শেখ রাসেলের নির্মম হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর হেমন্তের এক রাতে ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবন আলোয় প্লাবিত করে জন্ম নেয় শেখ রাসেল। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রাসেল সবার ছোট, চোখের মণি, ঘর আলো করা এক প্রদীপ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ব্রিটিশ নোবেল বিজয়ী দার্শনিক, লেখক ও সমাজ সমালোচক বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল ভক্ত। সেই বোধ ও অনুভূতি থেকে ছোট সন্তানের নাম রেখেছিলেন রাসেল। রাসেলের জন্ম ও বেড়ে ওঠার সময় বাবাকে কাটাতে হয়েছে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর কারাগারে। জন্মের পর পাঁচ-ছয় বছর পর্যন্ত সেই শিশু ছিল পিতার আদর, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা থেকে বঞ্চিত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন , বাবাকে কাছে পেতোনা বলে মা ফজিলাতুন্নেছাকে ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করত রাসেল। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনেও ছিল চাপা কান্না। যার কিছুটা প্রকাশ ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। ‘কারাগারের রোজনামচা’র বর্ণনাগুলো আরও হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী । ১৯৬৬ সালের ১৫ জুন শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন,
“১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।”
বেঁচে থাকলে শেখ রাসেলের বয়স এখন ৬০ বছর হতো। তার বাবার বয়সের চেয়ে বেশি। বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন ৫৫ বছরে। বেঁচে থাকলে শেখ রাসেল দেখতে এখন কেমন হতেন, বাবার মতো সেই গোঁফওয়ালা ভরাট রাশভারি কণ্ঠের? নাকি আরেকটু ভিন্ন কোনো অবয়বের? রাজনীতিকই কি হতেন? নাকি বড় ভাই শেখ কামালের মতো সংস্কৃতি, ক্রীড়া, রাজনীতির সকল মঞ্চে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতেন শেখ রাসেল? সে প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই।
ব্যক্তিগতভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা ছোট বোন শেখ রেহানা’র কাছে রাসেল একটি অন্তহীন বেদনার মহাকাব্যের নাম। মনের গভীরে দগদগে ক্ষত আর বেদনার দীর্ঘশ্বাস। আহা, রাসেলের জন্মদিনে আমরাও কি বেদনার ঝুড়ি হাতে উপস্থিত হইনি ?
শেখ রাসেল আজ বাঙালির সবচেয়ে বেদনাদায়ক ট্রাজেডির নাম l পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম আর ঘৃণ্যতম শিশু হত্যার ঘটনা শেখ রাসেলের হত্যাকাণ্ড l পাশাপাশি তা ছিল, একটি সদ্য স্বাধীন জাতির অগ্রযাত্রাকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন। যে কারণে ১৫ আগস্টকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে পৈশাচিক বলে অভিমত বিশ্লেষকদের অনেকের, যা কোনোভাবেই বিপ্লব, বিদ্রোহ, অভ্যুত্থানের মানদণ্ডে পড়ে না। সেটি ছিল স্রেফ হত্যাযজ্ঞ, বর্বরতার বিকৃত উল্লাস।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার শত্রু ঘৃণ্য ঘাতকদের নির্মম বুলেট থেকে রক্ষা পায়নি শিশু শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নরপিশাচরা নির্মমভাবে তাঁকেও হত্যা করেছিল। সে তখন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ।
শারীরিকভাবে হত্যার আগে এরা শিশুটিকে মানসিকভাবে মেরে ফেলেছিলো। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এএফএম মহিতুল ইসলামকে জাপটে ধরে সেদিন শিশু রাসেল বলেছিল, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? রাসেল তখন কান্নাকাটি করছিল আর বলছিল যে, ‘আমি মায়ের কাছে যাব, মায়ের কাছে যাব।’ এক ঘাতক এসে বলে, ‘চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি।’ তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি খেতেও চেয়েছিল। ঘাতকরা ওই সময়ও শঠতা-মিথ্যাচার করেছে তার সঙ্গে। বলেছে, চল মায়ের কাছে। এরপর মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে পানি খাওয়াবে বলে নিয়ে যায় আরেক রুমে।
মায়ের লাশ দেখার সময়ই অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তার মিনতি ছিল, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও।’ ঘাতকরা তাকে ব্রাশফায়ার করে পাঠিয়েছে পরপারে। মেজর আলাউদ্দিনের প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশু রাসেলের লাশ মূল বেডরুমে তার দুই ভাবির মাঝখানে পড়ে ছিল। সম্ভবত আগুনে তার পা ঝলসে যায়। মাথা উড়ে গিয়েছিল। পরণে ছিল হাফপ্যান্ট। একটি লুঙ্গিতে মোড়ানো ছিল শেখ রাসেলের লাশ।
