এজন্য যদি সে যুদ্ধও করে, তা-ও এক বিশেষ-উদ্দেশ্যের জন্যই করে। প্রথম উদ্দেশ্য ছিল-আত্মরক্ষা করা। শত্রুরা সর্বদা উত্ত্যক্ত করেছে, করেছে আগ্রাসী-আক্রমণ, আর মুসলমানরা আত্মরক্ষা করতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল- নিরস্ত্র মুসলমানদের যখন অবলীলায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন অহেতুক এই রক্তপাত ঠেকাতে এবং নির্মম নিষ্ঠুরতার শাস্তি দিতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আরবদের রীতি ছিল এটা, আর শান্তি বজায় রাখতে এর অবশ্য প্রয়োজনও ছিল- এবং সে ধারা আজও সর্বত্র স্বীকৃত।
তৃতীয়ত, যুদ্ধ করা হলে তা করা হবে বিরোধীদের দুর্বল করতে, কেননা তারা একত্রিত হচ্ছে মুসলমানদের নির্মূল করতে, শুধু এ কারণে যে, তারা এক-আল্লাহর ইবাদত করে। এ অবস্থায় যুদ্ধ করা না হলে কাফিররা একজন মুসলমানকেও বাঁচতে দেবে না। মহান আল্লাহতাআলা যথার্থই কোরআনে বলেছেন, ‘ঠেকানো না হলে তারা মঠ, মন্দির, গির্জা, সিনেগগ এবং মসজিদগুলোকে ধূলিস্যাৎ করবে আর নির্মম নিষ্ঠুরতা ক্রমেই বেড়ে চলবে।’
ইতিহাস এই সাক্ষ্যই বহন করছে যে, মুসলমানরা কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেও কোনো একজনকেও মুসলমান হতে কখনও বাধ্য করা হয়নি। প্রত্যেক ব্যক্তিরই ইবাদতের স্বাধীনতা আছে। যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে মহানবি (সা.) সুনির্দিষ্ট করে বলে দিতেন যে, ‘বয়োবৃদ্ধদের, নারীদের এবং শিশুদের অনিষ্ট করবে না, আর উপসনালয়ের ক্ষতি সাধন করবে না।’ এমনকি বৃক্ষরাজি পর্যন্ত তিনি কর্তন করতে নিষেধ করেছেন।
মুসলমান দেশগুলোতে খ্রিস্টান ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা যাতে তাদের অধিকার সঠিকভাবে ভোগ করতে পারে, সেজন্য অমুসলমানদের থেকে ‘জিজিয়া’ ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি কর’ নেওয়া হতো। আর কারও যদি তা দেওয়ার সামর্থ্য না থাকতো, তবে তা আদায় করা থেকে তাকে অব্যাহতিও দেওয়া হতো।
মহানবির (সা.) দ্বিতীয়-খলিফা হজরত ওমর (রা.) এর যুগে অজ্ঞাত এক খুনি, ইহুদি এক ব্যক্তিকে হত্যা করলে হজরত ওমর (রা.) খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাই, তিনি (রা.) সবাইকে মসজিদে-নববীতে ডেকে একত্রিত করলেন এবং খোদাভীতির কথা স্মরণ করিয়ে খুনির ব্যাপারে অনুসন্ধান করলেন। এতে উপস্থিত মুসলমানদের একজন সেই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে নিল। অবশেষে সেই ইহুদি পরিবারের সম্মতিতে খুনের মুক্তিপণ আদায় করে সেই খুনি অব্যাহতি পায়।
ইসলাম শত্রুদের সাথেও দয়ার্দ্র আচরণ করে, তা শান্তিকালীন সময়েই হোক বা যুদ্ধাবস্থায়-ই হোক। সর্বাবস্থায় ইসলাম অমুসলমানদের অধিকার মর্যাদার সাথে সংরক্ষণ করে। ইসলামে বল প্রয়োগ করা হলে, মহানবি (সা.) বা তার (সা.) খলিফাগণের যুগে সংঘটিত এমন দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যেতো না।
বাস্তবতা হলো, কী পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল, যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ মুসলমানদের যুদ্ধের অনুমতি দিলেন? আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯০) চড়াও হওয়া বা আক্রমণ করার অধিকার ইসলামে নেই। ইসলামের বাস্তব-শিক্ষা হলো, কেবল আক্রান্ত হলেই তুমি যুদ্ধ করতে পার। অধিকন্তু, এখানে এ নির্দেশও রয়েছে যে, আক্রমণকারী বা আগ্রাসী হয়ো না, চুক্তি ভঙ্গকারী হয়ো না।
আমরা আজ এটাই দেখছি যে, সুন্দর সাবলীল ও সুগঠিত এসব ইসলামি শিক্ষার ওপর কোনো দেশই আমল করছে না। বোমা মেরে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করছে, অপরদিকে, আগ্রাসী-বাহিনী, শহর-নগর-বন্দরে বোমাবর্ষণ করছে, গুলি চালাচ্ছে, করছে অতর্কিত- আক্রমণ। তারা নগরগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নগর-অবকাঠামো সমূলে বিনাশ করছে।
এখন প্রয়োজন মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা। আল্লাহতায়ালা এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি করুন আর নিরপরাধ অত্যাচারিত ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা করুন, আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম