আজকাল কানে কম শুনছি
আমার এই কথা যারা অবিশ্বাস করবেন তারা এই মহানগরের বাসিন্দা নন। তারা জেলা ও উপজেলা শহরে বাস করেন বা প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে বাস করেন। তারা শব্দদূষণের শিকার হননি বা হয়ে থাকলেও সেই শব্দের ডেসিবল মাত্রা অনেক কম বলে শুনতে পান বা তাদের কানের যন্ত্রগুলো নষ্ট হয়নি আজও।
শব্দদূষণ নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়, সেটা আমরা পত্রিকায় পড়েছি। রাস্তাঘাটে পথচারীগণও অসহ্য শব্দদূষণের অভিযোগ করেন নিজেদের মধ্যেই। ফুটপাত নেই তাই সড়কের ধার ঘেঁষে হাঁটেন অনেকে। সেটা বাধ্য হয়েই। ফুটপাতগুলো দোকানদারদের অবৈধ দখলে। সেখানে, সড়কে পুলিশ ডিউটি করে, কিন্তু অবৈধদের কিছু বলে না। বোধহয় তারা তোলা নেয় দোকানি ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে। কিন্তু যে সব গাড়ি তীব্র হাইড্রোলিক হর্ন বাজাতে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে দেখিনি ট্রাফিক পুলিশ বা টহল দেওয়া পুলিশকে।
তারা দোকানি, ভাসমান দোকানিদের কাছ থেকে তোলা তুলতেই ব্যস্ত থাকেন। কোনো সুপরিসর বসতি এলাকায় ভাসমান সবজি বিক্রেতাদের কাছে থেকে থানা-পুলিশের লোকেরা গাড়িতে বসে থেকে কোনো শিশুকে নিয়োগ দেয় তোলা তুলে এনে দিতে। সেই শিশু পুলিশের ভয়ে কাজটা প্রতিদিনই করে দেয়। কিন্তু একবারও কোনো হর্ন বাজিয়ে পরিবেশ নষ্ট করা গাড়ি থামান না তারা এবং তাদের সচেতন করেন না এই বলে যে এটা অপরাধ। হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ, কিন্তু সেই হর্নের ব্যবহার যত্রতত্র হচ্ছে এবং আমরা ভুগছি তারই নারকীয় শাব্দিক অভিঘাতে। হার্টের ওপর চাপ, রক্তের চাপ বাড়ছে যেমন তেমনি কানের সহ্যক্ষমতাও ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে।
বিষয়টি মারাত্মক এবং অপরাধের শামিল। আইনে কি লেখা আছে আমি জানি না। আইনপ্রণেতারা তো কেবল নাগরিকের কথা ভাবেন না। তারা হর্নওয়ালাদের কথাও ভাবেন। হর্ন না বাজালে রাস্তার গাড়িগুলো পথ দেবে কেমন করে। কিন্তু তারা হয়তো ভুলে গেছেন যে রাস্তায় হর্ন বাজানোর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। কারণ একটি গাড়ি একটি জ্যামের কবল থেকে সামনে এগুলোই সামনের আরেক মহাজ্যামের শিকারে পরিণত হয়। ফলে তাদের হর্ন বাজানোর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু আমরা দেখি জ্যাম থেকে বেরিয়েই গাড়ির ড্রাইভার তীব্র হর্ন বাজাতে বাজাতে সামনে এগিয়ে যায়। একেই বলে ড্রাইভারের অভ্যাস। হর্ন ছাড়া তারা গাড়ি চালাতে পারে না।
ড্রাইভারদের এই অভ্যাসের বিরুদ্ধেই সরকার এবার পথে নামতে যাচ্ছেন। সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় জনসচেতনতা বাড়াতে একদিনের একঘণ্টার এক মিনিট বেছে নিয়েছেন নীরবতা পালনের জন্য। লক্ষ্য হচ্ছে ওই একমিনিট নীরব থাকবে ঢাকা মহানগর।
একমিটি নীরব থাকলেই যদি মহানগরের বাসিন্দাদের শিক্ষা হয়, তাহলে ড্রাইভারদের শিক্ষা দিতে কত মিনিট, কত ঘণ্টা, কত দিন, কত সপ্তাহ, কত মাস ও কত বছর সময় লাগতে পারে?
এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন।
এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন? মাননীয় পরিবেশ মন্ত্রী, নাকি সচিব মহোদয়? নাকি ড্রাইভারদের মালিকরা, যারা হাইড্রোলিক হর্ন গাড়িতে সেট করেছেন? এবং বাজান। প্রাইভেটকার মালিকদের ছেড়ে দিলাম। মহানগরের যাত্রীবাহী বাসসহ সব ধরনের যানবাহনের ড্রাইভারদের এই শিক্ষা কে দেবে যে তাদের হর্নের কারণে আমাদের কাণের বারোটা বেজে গেছে/বেজে যাচ্ছে। তার জন্য প্রতিদিনই মানুষ কালা মানে কানে শুনতে পান না, এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আর তারা টাকা খরচ করে কানের চিকিৎসা করছেন। এতে যে কতো শত কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে তা কি বাসের মালিকরা জানেন বা বোঝেন? তারা বোঝেন না বা জানেনও না। তারা কেবল বোঝেন বাস থেকে টাকা রোজগার করতে হবে।
শব্দদূষণ রোধে গোড়ায় হাত দিন। তা না হলে এক মিনিট নীরব থাকলেই এই অসংস্কৃতপ্রায় ড্রাইভারদের শব্দদূষণের ক্ষতি বোঝানো যাবে না। আবার আমাদের শিক্ষিতজনদের ভেতরেও রয়েছে ক্ষতি সম্পর্কে ভুল ধারণা ও কুশিক্ষা। ওই রকম শিক্ষিতজনের অনেকেই জানে না যে শব্দদূষণেও আমরা আমাদের কানের ক্ষমতা হারাচ্ছি। এই শিক্ষিতদের কে শেখাবে?
আর ড্রাইভাররা সেই রোজগারের চালক, তারা হর্নের ক্ষতি বোঝে না। তারা বোঝে মালিকের পাওনার বিষয়টি। তারা বাসের যাত্রীদের ক্ষতি বিবেচনায় রাখেন না। পুলিশও পথচারীদের কানের ক্ষতি নিয়ে ভাবিত নয়। তারা কেবল প্রকাশ্যে, নীরবে ঘুস পেলেই খুশি। এই পরিস্থিতির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা দায়ী। দায়ী ট্রাফিক পুলিশ ও হর্নের পারমিশনদাতা। যদি আইনে এমনটা লেখা থাকে যে হাইড্রোলিক হর্ন কোনো ক্ষতি করে না, তাহলে যিনি ও যারা এ আইনের প্রণেতা, তাদের কানে হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে দেওয়া হোক। তাহলে তারা বুঝতে পারবেন যে তারা যে আইনের খসড়া করেছিলেন তার ক্ষতি কতোটা ব্যাপক ও অপরাধের শামিল।
না, সরকার বুঝেছেন যে হর্ন এক মারাত্মক ক্ষতি করতে মানুষের। তাই তারা সেই বর্বরতা থেকে বাঁচানোর জন্য একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু তারা এই হর্নের গোড়া কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা না করে জনগণকে সচেতন ও ড্রাইভারদের শিক্ষা দিতে চাইছেন। সব বাস ও ট্রাক থেকে হর্ন প্রত্যাহার করলেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আর যারা সরকারের এ ব্যবস্থা অমান্য করে হর্ন ব্যবহার করবে তাদের জেলে পোরা কি তেমন কোনো বেআইনি কাজ হবে? শব্দদূষণের একটি রিপোর্ট জাগো নিউজ ছেপেছে গত ১৪ অক্টোবর।
শব্দদূষণ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৫ অক্টোবর সকালে ১ মিনিট ঢাকা শহরকে শব্দহীন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। ‘শব্দদূষণ বন্ধ করি, নীরব মিনিট পালনকরি’ স্লোগানে সকাল ১০টা থেকে ১০টা ১ মিনিট পর্যন্ত ১ মিনিট এ কর্মসূচি পালন করা হবে/ করা হয়েছে।
কর্মসূচি সফল করার জন্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, সব ধরনের পরিবহন ও নির্মাণ সমিতি, বিআরটিএ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, স্কাউটসহ সব ধরনের গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহায়তা গ্রহণ করা হবে।
ঢাকা শহরের ১০টি শব্দদূষণপূর্ণ স্থানে আগামীকাল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বিশেষ ক্যাম্পেইন চালানো হবে। শব্দ সৃষ্টিকারীদের মধ্যে সচেতনতামূলক স্টিকার বিতরণ করা হবে। পরে ১০টা থেকে ১০টা এক মিনিট পর্যন্ত শব্দহীন থাকবে ঢাকা শহর।