১৯৫৯ সালে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ শিশু অধিকারের ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে; যা শিশুদের সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আশ্রয় এবং ভাল পুষ্টির অধিকারকে সংজ্ঞায়িত করেছে। ইউনিসেফ এর শিশু কনভেনশন অন দ্য রাইটস্ অফ দ্য চাইল্ড ১৯৮৯ এর ধারা ৬ এর ২ এ রাষ্ট্রপক্ষগুলির পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব শিশুর বেঁচে থাকা এবং বিকাশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ধর্তব্য অপরাধের খবর পেলেই নিকটবর্তী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উক্ত খবর নির্ধারিত বইয়ে লিপিবদ্ধ করবেন। আইনের দৃষ্টিতে সেটাই প্রাথমিক তথ্য বিবরণী অর্থাৎ মামলা রুজু হওয়া। বঙ্গবন্ধু হত্যা বিষয়ে আইনের এই বিধান বলবৎ থাকা সত্ত্বেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আইনত পরিবারের বা সংক্ষুব্ধ অন্য কারও আলাদাভাবে অভিযোগ দায়ের করার প্রয়োজন ছিল না।
পৃথিবীর সব আইন কানুন , মানবাধিকারের সংজ্ঞাকে দু’পায়ে মাড়িয়ে পরিবারসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এক মাস দশদিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক। অধ্যাদেশে ছিল দুটি ভাগ। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন, তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর থাকলেও এই অধ্যাদেশ জারির নেপথ্যের কারিগর ও মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জেনারেল জিয়া, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিনের মাথায় তৎকালীন সেনাপ্রধানকে হটিয়ে নিজেই সেনাপ্রধান বনে যান। অতি উচ্চাভিলাষী জিয়া ১৯৭৭ সালে ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে যান। এই অবৈধ অধ্যাদেশকে জোর করে বলবৎ রাখা হলেও ১৯৭৯ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই অধ্যাদেশটি কার্যকারিতা হারায়।
ফলে সে সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চাইলেই ১৫ আগস্টের খুনীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু খুনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড জিয়া সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হিসেবে খুনীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করেন। স্থায়ীভাবে তাদের সুরক্ষা দিতে এবং অবৈধ ক্ষমতা দখলকে কেউ যাতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে তা পাকাপোক্ত করতে অবৈধ অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করেন তার অনুগত সংসদে ১৯৭৯ সালে ৯ জুলাই। তখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি নিজেই এই অবৈধ আইনে স্বাক্ষর করেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করার মধ্য দিয়ে সংবিধান পরিপন্থী কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন।
অবশেষে ১৯৯৬ সালে ১২ নভেম্বর সংসদে এই কুখ্যাত অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়৷ এবং একই বছর ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। চার্জশিট হয় ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি৷ ২০ জন আসামীর মধ্যে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে নিম্ন আদালত রায় ঘোষণা করে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর৷
২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চের বিচারপতি এম রহুল আমিন এবং এবিএম খায়রুল হক বিভক্ত রায় দেন। বিচারপতি এম রহুল আমিন ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অন্যদিকে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামিরই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ‘মামলাটির এ পর্যায়ে সরকারের পরিবর্তন হয়ে যায়। পরে এ মামলার নথি হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে পাঠানো হয়। সেই তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। বাকি তিনজনকে খালাস দেন তিনি। পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টে মামলার বাকি কার্যক্রম শেষ হয়।
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসি কার্যকর করা শুরু হয়। এখনো সব খুনির ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছে আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন ও রাশেদ চৌধুরী। তারা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছে। তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের পরোয়ানা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরাতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৈশ্বিকভাবেও আজ খুবই উচ্চকিত মানবাধিকার প্রসঙ্গ। শেখ রাসেলের হত্যাকারীকে আশ্রয় দিলে, প্রশ্রয় দিলে হত্যার শিকার শিশুর মানবাধিকার লংঘিত হয় না? প্রশ্ন রাখলাম, এই প্রশ্নেই মানবাধিকার শব্দের অমীমাংসিত ধাঁধার উত্তর মিলবে।
(প্রবন্ধটি বাংলাদেশ দূতাবাস, ওয়াশিংটন ডিসি’তে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে মুল প্রবন্ধ হিসাবে পঠিত )
লেখক: কাউন্সিলর (পলিটিক্যাল),বাংলাদেশ দূতাবাস, ওয়াশিংটন ডিসি।
এইচআর/এএসএম