অন্যের দয়ার জীবন আয়েশের হতে পারে কিন্তু শান্তির হয় না
আমরা নারী উন্নয়নের কথা বলি, নারীকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখি কিন্তু আদতে আমাদের সমাজের কতজন মানুষ নারীকে সত্যিকার অর্থে স্বনির্ভর দেখতে চান? অথবা কতজন নারী নিজেকে স্বাধীন ও স্বনির্ভর হিসেবে ভাবতে পারেন? বরং দেশের বহু সংখ্যক নারী ও পুরুষ দুজনই মনে করেন নারীকে স্বাধীনতা দেয়া মানে, পরিবার ও সমাজকে উচ্ছন্নে পাঠানো। এমনকি নারী নিজেও হয়তো সেই কথাটাই বিশ্বাস করেন।
শিশুকাল থেকেই পরিবার ও সমাজ মেয়েদের মনে পরনির্ভরতার এমন একটি ধারণা ঢুকিয়ে দেয়, যা মেয়েশিশুর আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি হতে দেয় না, বরং শুধু দুর্বল হতে শেখায়। পরিবার তাকে শেখায় তুমি মেয়ে তাই তুমি কোনো কাজ একা করতে পারবে না এবং করা উচিৎ হবে না। মেয়েদের অন্যের সাহায্য নিয়ে দাঁড়াতে হবে, গলা নিচু করে কথা বলতে হবে, তর্ক-বিতর্কে জড়ানো যাবে না, প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করবে না, সবকিছু চুপচাপ মেনে নেবে। সবচেয়ে বড় কথা, সমাজের বেধে দেয়া নিয়ম মেনে একটি মেয়েকে “ভাল মেয়ে” হিসেবে বড় হতে হবে।
মেয়েটির জীবনের লক্ষ্য হবে এমনভাবে বড় হওয়া, যেন সমাজ তাকে ভাল বলে মনে করে এবং ভবিষ্যতে মেয়েটির একটি ভাল বিয়ে হয়। পরিবারের কন্যা সন্তানকে খুব জোরালোভাবে পড়াশোনা শেখানো না হলেও, রান্নাবান্না, ঘর গুছানো, কাপড় ধোয়া, ঝাড়া-মোছা করা ও সেবা-শুশ্রষা করার কাজটি খুব যত্ন করে শেখানো হয়। কারণ অধিকাংশ মেয়ের জীবনের লক্ষ্য সমাজের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাওয়া নয়, শুধু সংসারি হওয়া।
অথচ সংসার বা পরিবার চালানো নারীর একার দায়িত্ব নয়। মেয়েকে শেখানো প্রতিটি কাজই যে পরিবারের ছেলে সন্তানকেও শিখতে হবে, তা মায়েরা মনে করেন না। কারণ মায়েদেরও এই একই পথে হাঁটতে হয়েছিল। কিন্তু এখন পারিবারিক সিস্টেম, দায়িত্বপালন, কাজের ধরন-ধারণ, সামাজিকতা, আয়-উপার্জন সবকিছুতেই বড়ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এখন যেমন নারী শুধু একা সংসারের কাজ সামলাবেন না, পুরুষও তেমনি একা পায়ের উপর তুলে খাবেন না। সংসারের কাজটা যে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই এটা বুঝতে হবে সবাইকে। আর তাই ছেলে সন্তানকেও সংসারের কাজকর্ম শেখানোর কথা বলা হচ্ছে। শুধু যে কাজ শেখানো তা নয়, ছেলে সন্তানকে শেখানো উচিৎ মেয়ে বা নারীকে সম্মান করা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং অন্যকে ছোট করার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসা।