এ কর্মসূচি সফল করতে ঢাকা শহরের ১১টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান যথা-ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সামনে, শাহবাগ মোড়, উত্তরা, বিজয় সরণি মোড়, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর, গাবতলী, মগবাজার, মহাখালী, গুলশান-১, কমলাপুর, বৌদ্ধমন্দির ও যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় ১৫ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর এবং সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্কুল-কলেজের স্কাউট সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, ট্রাফিক পুলিশ এবং পরিবহন মালিক সমিতির সদস্যরা ব্যানার, ফেস্টুনসহ উপস্থিত থেকে মানববন্ধনে অংশ নেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ বলেন, শব্দহীন থাকা যে কত শান্তির তা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করা হবে। মানুষের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সবাই একসঙ্গে কাজ করে শব্দদূষণ রোধ করতেই হবে।
১৫ অক্টোবর কর্মসূচি পালন হলো। কিন্তু এর কোনো ইমপ্যাক্টই হবে না আমাদের গাড়ির মালিক ও ড্রাইভারদের মধ্যে। কেন হবে না, সে ব্যাপারে সামান্য কথা বলছি। ট্রাফিক আইনে আছে বাসগুলোকে নির্দিষ্ট স্টপেজে দাঁড়াবে ফুটপাত ঘেঁষে, যাতে যাত্রীরা বাসে উঠতে নামতে পারে সহজে। ঢাকার কোনো রকম যানবাহনই এই আইনটি মানে না। এবং কোনো বাসযাত্রী যদি প্রতিবাদ করেন তাহলে তাকে নামিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় বাসের কন্ডাক্টর ও ড্রাইভার। পুলিশের সামনেই তারা রাস্তার মাঝখানে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠায় ও নামায়। কিন্তু পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই।
ঠিক এভাবেই হর্নের শব্দদূষণ বন্ধ করতে পারবেন না বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাবানরা। কারণ যে কাজটি গোড়ায় করলেই সমাধান হয়ে যায়, সেই কাজটি আগায় করার এই মানসিকতাই প্রমাণ করে কর্তৃপক্ষ সমস্যার সমাধান চাইছেন না। কাজের স্বীকৃতি অর্জনে নেমেছেন। তারা এ সমস্যার গায়ে প্রতিষেধক মলম লাগিয়ে জনসচেতনতা অর্জন করতে চাইছেন। এ প্রকল্পে জনগণ বা পথচারী বা সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী, তারাই হর্নের শব্দের শিকার, তাদের জনসচেতনতার কি দরকার? তারা কি তাদের কান বাসায় রেখে গন্তব্যের উদ্দেশে রাস্তায় নামবে?
দরকার ড্রাইভারদের শিক্ষা ও সচেতনতা। প্রয়োজন তাদের স্কুলে পাঠিয়ে আইন ও শব্দদূষণের বিষয়টি কতোটা খারাপ, সেটা হাতেকলমে বুঝিয়ে দেওয়া। বাসে/ মিনি বাসে বাণিজ্যিক পরিবহনের ড্রাইভারদের ৬০/৭০ শতাংশই কিশোর বয়সী। এরা কী লাইসেন্সধারী? লাইসেন্সদাতা কি তাদের যোগ্য মনে করেছেন? কেমন করে তারা যোগ্য হলো ওই সব শিশু-কিশোর? কোন যুক্তিতে নিরক্ষরপ্রায় কিশোরদের লাইসেন্স দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ? যদি না দিয়ে থাকেন তাহলে ট্যাম্পোওয়ালা অবৈধভাবে এদের ব্যবহার করছেন এবং পুলিশ ঘুস তুলেই তাদের জাতীয় দায়িত্ব পালন করছেন। ইদানীং লক্ষ্য করছি আবাসিক এলাকাগুলোতে রিকশায় বা রিকশাসদৃশ অটোতে ভরে গেছে। এগুলোর কোনো পারমিশন নেই। তাই এরা মেইন রোডে যেতে চায় না, যেতে পারে না। এরাও কম দায়ী নয় শব্দদূষণের জন্য।
শব্দদূষণ রোধে গোড়ায় হাত দিন। তা না হলে এক মিনিট নীরব থাকলেই এ অসংস্কৃতপ্রায় ড্রাইভারদের শব্দদূষণের ক্ষতি বোঝানো যাবে না। আবার আমাদের শিক্ষিতজনদের ভেতরেও রয়েছে ক্ষতি সম্পর্কে ভুল ধারণা ও কুশিক্ষা। ওই রকম শিক্ষিতজনের অনেকেই জানে না যে শব্দদূষণেও আমরা আমাদের কানের ক্ষমতা হারাচ্ছি। এই শিক্ষিতদের কে শেখাবে?
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম