বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেটের ৭টি পরামর্শ
বিশ্বসেরা বিনিয়োগ গুরু, ওয়ারেন বাফেটকে চেনেন না এমন মানুষ মনে হয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার সম্পদ মূল্য একশো বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এটি খুবই বিরল এবং অনন্য একটা কৃতিত্ব তার জন্য। কিন্তু আপনি কি জানেন যে, এ লম্বা সময় ধরে ধনী মানুষদের তালিকায় থাকা এই ব্যক্তি খুব সাধারণ জীবন যাপন করেন। তিনি এখনও তার নিজস্ব শহরে থাকেন। এখনও সেই বাড়িতেই থাকেন, যে বাড়িটি তিনি কিনেছিলেন ১৯৫৮ সালে ওমাহা নেবরাস্কতে ৩১,৫০০ ডলার দিয়ে। তিনি সকালে খান ম্যাকডোনালসের নাশতা। একটি পুরোনো শালীন একটা গাড়িতে তিনি চলেন। এবং তিনি ছয় বছরের বাচ্চারা যেমন খাওয়া-দাওয়া করেন, আইসক্রিম, সোডা তিনিও এরকমই খাবার খান।
ওয়ারেন বাফেটের সবচাইতে বিশেষ যে দিক সেটা হলো, উনি ব্যক্তিগত জীবনে খুবই সুশৃঙ্খল এবং অতুলনীয় ধৈর্যের অধিকারী। এই ভদ্রলোক প্রতিদিন প্রচুর পড়াশোনা করেন। একটা পত্রিকা দিয়ে তিনি তার দিন শুরু করেন। এবং সারাদিন প্রায় প্রচুর বইপত্র পড়াশোনা করেন। ফলে অসংখ্য তথ্যে তিনি সমৃদ্ধ।
আমি আজকে ওয়ারেন্ট বাফেটের দশটি বিনিয়োগ পরামর্শ নিয়ে কিছু বলব, যে কৌশলগুলো উনি ওনার জীবনে পালন করেছেন। যদি সেগুলো জানতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের জীবনকেও সমৃদ্ধ করতে পারবো।
এক.
সব কিছুর শুরু হয় ভালো যোগাযোগের মাধ্যমে। বাফেটের সমৃদ্ধির প্রথম চাবিকাঠির সঙ্গে স্টকে বিনিয়োগের খুব বেশি একটা সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, আপনাকে কমিউনিকেশনে খুবই শক্তিশালী একজন মানুষ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে সুন্দর শব্দগুলো আপনি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করুন। ভালো যোগাযোগ দক্ষতা ছাড়া একজন মানুষ আপনাকে কেন অনুসরণ করবে?
দুই.
অতীতের দিকে নয় বরং সামনের দিকে তাকান। ওয়ারেন বাফেটের ১৯৫০ দশকের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘আজকের বিনিয়োগকারী গতকালের প্রবৃদ্ধি থেকে লাভবান হয় না’। এই কথাটি আজও সত্য। বাফেটের মতে, অতীতের প্রবণতা অনুসরণ করার চেয়ে নতুন সুযোগ চিহ্নিত করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এর ইতিহাস নয়, তার ভবিষ্যতের দিকে বেশি মনোনিবেশ করুন।
তিন.
কাউকে অনুসরণ করার চেয়ে বরং নতুন কিছু উদ্ভাবন করুন। বাফেট বিশ্বাস করেন, সবাই যেদিকে যায় সেদিকে না গিয়ে বিকল্প একটা পথ তৈরি করে হাঁটা উচিত। সংঘবদ্ধ যে মানসিকতা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখান থেকে বের হয়ে আসা খুবই কঠিন। কিন্তু আপনার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে আপনার নিজস্ব একটা বিনিয়োগ কৌশল তৈরি করতে হবে এবং দল (ক্রাউড) থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একজন সফল বিনিয়োগকারী হতে হলে আপনার চারপাশের লোকদের ভয় এবং লোভ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। যদিও এটা প্রায় অসম্ভব। একই সময়ে ভালো পরামর্শ গ্রহণ করুন। পরিকল্পনা সংক্রান্ত যে পরিষেবাগুলো আছে, যা অনলাইনে পাওয়া যায় সেগুলো আপনাকে আপনার স্বপ্নের অবসরের দিকে গাইড করতে সহায়তা করতে পারে। সর্বদাই নতুন জিনিস শিখতে ইচ্ছুক থাকুন।
চার.
মিতব্যয়ীভাবে জীবন যাপন করুন। ওয়ারেন বাফেট সব সময় তার সাধ্যের মধ্যে বসবাস করেন। তিনি একটি পুরোনো মধ্য মানের গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত। বাফেটের মতে জ্ঞান, ব্যাংকের সুদের মতোই বৃদ্ধি পায়। জ্ঞান আহরণ শুধুমাত্র আপনার বিনিয়োগকে প্রভাবিত করবে না, এটি জীবনের সব ক্ষেত্রে আপনার সাফল্য নিশ্চিত করবে। নতুন প্রযুক্তি এবং নতুন কৌশল সম্পর্কে প্রাপ্ত জ্ঞান আপনি নিজের মধ্যে ধারণ করুন। যারা নতুন কিছু শেখাকে এড়িয়ে যায় তারা এক সময় অচল হয়ে পড়ে। বাফেটের মতো হন এবং নতুন কৌশল ও নতুন বিষয় শেখার জন্য সব সময় নিজেকে উন্মুক্ত রাখুন, মনটাকে খুলে রাখুন।
পাঁচ.
আপনি জানুন কখন আপনাকে গোটাতে হবে। বাফেট তখনই স্টক বিক্রি করেন, যখন তাকে সেটা করতে হয়। যখন মহামারি কোভিড-১৯ আঘাত হানে তখন তার কোম্পানি বাকশার হ্যাতওয়ে ইউএস এয়ারলাইন্স ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের ইকুইটি পুরোটাই বিক্রি করে দেন। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সাফল্যের কৌশল হলো কখন দূরে যেতে হবে তা জানা। ওয়ারেন বাফেট এ শিক্ষাগুলো শিখেছিলেন একজন যুবক হিসেবে ঘোড়ার দৌড়ে বাজি ধরে। তিনি তার বাজি বাড়িয়ে লোকসান মেটাতে চেষ্টা করেছিলেন। এবং তিনি আরও বেশি অর্থ হারিয়ে ছিলেন। যখন একটি স্টক প্রকৃতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তাকে চিনুন যাতে আপনি দূরে যেতে পারেন এবং আপনার ক্ষতি কমাতে পারেন।
ছয়.
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় এ কথাটি ভাবুন। কিনুন এবং ধরে রাখুন এটি একটি সাধারণ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কৌশল, যার অর্থ হচ্ছে একটি স্টক কিনে আপনি তার সাথে লেগে থাকুন। যদি খারাপ সময়ও আসে তবুও কিনুন এবং ধরে রাখুন। যখন একটি স্টকের দাম মাঝে মাঝে অনেক নিচে নেমে যায় তখনও তিনি কিছু মনে করেন না। কারণ ডিসকাউন্টে আরও অনেক শেয়ার কেনার একটি ভালো সুযোগ তখন তৈরি হয়।
সাত.
ধার করা টাকা কখনোই বিনিয়োগ করবেন না। বিনিয়োগ করার সময় আপনার নিজের অর্থ ব্যবহার করুন। কখনোই ঋণ করা বা ধার করা টাকা ব্যবহার করবেন না। ঋণ করা বা ধার করা এক ধরনের পাগলামি। লভ্যাংশ দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির চাবিকাঠি। ওয়ারেন বাফেট সবসময় এমনই স্টক পছন্দ করেন যেটা লভ্যাংশ দেয়। তার কোম্পানি বার্কশায়ার হ্যাতওয়ে লভ্যাংশের আকারে কোকাকোলা থেকে প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন ডলার পায়।
নির্ভরযোগ্য কোম্পানিগুলো থেকে লভ্যাংশ আসে, যেগুলো ধারাবাহিকভাবে তাদের লক্ষ্য পূরণ করে। এমনকি লক্ষ্যকে অতিক্রমও করে। তাদের স্টকগুলো আপনাকে দ্রুত অনেক টাকা নাও দিতে পারে কিন্তু তাদের লভ্যাংশ আপনার বিনিয়োগকে প্রতিনিয়তই বাড়াতে থাকে। মনে রাখবেন সবকিছু সম্ভব বিনিয়োগ এবং জীবনের ক্ষেত্রে। যখন তখন যে কোনো কিছুই ঘটতে পারে। আপনি যদি এটি মনে রাখেন, তাহলে আপনি সতর্কতার সাথে এগিয়ে যাবেন, ঋণ গ্রহণ করা এড়াতে পারবেন, আপনি একটি ঠুনকো বিলাসবহুল জীবন যাপন করবেন না এবং বাজারের ওঠানামা সহ্য করতে সক্ষম হবেন ঠিক ওয়ারেন বাফেটের মতো।
লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।
এইচআর/ফারুক/এএসএম