মেয়েরা ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন, সাংবাদিকতা, অর্থনীতি, ফিজিক্স বা নাট্যতত্ত্ব যাই পড়ুক না কেন, তাদের অনেকেরই মূল লক্ষ্য বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানো বা পরিবারের দায়িত্ব নেয়া নয়। তাই অধিকাংশ পরিবারেই কন্যা সন্তানের পড়াশোনা, যত্ন-আত্তি, সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে একধরনের অবহেলা থাকে বা বিষয়টি থাকে সেকেন্ডারি। এখনো বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে অনেক বাবা-মায়ের কাছেই কন্যা সন্তান হলো দায়িত্ব বা বোঝা। তাই দ্রুত নিজেদের সংসার থেকে বের করে অন্যের সংসারে পাঠানোর চেষ্টা করেন।
দেশে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির অন্যতম কারণই হচ্ছে কন্যা সন্তানকে যেমন করে হোক অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া। আত্মনির্ভরশীল হিসেবে দেখতে না চাওয়া ও কন্যাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে না দেয়া। অথচ, পড়াশোনা না শিখিয়ে বা কম শিখিয়ে এবং আত্মনির্ভরশীল না করে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার মানে হলো অভিভাবকের নিজের কাঁধের বোঝা বাড়ানো, কমানো নয়। গ্রামে ও বস্তি এলাকায় খোঁজ করলে দেখা যাবে শ্বশুরবাড়িতে নানাকারণে অত্যাচারিত হয়ে অসংখ্য কম বয়সী মেয়ে, কোলে আরেকটি শিশু নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন অথবা স্বামীর গৃহেই মুখ বন্ধ করে পড়ে আছেন। কারণ তাদের যাওয়ার কোনো পথ নেই, নেই কোনো আশ্রয়। মেয়েরা স্বামীর বাড়ি থেকে বাধ্য হয়ে তখনই বের হন, যখন তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়।
আমরা ভাবি কন্যা সন্তান বাবা-মায়ের উপর বোঝা। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গ্রামের বহু মেয়ে শহরে এসে কাজ করছেন এবং আয় প্রায় পুরোটাই গ্রামে বাবা-মাকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাদের আয়ের উপর বাবা-মায়ের সংসার চলছে। বিভিন্ন কল-কারখানায় ও গৃহশ্রমিক হিসেবে যেসব মেয়েরা কর্মরত, সেইসব নারী শ্রমিকের উপর তাদের পরিবার নির্ভর করে। অথচ পরিবার সেটাকে ঠিকভাবে স্বীকার করে না ও মর্যাদা দেয় না।
মেয়েদের বড় একটা অংশকে এমন একটি ধারণা নিয়ে বড় হয় যে, মেয়েটি ভাবতে শেখে সে অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। পরিবার মেয়েশিশুকে এই ধারণা দিয়েই গড়ে তোলে, যেন মেয়েটি বলে, “আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো, সখা আমি যে পথ চিনিনা”। বিয়ের পর নারী যখন নতুন সংসারে প্রবেশ করেন, তখন স্বামী বা স্বামীর পরিবার অনেকেই চান না, নারী তার চারপাশের প্রতিরোধ ভেঙে বা বাধা ভেঙে এগিয়ে যাক। তারা চান না নারী স্বনির্ভর হোক, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করুক, নিজের মতামত দিক। পরিবারে নিগ্রহের শিকার হলেও যেন নারী মুখ না খোলেন এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি চাপ দেয়া হয়। সবসময় চেষ্টা থাকে যেন কোনভাবেই পরিবারের গ্যাঁড়াকল থেকে নারী বেরিয়ে আসতে না পারেন। আমাদের মেয়েদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়- সুখী হতে চাইলে সংসারের অনেককিছু মনে না নিলেও, মেনে নিতে হয়। কিন্তু একবারও অভিভাবকরা ভেবে দেখেন না এই মেনে নিয়ে কতজন মেয়ে সত্যিকার অর্থে সুখী হয়।
এখনো অনেক বাবা-মা ও অভিভাবক মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড় করানোর চাইতে, কারো হাত ধরে হাঁটার শিক্ষা দেয়ার পক্ষে। তারা মেয়েকে স্বাবলম্বী হওয়ার বদলে, নিরাপত্তার কথা বলে অন্যের উপর নির্ভর করতে শেখান। পরিবার ও সমাজ সেইসব মেয়েদের পক্ষে নয়, যারা নিজেরা কারো সাহায্য ছাড়াই জীবনের পথ পার হয়ে যেতে পারেন। যে মেয়েকে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিতে হয় না। তাদেরকে সমাজের মানুষ ‘উদ্ধত’ও ‘উচ্ছৃঙ্খল’ বলে মনেকরেন এবং এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।
যেসব নারী নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, একা একা যেকোনো কাজ সারতে পারেন, কোনো সমস্যায় পড়লে নিজেই তা সমাধান করতে পারেন, নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে শেখেন, যারা দুঃখে পড়লে নিজেই নিজেকে টেনে তোলেন- সেইসব স্বয়ংসম্পূর্ণ নারীকে সমাজ ‘বেপরোয়া’ বলে মনেকরে। সমাজের মানুষ বলেন, মেয়েরা পুরুষের মতো এমন হবে কেন? মেয়েরা হবে মেয়েদের মতো। কন্যা, বোন, বান্ধবী বা স্ত্রী এমন হবেন, যাকে পুরুষ সামলে রাখতে বা আগলে রাখতে পারবেন। পুরুষ চায় নারী কোনো না কোনো দিক দিয়ে তার উপর নির্ভরশীল থাকুক। শুধু যে পুরুষরা চান, তা নয় নারীদের একটা বড় অংশও তাই চান।
এখনো আমরা মনে করি, নারী স্বাধীন হওয়া মানেই সমাজ ও সংসার উচ্ছন্নে যাওয়া। এমনকি প্রচুর নারী নিজেও তাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু সময় বদলেছে, কারো সাহায্য না পেলেও নারীকে বের হয়ে আসতে হবে এই ধারণা থেকে। অন্যের দয়ার জীবন আয়েশের হতে পারে কিন্তু শান্তির হয় না।
নারীর আত্মমর্যাদাবোধ ধ্বংস করে দেয়ার অসংখ্য উদাহরণ আছে আমাদের সামনে। পরিবার, ধর্ম, সমাজ, আইন, রীতিনীতি, প্রথা, সংস্কার, সবকিছুই নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। নারী যেন শিঁড়দাড়া সোজা করে দাঁড়াতে না পারেন, সেজন্য প্রতিনিয়ত সমাজ গাইড করতে থাকে নারীকে। অথচ সমাজ পুরুষের চলাফেরা কেমন হওয়া উচিৎ, সে সম্পর্কে কিছু বলে না। কারণ সমাজ গঠন করেন পুরুষ, সামাজিক রীতিনীতি তৈরি করেন পুরুষ ও সমাজ চালান পুরুষ। এখানে পুরুষ বলতে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে বোঝাতে চাইছি।
সংবিধান বলে নাগরিক মাত্রই স্বাধীন। সত্যিই কি তাই? দেশে পুরুষ মাত্রই স্বাধীন, নারী নয়। নারীকে সেই স্বাধীনতা আদায় করে নিতে হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে। পরিবারে ছেলে ও মেয়েশিশুর কি সমান অধিকার থাকে? কন্যা সন্তান কি সম্পত্তিতে সমান অধিকার পায়? রাষ্ট্র কি তাকে এই অধিকার দিতে পেরেছে? সমাজ কি পেরেছে নারীকে সমান অধিকার দিতে, নিরাপত্তা দিতে, স্বাধীনতা দিতে? বরং পুরুষ এইসব অধিকার জন্মগতভাবে ভোগ করে। পুরুষই কন্যা, বোন, প্রেমিকা বা স্ত্রীকে স্বাধীনতা দেয়ার অধিকার রাখেন। ঠিক যতোটুকু তারা দিতে চান, সেটুকু অধিকারই নারী ভোগ করেন।
নারীর জীবনযাপন, পোশাক-পরিচ্ছদ, কাজের ক্ষেত্র, শিল্পচর্চা, আনন্দ, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, যৌন স্বাধীনতা সবই পুরুষ বা সংসারের অন্য কারো দ্বারা অনুমোদনসাপেক্ষ। এর বাইরে এসে নিজের মতো কিছু করতে চাইলে, সেটাই হয়ে যাবে গর্হিত অপরাধ। সমাজ তাকে “মন্দ মেয়ে” এর তকমা দেবে। এই তকমা যেন তাকে কেউ না দেয়, সেজন্যই মেয়েদের একটা বড় অংশ খুব সচেতন থাকেন। তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেন অন্যের মতামত মেনে, অন্যের উপর নির্ভর করে চলতে।
সমাজ নারীকে বিশ্বাস করতে শেখায় যে, সে একা কোনো কাজ করতে পারে না। সেই যোগ্যতা তার নেই। আর এই কথা শুনত শুনতে একসময় নারীও বিশ্বাস করতে শুরু করেন তাকে কেউ হাত ধরে এগিয়ে না নিলে, সে আর এগুতে পারবে না। বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ, নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে পড়ে নারীর সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া এতটাই বাধাগ্রস্ত হয় যে, একসময় নিজের উপর তার আস্থাই নষ্ট হয়ে যায়। তাই নারীদের একটা বড় অংশ পদ অর্জন করলেও প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত হতে পারেন না।
প্রায় ৫০ বছর আগের ছলে দাদির একটি গল্প বলছি লেখাটির সাথে প্রাসঙ্গিক বলে। আমার বাবার খালা ছিলেন এই ছলে দাদি। উত্তরাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত এলাকার সম্ভ্রান্ত ঘরের নারী তিনি। অথচ তাঁকে দেখেছি কোনোরকম সামাজিক বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে চলাফেরা করতেন। একদিন দাদির কাছে আব্বা জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর এই অবাধ স্বাধীনতা ও চলাফেরা প্রসঙ্গে। ছলে দাদির উত্তর ছিল, “কায় ফির কী ভাবিবে, তাতে হামার কী আসি যায়। মোর যা মনত চায়, মুই তাই করি। মাইনষি হিসাবে মুই ইচ্ছা স্বাধীন। বেইটছাওয়া বলি কি হামাক ঘরত সেন্দে থাইকতে হবে? শখ-আল্লাদ, পছন্দ-অপছন্দ থাইকবে না? পাকিস্তানি মেলেটারিক পুছি নাই। আর আবার ভয় কাক পাই?”
অথচ এতগুলো বছর পর দেখছি বিভিন্নধরনের টানাপোড়েনের মধ্যে থেকে নারী নিজেই নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলছেন একটা গন্ডির মধ্যে। নানান মোড়কে সমাজ তাকে এই শিকল পরিয়ে দেয়। নারী বিশ্বাস করতে শুরু করেন সে ভার বহনে অক্ষম এবং সৌন্দর্য, কমনীয়তা বা লাবণ্যই তার মূল যোগ্যতা। নারীর উপর বাড়াবাড়ি রকমের নজরদারি, যত্ন এবং ভালোবাসার নামে নারীকে এমন একটা মোড়কে পেঁচিয়ে রাখা হয়, যা নারীর আত্মমর্যাদাবোধকে নষ্ট করে দেয়।
অহংবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি না হলে একজন নারীর পক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। কেউ হাত ধরে ধরে নিয়ে যাবে, এই চিন্তা বাদ দিয়ে নারীকেই তার এগিয়ে চলার পথ চিনে নিতে হবে। নয়তো আধা পথ হেঁটে ফিরে আসতে হবে।
২৪ অক্টোবর, ২০২৩
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম